জুমবাংলা ডেস্ক : গ্রামে যোগাযোগ ব্যবস্তা উন্নত হওয়ায় কমতে শুরু করেছে নৌকার চাহিদা। কম চাহিদার কারণে কদর কমেছে নৌকা তৈরির কারিগরদের। দিন দিন ঘনিয়ে আসছে তাদের দুর্দিন। তবে মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের বাড়ৈখালি ইউনিয়নের শিবরামপুরে ইছামতী নদীর তীরে ২০০ বছর ধরে বসে কোষা নৌকার হাট। সপ্তাহের প্রতি শনিবার বিভিন্ন সাইজের কোষা নৌকার পসরা সাজিয়ে বসেন নৌকা বিক্রেতারা। সপ্তাহে দুই শতাধিক নৌকা বিক্রি হয় এ হাটে। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাঁকডাকে মুখরিত হয়ে ওঠে প্রাচীন এই হাট।
মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর ও সিরাজদিখানের ইছামতি নদী এবং আড়িয়ল বিলকেন্দ্রিক জীবনযাত্রায় এক সময় মানুষের চলাচলের একমাত্র ভরসা ছিল কোষা নৌকা। কিন্তু এখনো বর্ষা এলেই এই দুই উপজেলায় নৌকা-বিশেষত কোষা তৈরির ধুম পড়ে। নৌকার কারিগরদের দম ফেলার ফুসরত থাকে না। নৌকা বানাতে ব্যস্ত সময় পার করেন তারা। মেহগনি, কড়ই, আর চাম্বল কাঠের পাশাপাশি মাটিয়া তেল, আলকাতরা, তারকাটা, গজালের পসরা এখন জমে উঠেছে। কারণ এসব কাঠ, আলকাতরা আর তেলই হচ্ছে নৌকা তৈরির প্রধান উপকরণ।
উপজেলার নিচু অঞ্চলের বাসিন্দাদের বর্ষায় যাতায়াতের একমাত্র ভরসা কোষা নৌকা। সে জন্যই মুন্সীগঞ্জ সিরাজদিখান উপজেলার সিরাজদিখান বাজার, ইছাপুরা বাজার, তালতলা বাজার ও ভবানিপুর গ্রামে নৌকা তৈরি ও বিক্রি ধুম পড়ে। বর্ষায় জমিতে কৃষিকাজ না থাকায় বছরে তিন/চার মাস নৌকা তৈরি ও বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন শত শত পরিবার। বর্ষা শেষে এ কারিগররা কাঠমিস্ত্রি ও আসবাপত্র তৈরির কাজ করেন।
নৌকার চাহিদা পূরণে ঐতিহ্যবাহী শিবরামপুরের হাটে বৃটিশ আমল থেকেই সপ্তাহে একদিন বসে নৌকার হাট। পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ধরে রাখতেই নৌকা নিয়ে হাটে আসেন জানালেন নৌকা বিক্রেতারা। এই হাটে ৩ হাজার টাকা থেকে ৫ হাজার টাকায় নৌকা বিক্রি হয়। তবে নৌকা বিক্রি করে এখন আর তেমন লাভ হয় না বলে জানান বিক্রেতারা। আগের মত বহতা নেই ইছামতী নদীর। জৌলুস হারিয়েছে আড়িয়ল বিল। আশপাশের জলাশয় ভরাট করে ফেলায় কমেছে নৌকার চাহিদা। এ কারণে ভালো নেই নৌকা তৈরির কারিগররা।
একটা সময় পাল তোলা নৌকার কদর ছিল বেশ। উপজেলা জুড়ে চলত বাহারি পালতোলা নৌকা। এছাড়াও হাট-বাজার থেকে পণ্যসামগ্রী ও জমি থেকে ধান-পাট কেটে আনা-নেওয়ায় ডিঙ্গি নৌকা বা কোষার ব্যবহার হতো। এছাড়াও এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হতো কোষা নৌকা। তবে রাস্তাঘাট হয়ে যাওয়ায় এখন রকমারি সব নৌকার ব্যবহার উঠে গেছে। এতকিছুর পর এখনও গ্রামীন জীবনে কদর রয়েছে কাঠের তৈরি জলযানটির। বর্ষার পানিতে গ্রামীন জনপদের খাল-বিল ও বাড়ির চারপাশ যখন পানি থৈ থৈ করে তখন কোষা নৌকার মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত করেন বাসিন্দারা। পুরো বর্ষা মৌসুমে নদ-নদী আর খাল-বিলে নৌকায় করে দিনরাত মাছ শিকারে ব্যস্ত হয়ে পরেন জেলেরা।
নবাবগঞ্জ ভাঙ্গাভিটা গ্রামের কোষা নৌকা বিক্রেতা চাঁন গোপাল মন্ডল বলেন, ‘২০০ বছরের বেশি হইবো এখানে হাঁট বসে। আমার বাপ-দাদারা এ হাটে নৌকা বিক্রি করছে। আমরাও এ হাটে নৌকা বিক্রি করতে আইছি। আগে নৌকা বানানোর লোক কম আছিলো। এখন লোক হইয়া গেছে বেশি। নৌকা বিক্রি হয় ৫০টা, লইয়া আসে ১০০টা। ৫০টা থাইক্কা যায়। পানি কইমা যাওয়ায় দাম কইমা গেছে। এখন নৌকা বানাইতে খরচ হয় ২৫০০ টাকা, কাষ্টমার আইয়া বলে ১৫০০ টাকা। রোজের টাকা উঠাতে কষ্ট হইয়া যায়।’
কোষা নৌকা বিক্রেতা নুরুল হক বলেন, ‘নবাবগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলা থেকে অনেকেই এই হাটে কোষা নৌকা কিনতে ও বিক্রি করতে আসে। কোষা বেশি আসে সিরাজদিখানের শেখেরনগর গ্রাম, সিরাজদিখান বাজার, ইছাপুরা বাজার, তালতলা বাজার ও ভবানিপুর গ্রাম থেকে। এছাড়াও নবাবগঞ্জের বাগমারা, ভাঙ্গাভিটা এলাকা থেকেও আসে অনেকে। তবে সব জায়গায় রাস্তাঘাট হয়ে যাওয়ায় এখন আর তেমন কোষা কিনতে আসে না কাষ্টমাররা। বড় একটা কোষা বানাতে ৪-৫ হাজার টাকা লাগে, কাষ্টমার ২-৩ হাজার টাকার বেশি বলে না।’
আরেক কোষা নৌকা বিক্রেতা আজম শেখ বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২০০ কোষা বিক্রি হয় এ হাটে। পানি কমে যাওয়ার কারণে কোষা বিক্রি কমে গেছে। পানি বেশি হলে কোষা বিক্রিও বেড়ে যায়, লাভ হয়।’
সিরাজদিখান উপজেলার মধ্যপাড়া ইউনিয়নের মধ্যপাড়া গ্রামের কোষা তৈরির কারিগর কৃষ্ণ মন্ডল ৩২ বছর ধরে নৌকা তৈরি করে আসছেন। বৃদ্ধ এ কারিগর বলেন, ‘এবার পানি না থাকায় কোষা বিক্রি কমে গেছে। এখন চাম্বল আর কড়ই কাঠের নৌকা বানাই। সাধারণত ৮-১২ হাত দৈর্ঘে্যর নৌকা তৈরি করে থাকেন। তবে কেউ অর্ডার করলে অনেক বড় নৌকা বানানোর চুক্তিও করি।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।