মোঃ মাসুদুর রহমান মনির : বিশ্ব মহাসাগর দিবস আজ (৮ জুন)। এবারের দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে- ‘নতুন গভীরতা জাগ্রত করুন’। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রাজধানী রিও ডি জেনিরোতে আয়োজিত বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলনে কানাডা কর্তৃক বিশ্ব সমুদ্র দিবসের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। ২০০৮ সালের ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৩তম অধিবেশনে গৃহীত ১১১ নম্বর প্রস্তাব অনুযায়ী ২০০৯ সাল থেকে দ্য ওসেন প্রজেক্ট এবং ওয়ার্ল্ড ওসেন নেটওয়ার্ক এর মাধ্যমে প্রতি বছরের ৮ জুন আন্তর্জাতিকভাবে বৈশ্বিক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দিবসটি পলিত হচ্ছে।
বাংলাদেশে ২০১৪ সাল থেকে দিবসটি কেন্দ্র করে নানা অংশগ্রহণমূলক উদ্যোগ নিয়ে আসছে সামুদ্রিক পরিবেশ ও অর্থনীতি বিষয়ক উদ্যোগ ‘সেভ আওয়ার সি’।
দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো- সাগর-মহাসাগর সম্পর্কে মানুষের সচেতনতা বাড়িয়ে তোলা। সাগর-মহাসাগরকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস। আমাদের অক্সিজেনের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা হলো এসব সাগর আর মহাসাগর। সমুদ্রের এই অবদান, আবেদন, প্রয়োজনীয়তা আর উপকারীতাকে স্বতন্ত্র্যভাবে বিশ্বের সবার সামনে তুলে ধরতে প্রতি বছর ৮ জুন পালন করা হয় বিশ্ব সমুদ্র দিবস।
দিনটি শুধুমাত্র সম্মানের জন্যই নয়, আমাদের সমুদ্রের সংরক্ষণ ও সুরক্ষার জন্য একটি অনন্য সুযোগ দেয়। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, মহাসাগর কমপক্ষে ৫০% অক্সিজেন উৎপাদন করে এবং এটিকে “পৃথিবীর জীবনরেখা” হিসাবেও অভিহিত করা হয়। মহাসাগরগুলি ৩০% এরও বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর প্রভাবগুলি হ্রাস করে। আমাদের স্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং আবহাওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ধরনের পণ্য ও পরিষেবাও তৈরি করে।
এছাড়াও সমুদ্র বৈশ্বিক অর্থনীতির চাবিকাঠি এবং আনুমানিক ৪০ মিলিয়ন লোক ২০৩০ সালের মধ্যে সমুদ্র-ভিত্তিক শিল্পে নিযুক্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার যে ক্রমান্বয়ে মানবসৃষ্ট দূষণ আর আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়ে চলছে এই মহান জলরাশিগুলি। বিজ্ঞানীরা জানান বিশ্বের প্রায় ১০ শতাংশ প্লাস্টিকজাত আবর্জনায় ভরে গেছে এই সব সমুদ্রের কোল। জাতিসংঘের পরিবেশ সমীক্ষার এক তথ্যমতে, সমুদ্রের প্রতি বর্গমাইলে ৫০ হাজার পর্যন্ত প্লাস্টিকের বোতল ভাসতে দেখা যায়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে তেল, কেমিক্যালসহ আরো নানা রকম বর্জ্য। সারা বিশ্বে আজ সমুদ্র ও উপকূলবর্তী উদ্ভিদ ও প্রাণীজগত বিপর্যয়ের মুখোমুখি।
সাগর ও মহাসাগর নিয়ে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক কার্যালয় একটি বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করেছে যার নাম ‘গ্রিন ইকোনমি ইন এ ব্লু ওয়ার্ল্ড’- এই প্রতিবেদনে বিশ্বের সমুদ্রগুলির এক করুণ অবস্থা ফুটে উঠেছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও কিছু দেশ সামুদ্রিক দূষণ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে অনেক চেষ্টা চালিয়েছে, তারপরও এ সমস্যা এখনও খুব গুরুতর।
বিশ্ব সমুদ্র দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বাণীতে বলেন, ” সমুদ্র আমাদের বেঁচে থাকার একটি ভিত্তি। যে বাতাসে আমরা শ্বাস নেই ও যে খাবার আমরা গ্রহণ করি তার যোগান দেয় এই সমুদ্র। সমুদ্রে রয়েছে আমাদের জলবায়ু ও আবহাওয়ার নিয়ন্ত্রণ। আমাদের গ্রহের জীববৈচিত্র্যের সর্ববৃহৎ আঁধার হল এই সমুদ্র। বিশ্বব্যাপী অগণিত জনগোষ্ঠী, প্রভূত সমৃদ্ধি ও মানব স্বাস্থ্য দীর্ঘস্থায়ী করার ক্ষেত্রে অবদান রাখে সমুদ্রের বহুবিধ সম্পদ। সমুদ্রের উপর পরম নির্ভরতায় রয়েছে মানব সম্প্রদায়।
আমাদের হওয়া উচিত সমুদ্রের পরম মিত্র। কিন্তু ঠিক এই মুহূর্তে মানব সম্প্রদায় হলো এর শত্রু। মানব-প্রভাবিত জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের গ্রহকে তাপ-দগ্ধ করে তুলছে, জলবায়ুর চিরাচরিত ধরন ও সমুদ্রস্রোত বাধাগ্রস্ত করছে এবং সমুদ্রতলের পরিবেশব্যবস্থা ও এতে বসবাসকারী বিভিন্ন প্রাণীর জীবন বদলে দিচ্ছে। অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ, সমুদ্র সম্পদের অতি ব্যবহার ও সমুদ্রে এসিডের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলশ্রুতিতে সমুদ্রতলের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। মোট মৎস্য সম্পদের এক-তৃতীয়াংশের ও বেশি এমন মাত্রায় আহরিত হচ্ছে যা এই সম্পদের দীর্ঘস্থায়ীত্বের অনুকূল নয়। আর আমরা বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ, প্লাস্টিক ও মানুষের মলমূত্র নিক্ষেপ করে সমুদ্র তীরবর্তী জলরাশি দূষিত করে তুলছি।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস লিখিত বার্তায় আরো বলেন, মহাসাগরের অ্যাসিডিফিকেশন প্রবাল প্রাচীরকে ধ্বংস করছে, খাদ্য শৃঙ্খলের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ ভেঙে দিচ্ছে এবং হুমকি দিচ্ছে পর্যটন এবং স্থানীয় অর্থনীতিতে। এবং টেকসই উপকূলীয় উন্নয়ন, অতিরিক্ত মাছ ধরা, গভীর সমুদ্রে খনন, নিয়ন্ত্রণহীন দূষণ এবং প্লাস্টিক বর্জ্য সারা বিশ্ব জুড়ে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে ধ্বংস করছে। তবুও আশার আলো আছে।
প্লাস্টিক দূষণের অবসানের জন্য একটি আইনত বাধ্যতামূলক চুক্তিটি সমুদ্র রক্ষার আমাদের ভাগ করা লক্ষ্যকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ। সাগর আইনের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের সাম্প্রতিক মতামত আরেকটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সামুদ্রিক দূষণ হ্রাস, নিয়ন্ত্রণ এবং প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিতে দেশ গুলিকে আহ্বান জানানো হয়েছে।
এ বছরের সামিট অফ দ্য ফিউচার এবং পরের বছর ফ্রান্সে জাতিসংঘের মহাসাগর সম্মেলন আমাদের মূল্যবান সামুদ্রিক এবং উপকূলকে পুনরুদ্ধার ও রক্ষা করতে পারে এমন পদক্ষেপের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার এখন সময় এসেছে আমাদের সমুদ্র রক্ষায় সরকার, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী, বিজ্ঞানী এবং সম্প্রদায়ের একত্রিত হওয়ার। দিবসটির উদ্দেশ্য হল সমুদ্রে মানুষের ক্রিয়াকলাপের প্রভাব সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করা, সমুদ্রের জন্য নাগরিকদের একটি বিশ্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলা এবং বিশ্বের সমুদ্রের টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য একটি প্রকল্পে বিশ্বের জনসংখ্যাকে একত্রিত করা।
এই বিশ্ব সমুদ্র দিবসে আসুন আমরা এ সংশ্লিষ্ট কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আসুন, প্রতিটি দিন আমরা সমুদ্রকে অগ্রাধিকার দিই এবং আমাদের সমুদ্রের জন্য কর্মের নতুন গভীরতা জাগ্রত করি।
আমাদের বাংলাদেশের গর্ব অন্যতম পর্যটন আকর্ষণ বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র-সৈকত কক্সবাজার এবং পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকত যেখানে একই স্থান থেকে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত অবলোকন করা যায়। আমরা ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায় দেশের এ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দুটি দূষিত করে ফেলছি। আসুন আমরা আরেকটু সচেতন হই এবং দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করি। প্রয়োজনে সমুদ্র-সৈকতে আমাদের ট্যুরিস্ট পুলিশের সহায়তা নিই।
লেখক: অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার, ওয়ারী বিভাগ, ডিএমপি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।