ড. এ কে এম শামছুল হক ছিদ্দিকী : জাপানের বিখ্যাত ইয়াকোহামা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মাসারু ইমোটো ও জার্মানির একজন খ্রিষ্টান ডাক্তার কে এন পিফিপার জমজমের পানি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেছেন, জমজমের পানি হলো আকরিক পদার্থ। এক ফোঁটা জমজমের পানিতে যে পরিমাণ আকরিক পদার্থ থাকে তা পৃথিবীর অন্য কোনো পানিতে থাকে না।
অপরিবর্তনীয় গুণমান : জমজমের পানির গুণগত মান কখনো পরিবর্তিত হয় না। এ পানি আজীবন একই গুণমানে পৃথিবীকে তৃপ্ত করে যাবে।
অণুজীবহীন : সাধারণ কূপের পানিতে জলজ উদ্ভিদ জন্মালেও জমজমের পানিতে কোনো জলজ উদ্ভিদ বা অন্যান্য উদ্ভিদজাত অণুজীব নেই।
মিনারেলের মাত্রা অধিক : জমজমের পানিতে যেসব আকরিক পদার্থ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ক্যালসিয়াম, ফ্লোরাইড, সোডিয়াম, সালফেট, নাইট্রেট, ম্যাগনেসিয়াম ও পটাশিয়াম উল্লেøখযোগ্য। ফ্লোরাইড ছাড়া বাকি মিনারেলগুলোর মাত্রা অন্য সব স্বাভাবিক খাবার পানিতে পাওয়া মাত্রা থেকে বেশি ছিল।
পানির পিএইচ ও ঝুঁকিমুক্ত মাত্রা : জমজমের পানির পিএইচ হচ্ছে ৭ দশমিক ৮। এ পানি আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম সিসা এবং মেলেনিয়ামের মতো ক্ষতিকর পদার্থগুলো থেকে ঝুঁকিমুক্ত।
পানিতে স্ফটিক সৃষ্টি : জমজমের পানির এমন এক ব্যতিক্রমধর্মী মৌলিক আকার রয়েছে যেটি খুবই চমকপ্রদ। পানিতে একটি আরেকটির উপরে দু’টি স্ফটিক সৃষ্টি হয় ও সেগুলো একটি অনুপম আকার ধারণ করে।
মানুষের কোষে দৈনন্দিন পান করা পানির চেয়ে জমজমের পানির ইতিবাচক প্রভাব অনেক বেশি। জমজমের পানির অণুগুলো বিশ্বের অন্যান্য পানির তুলনায় সবচেয়ে সুন্দর ও ভারসাম্যপূর্ণ। জমজমের পানির সমপরিমাণ কনটেন্ট বিশ্বের আর কোনো পানিতে নেই। জমজমের পানিতে প্রচুর নিরাময় শক্তি রয়েছে। যদি নিয়মিত এই পানির ওপর কুরআন পাঠ করা হয় তাহলে এটি সব ব্যাধির চিকিৎসার ক্ষমতা লাভ করে।
আরবি ভাষায় ‘জমজম’ অর্থ অঢেল পানি। আর হিব্রু ভাষায় ‘জমজম’ অর্থ ‘থাম থাম’। অনেকের ধারণা, এ থেকেই এর নাম ‘জমজম’ হয়েছে। আরব্য ঐতিহাসিকদের মতে, ‘জমজম’ অর্থ অধিক হওয়া। এখানে পানির আধিক্যের কারণেই এর নামকরণ করা হয়েছে ‘জমজম’। গবেষকরা মনে করেন, ‘জমজম’ অর্থ সমবেত হওয়া। হাজেরা আ: ডানে-বাঁয়ে পানির প্রবাহ রোধ করে মাটির বাঁধ দিয়ে পানি সঞ্চিত করে রেখেছেন বলেই একে ‘জমজম’ বলা হয়।
ইসলামের ইতিহাসে জমজম কূপের উৎপত্তি নিয়ে বর্ণনা রয়েছে। নবী ইবরাহিম আ: তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী হাজেরা আ: ও ইসমাইল আ:-কে আল্লাহর আদেশে মক্কার বিরান ভূমিতে রেখে আসেন। সামান্য পানি ও কিছু খেজুর তিনি তাদের দিয়ে আসেন। যাওয়ার সময় আল্লাহর কাছে দোয়া করে বলেছিলেন, ‘হে প্রভু! জনমানবহীন মরুপ্রান্তরে তোমার পবিত্র ঘরের কাছে আমার সন্তানকে রেখে গেলাম; যেন তারা সালাত কায়েম করে। আর তাদের প্রতি তুমি মানুষের অন্তরকে ধাবিত করে দিও এবং তাদেরকে ফল-ফলাদি দিয়ে রিজিক দান করিও; যেন তারা তোমার শোকরগোজার হয়।’ (সূরা ইবরাহিম, আয়াত-৩৭)
হজরত ইবরাহিম আ: চলে যাওয়ার সময় অসহায় স্ত্রী বিবি হাজেরা আ: পেছন থেকে বারবার কাতর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন; আপনি এ জনমানবহীন প্রান্তরে আমাদের একা রেখে কোথায় যাচ্ছেন? ইবরাহিম আ: নির্বিকার; তিনি কোনো উত্তর দেননি। অবশেষে স্ত্রী বললেন, আপনি কি আল্লাহর কোনো নির্দেশ পেয়েছেন? মাথা নেড়ে শুধু বললেন, হ্যাঁ। আল্লাহর নির্দেশের কথা জানতে পেরে হাজেরা আ: খুশি মনে বললেন, তিনি আমাদের ধ্বংস হতে দেবেন না।
ইবরাহিম আ:-এর রেখে যাওয়া খাদ্য, পানীয় শেষ হয়ে গেলে হাজেরা আ: পানির সন্ধানে পার্শ^বর্তী সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে সাতবার ছোটাছুটি করেছিলেন। কোনো পানির সন্ধান না পেয়ে আল্লাহর সাহায্যের প্রার্থনা করেন। আল্লাহর তাঁর প্রার্থনা কবুল করেন। তখন তিনি ফিরে গিয়ে দেখতে পেলেন, ইসমাইল আ: মতান্তরে জিবরাইল আ:-এর পায়ের আঘাতে মাটি ফেটে পানির ধারা বেরিয়ে এসেছে। হাজেরা আ: এ দৃশ্য দেখে পাথর দিয়ে পানির ধারা আবদ্ধ করলে তা কূপের রূপ নেয়।
পানির পিপাসায় ক্লান্ত-শ্রান্ত মা হাজেরা আ: চোখ জুড়ানো স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা দেখে সীমাহীন আনন্দিত হলেন। তাঁর চোখে তখন যেন খুশির দ্যুতি চমকাচ্ছিল। তিনি আল্লাহর শুকরিয়া করে সে পানি পান করলেন এবং ছেলেকে পান করালেন। সেটিই পরবর্তী সময় জমজম কূপ নামে পরিচিতি লাভ করে।
হাজেরা আ: জমজমের নালায় খেজুরের বীজ বুনে দিলেন। বরকতি পানির ছোঁয়া পেয়ে অল্প দিনেই গাছ বড় হয়ে গেল ও ফল ধরতে শুরু করল। ধূ-ধূ মরুপ্রান্তরে প্রকৃতির সবুজ অরণ্যের খোঁজ পেয়ে বিভিন্ন ধরনের পাখি এসে বাসা বাঁধল হাজেরা আ:-এর লাগানো খেজুর গাছের ডালে। জুরহম গোত্র বাণিজ্যিক কাজে এ পথ ধরে শাম যাচ্ছিল। আকাশে পাখির ওড়াউড়ি দেখে ভাবল; আশপাশে নিশ্চয় কোথাও পানির ঝরনা আছে। খুঁজতে খুঁজতে তারা হাজেরা আ:-এর কাছে পৌঁছল। এমন সুন্দর পরিবেশে মুক্ত হয়ে তারা হাজেরা আ:-এর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সেখানেই স্থায়ী বসবাস শুরু করে। ইসমাইল আ: সেখানেই বেড়ে ওঠেন ও পরবর্তী সময় জুরহম গোত্রের এক নারীকে বিয়ে করেন।
এভাবে কাটল অনেক বছর। ততদিন পর্যন্ত মক্কা নগরীর শাসন কর্তৃত্ব ও জমজম কূপের দখলদারি জুরহম গোত্রের হাতেই ছিল। কিন্তু পবিত্র মক্কা নগরীতে জনগণের আমোদ-প্রমোদের প্রসার ঘটে। এমনকি তারা কাবাঘরের বিভিন্ন মালামাল লুণ্ঠন ও চুরি করতে শুরু করে এবং নানা পাপাচারে লিপ্ত হয়। তখন আল্লøাহর গজব নেমে আসে। ফলে একসময় জমজম কূপের পানি শুকিয়ে যায়। এদিকে জুরহম গোত্রের উদাসীনতা ও চারিত্রিক দুর্বলতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে খোঁজয়া গোত্র জুরহম গোত্রকে আক্রমণ ও ক্ষমতা ছিনিয়ে নেয়ার হুমকি দিচ্ছিল।
জুরহম গোত্রের সরদার ইবনে আমর কাবা শরিফের জন্য হাদিয়া স্বরূপ স্বর্ণ দিয়ে দু’টি হরিণ ও কয়েকটি তলোয়ার তৈরি করেছিলেন। তিনি যখন নিশ্চিত হলেন যে, শিগগিরই খোঁজয়া গোত্র আক্রমণ করবে এবং তিনি তাদের কাছে পরাজিত হয়ে ক্ষমতা হারাবেন, তখন খোঁজয়া গোত্র যেন তার সোনার তৈরি হরিণ ও তলোয়ারের অধিকারী না হতে পারে তাই তিনি সেগুলোকে জমজম কূপে নিক্ষেপ করে মাটি দিয়ে তা ভরাট করে ফেলেন। হঠাৎ একদিন সত্যিই খোঁজয়া গোত্র আক্রমণ করল এবং জুরহম গোত্র তাদের কাছে পরাজিত হয়ে দেশত্যাগ করে ইয়েমেনে চলে গেল। সে থেকে ৫০০ বছর পর্যন্ত জমজম কূপটি অজ্ঞাত অবস্থায় পড়ে থাকে। কেউ তার সন্ধান দিতে পারেনি।
নবী করিম সা:-এর চতুর্থ ঊর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ কুসাই বিন কিলাবের শাসন কর্তৃত্ব অর্জন করার আগ পর্যন্ত মক্কা নগরী খোঁজয়া গোত্রের দখলে থাকে। পরবর্তীতে কুসাই বিন কিলাব থেকে শাসনভার চলে আসে রাসূল সা:-এর দাদা আবদুুল মুত্তালিবের হাতে। তখন আবদুুল মুত্তালিব জমজম কূপ অনুসন্ধানে আগ্রহী ও উদ্যোগী হন এবং তার পুত্র জায়েদকে সাথে নিয়ে অনুসন্ধান অব্যাহত রাখেন। এক রাতে তিনি স্বপ্নে জমজম কূপের নিশানা খুঁজে পান এবং কূপটি দেখতে পান। স্বপ্নের চিহ্ন অনুযায়ী তিনি তার আরেক পুত্র হারেসকে সাথে নিয়ে কূপ খনন কার্য শুরু করেন। খননকালে জুরহম গোত্রের পুঁতে রাখা সোনার তৈরি হরিণ ও তলোয়ার আবদুুল মুত্তালিবের হাতে চলে আসে। তিনি সেগুলো দিয়ে পবিত্র কাবাঘরের দরজা নির্মাণ করেন। তখন থেকে আবার মানুষ কাবাঘর ও জমজম কূপের যত্ন নিতে শুরু করেন। (সিরাতে ইবনে হিশাম-১/৪৫ তারিখে ইয়াকুবি-১/২০৬)
বর্তমানে জমজম কূপের গভীরতা ৫১ ফুট। দু’জন ডুবুরি তলদেশে গিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেন, সেখানে রঙ-বেরঙের মাটির স্তর জমাট বেঁধে আছে। আর অবিরাম নির্গত পানিকে পরিশোধন করছে। তারা আল্লাহর এ কুদরত দেখে বিস্মিত হয়ে যান।
পবিত্র জমজম নিয়ে রাসূল সা:-এর বহু হাদিস রয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: থেকে বর্ণিত- মহানবী সা: ইরশাদ করেছেন, ‘পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ পানি হলো জমজমের পানি। তাতে রয়েছে তৃপ্তির খাদ্য ও ব্যাধির আরোগ্য।’ (আল মুজামুল আউসাত, হাদিস-৩১২)
লেখক : অধ্যাপক, আরবি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।