বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : প্রায় ১৬০ বছর আগে পুরো বিশ্ব জেনেছিল যে ১৬ শতকের এক অভিযাত্রীর একটি সাংকেতিক পাণ্ডুলিপি পেয়েছিলেন ভূ-তত্ত্বের বিখ্যাত একজন জার্মান অধ্যাপক যার নাম ছিল অট্টো লিডেনব্রক।
তার ভাইয়ের ছেলে অ্যাক্সেলের সাথে মিলে তিনি ওই প্রাচীন পাণ্ডুলিপির সঙ্কেতের রহস্য উদঘাটন করতে পেরেছিলেন। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন ওই পাণ্ডুলিপিতে এমন একটি গুহায় ঢোকার গোপন প্রবেশমুখের কথা বলা আছে যার মাধ্যমে পৃথিবীর কেন্দ্রে পোঁছানো যায়।
বিজ্ঞানের নামে চাচা এবং ভাতিজা আইসল্যান্ডে যান এবং সেখানে হ্যান্স বিয়েল নামে স্থানীয় একজন পর্যটক গাইডকে সাথে নিয়ে তারা পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে যাত্রায় বেরিয়ে পড়েন।
তাদের এই অভিযান গিয়ে শেষ হয় একটি বিলুপ্ত আগ্নেয়গিরি এবং একটি সূর্যহীন সমুদ্রে। যেখানে এই তিন অভিযাত্রী একটি ভূগর্ভস্থ দুনিয়ার খোঁজ পান যেখানে ছিল আলোকিত শিলা, প্রাগৈতিহাসিক সময়ের বন আর চমৎকার সামুদ্রিক জীবন চক্র।
সেই জীবন্ত অতীত মানুষের বিবর্তনের রহস্যকে গোপন রেখেছিল।
কল্পবিজ্ঞানীর ভক্তরা হয়তো জানবেন যে এই গল্পের অনুপ্রেরণা ছিল ফরাসি লেখক জুল ভার্নের কল্পনা, যিনি তার ‘জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ’ বা ‘পৃথিবীর কেন্দ্রে যাত্রা’ নামে বইয়ে আমাদের পায়ের নিচে কী আছে সে বিষয়ে সেই সময়ের তত্ত্বগুলো অনুসন্ধান করেছেন।
কিন্তু আজকের বিজ্ঞানীদের জ্ঞান অনুযায়ী, আমরা যদি ছয় হাজার ৩৭১ কিলোমিটার নিচে যাই তাহলে আমরা আসলে কী পেতে পারি?
এটা জানতে হলে চলুন পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে এক সাথেই যাত্রা করা যাক।
গুপ্ত গুহাশ্রয়
আমাদের পৃথিবী পেঁয়াজের মতো অনেকগুলো স্তর দিয়ে গঠিত। আর আমরা যতদূর জানি তাতে শুধুমাত্র প্রথম স্তরেই প্রাণের অস্তিত্ব আছে। এই প্রথম স্তরকে বলা হয় ‘ক্রাস্ট’ বা ভূ-ত্বক।
এই স্তরে রয়েছে বিভিন্ন প্রাণী বসবাসকারী গুহা বা গর্ত যেমন ছুঁচা বা গন্ধমূষিক এবং ‘ব্যাজার’ বা গর্তবাসী ভোঁদড়ের মতো ছোট আকারের নিশাচর প্রাণী। এর চেয়ে গভীরে গেলে পাওয়া যাবে নাইল ক্রোকোডাইল নামে এক ধরনের কুমির। এরা মাটির নিচে ১২ মিটার পর্যন্ত গভীর গর্ত বা গুহায় থাকতে পারে।
এই প্রথম স্তরে রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন ভূগর্ভস্থ শহর যেমন তুরস্কের এলেনগুবু। বর্তমানে এই শহরটি ডেরিনকুয়ু নামে পরিচিত। এটি ভূ-ত্বক থেকে ৮৫ মিটারের বেশি গভীরে অবস্থিত।
১৮ স্তরের টানেল দিয়ে নির্মিত গোলকধাঁধাঁর মতো বিস্তৃত শহরটিতে ২০ হাজারের বেশি মানুষ ধারণের ক্ষমতা ছিল।
ধারণা করা হয় যে খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০ সালে এই শহরটি গড়ে তোলা হয়েছিল। এরপরের হাজার হাজার বছর ধরে এটি ক্রমাগতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
বিশ্বের সবচেয়ে গভীরতম খনি চার কিলোমিটার পর্যন্ত গভীর।
দক্ষিণ আফ্রিকার স্বর্ণখনির শ্রমিকরা মাটির দুই কিলোমিটার গভীরে জীবন্ত কীট খুঁজে পেয়েছেন কিন্তু তিন কিলোমিটার গভীরতার পর আর কোন প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। এছাড়াও রয়েছে এখনো পর্যন্ত খোড়া বিশ্বের গভীরতম কূপ ‘কোলা’ নামে রাশিয়ার খোড়া অত্যন্ত গভীর কূপ।
অনেকে একে নরকের দ্বার বলে মনে করে এবং স্থানীয়রা দাবি করে যে তারা নির্যাতিত আত্মার চিৎকার শুনতে পায়।
ক্যালিডোস্কোপ
৩০ থেকে ৫০ কিলোমিটার গভীরতায় গিয়ে আমরা আরেক স্তরের দেখা পাই যাকে বলা হয় ‘ম্যান্টল’ বা ‘বিচ্ছুরিত স্তর’। এটা আমাদের গ্রহের সবচেয়ে বড় অঞ্চল। এটি পৃথিবীর আয়তনের ৮২ শতাংশ এবং ভরের ৬৫ শতাংশ জুড়ে বিস্তৃত। এটি উত্তপ্ত শিলা দিয়ে গঠিত যা আমাদের কাছে কঠিন মনে হলেও এটা আসলে খুব ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়। বছরে এটি মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার স্থান পরিবর্তন করে।
মাটির নিচের এই খুব ছোট পরিবর্তনও পৃথিবীর উপরিভাগ বা ভূত্বকে ভূমিকম্পের সৃষ্টি করতে পারে।
এছাড়াও রয়েছে একটি উজ্জ্বল সাগর। এটা এতো বিশাল যে পুরো পৃথিবীর সব সাগরের পানি ধারণ করার সক্ষমতা রয়েছে এই এক সাগরেই। যাইহোক, এতে এক ফোটাও তরল নেই। বরং এটি খনিজ অলিভাইনে জমে থাকা পানির সমন্বয়ে গঠিত। ‘ম্যান্টল’ বা বিচ্ছুরিত স্তরের উপরিভাগের ৫০ শতাংশই এটি দিয়ে গঠিত।
আরো গভীরে গেলে এটি আকাশী নীল রঙের ‘রিংউডাইট ক্রিস্টা‘ বা ‘আকাশী নীল’ রঙের ম্যাগনেসিয়াম সিলিকেটের স্ফটিকে পরিণত হয়।
আরো নিচে নামলে চাপ আরো বাড়তে থারার মানে হ্ছে অ্যাটম বা পরমাণুর গঠনে পরিবর্তন হয়। যার কারণে সবেচেয় পরিচিত পদার্থও খুবই অদ্ভুত আচরণ করতে থাকে।
এটি একটি ঘূর্ণায়মান জায়গা যেটি ক্যালিডোস্কোপের স্ফটিকের মতো বস্তু রয়েছে। এগুলো ক্রমাগত সবুজ তৈক নীল এবং নীল থেকে বাদামী বর্ণে পরিণত হয়। এটা এমন এক জগৎ যেখানে শিলা প্লাস্টিকের মতো নমনীয় এবং খনিজগুলো এতোটাই বিরল যে সেগুলো পৃথিবীর উপরিভাগে সেগুলোর অস্তিত্বই নেই।
বাস্তবিকপক্ষে সেখানে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় থাকা ব্রিজম্যানাইট এবং ডেভমাওইট নামে খনিজগুলো গঠিত হওয়ার জন্য ভূ-অভ্যন্তরের অতি উচ্চ চাপের দরকার হয় এবং এগুলো পৃথিবীর উপরিভাগে উঠিয়ে নিয়ে আসা হলে সেগুলো ভেঙে পড়বে।
আর ২৯০০ কিলোমিটার গভীরে পৌঁছানোর পর আমরা ম্যান্টল বা বিচ্ছুরিত স্তরের শেষ প্রান্তে উপনীত হবো।
ওই দুটি গোলাপি রঙের চিত্র দেখতে পাচ্ছেন?
এগুলো বিশালাকার কাঠামো। এগুলো হাজার হাজার কিলোমিটার জুড়ে বিস্তুত এবং পৃথিবীর আয়তনের ছয় শতাংশ এগুলো দিয়ে গঠিত।
এগুলোকে বলা হয় ‘লার্জ লো শিয়ার ভেলোসিটি প্রভিন্স’ বা সংক্ষেপে এলএলএসভিপি। এগুলোর অবশ্য আরো নাম রয়েছে। যেমন : ‘টুজো’-এটি আফ্রিকা অঞ্চলের নিচে অবস্থিত এবং ‘জেসন’- এটি প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিচে অবস্থিত। এগুলোর উচ্চতা কত তা নিয়ে আলাদা ধারণা প্রচলিত রয়েছে। তবে টুজো ৮০০ কিলোমিটার উঁচু বলে মনে করা হয়। যা ৯০টি হিমালয় পর্বতকে পরস্পরের উপরে বসালে যে উচ্চতা হবে তার সমান।
জেসনের উচ্চতা ১৮০০ কিলোমিটার যা প্রায় ২০৩টি এভারেস্ট পর্বতের মিলিত উচ্চতার সমান।
তবে এগুলোর আয়তন কত বড় সে সম্পর্কিত তথ্য ছাড়া এগুলো নিয়ে আর তেমন কোনো নিশ্চিত তথ্য জানা যায় না। যেমন সেগুলো কিভাবে গঠিত হয়েছে, এগুলো কী দিয়ে তৈরি এগুলো কিভাবে আমাদের গ্রহকে প্রভাবিত করে ইত্যাদি।
তবে যেটা মনে হয় তা হচ্ছে বিকৃতাকার এই কাঠামোগুলো পরের স্তরে গিয়ে ঠেকেছে যাকে বলা হয় ‘আউটার কোর’ বা বহিঃকেন্দ্র।
স্ক্রিস্টাল হার্ট বা স্ফটিকাকার হৃদয়
জুল ভার্ন-এর ক্লাসিক উপন্যাসে অধ্যাপক লিডেনব্রক পুরো একটি আলাদা ভূগর্ভস্ত দুনিয়ার সন্ধান পান যার মধ্যে রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক সময়ের প্রাণী এবং ভূগর্ভস্থ মহাসাগর।
যদিও ডাইনোসর থাকার বিষয়টি একটু অতিরঞ্জিতই ছিল কিন্তু তারপরও সেখানে গলিত ধাতুর সাগর যার গরম লাল স্রোত ধীরে ধীরে বয়ে চলেছে, ছড় এবং গলিত ধাতুর সাইক্লোন-সবই ছিল।
এই চলাচল একটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা যা ছাড়া পৃথিবীর উপরিভাগে জীবনের অস্তিত্ব সম্ভব নয়।
চৌম্বকীয় এই স্তর সূর্য্যরশ্মির ক্ষতিকর বিকিরণ এবং অন্য উপাদন থেকে রক্ষা করে। এটি না হলে পৃথিবীর বায়ুমন্ডল ধ্বংস হয়ে যেত। আর এরপর আমরা চূড়ান্ত স্তরে পৌঁছে যাবে যেটি ‘ইনার কোর’ বা ‘আন্তঃকেন্দ্র’ বলে পরিচিত। এটি এখনো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রহস্যের বিষয়।
এটি কঠির লোহা ও নিকেলের তৈরি অতিঘন একটি উত্তপ্ত বল যার উত্তাপ সূর্য্যের উপরিভাগের তাপের মতোই বলে ধরা হয়। এটি আকারে চাঁদের চেয়ে কিছুটা ছোট।
এর চাপ এতোই বেশি যে এর কারণে ধাতু স্ফটিকে পরিণত হয়ে পৃথিবীর কেন্দ্রে একটি নিরেট স্তর তৈরি করেছে। এটা এমন একটা স্তর যেখানে আমরা কখনোই পৌঁছাতে পারবো না।
এখানকার পরিবেশ এতো বেশি রুক্ষ (৬০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং চাপ তিন দশমিক পাঁচ মিলিয়ন অ্যাটমোস্ফিয়ার) যে সেখানে কোন কিছুই টিকতে পারবে না।
ধাতব সাগরে আটকে থাকা সেই স্ফটিক জগত সব সময়ই রহস্যময় ছিল এবং সম্ভবত সবসময় রহস্যই থাকবে।
ভূ-পৃষ্ঠ থেকে বিজ্ঞানীরা এটি নিয়ে গবেষণা করছেন এবং মাঝে মাঝেই মনে হয় যে আরো বেশি তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় হচ্ছে এগুলো এখনো খুব একটা বোঝা সম্ভব হয়নি। অবশ্য বিজ্ঞান আর কল্পনার তো মূলত কোন সীমা রেখা নেই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।