তিনি গত সাত মাস থেকে নিথর দেহ নিয়ে এখোন বাড়িতে পড়ে আছেন। প্রথমদিকে যা অর্থ ছিল তাই দিয়ে তার স্বামী ও বড় ছেলের চিকিৎসা করিয়েছেন আরতি রানী রবিদাস। কিন্তু পরে আর অভাবের কারণে ছোট ছেলের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেনি তিনি। সেই থেকে বিনা চিকিৎসায় ঘরে পড়ে রয়েছেন তারা ছোট ছেলে। একদিকে অর্থাভাবে চিকিৎসার অভাবে চোখের সামনে তিলে তিলে সন্তানের মৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়া আর অন্যদিকে সংসারের অভাব অনটন তার জীবনে নেমে এসেছে অমানিশার অন্ধকার।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কালাই উপজেলার পুনট ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের পুনট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যলয়ের সন্নিকটে কয়েকটি ঘর নিয়ে রবিদাস সম্প্রদায়ের বসতি আছেন। তারই মধ্যে হাফ শতকের উপরে ভাঙ্গা দুটি ঝুপরি ঘরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিধবা আরতি রানী ও অজানা রোগে আক্রান্ত হওয়া তার এক ছেলে নিয়ে খুব কষ্টে জীবন-যাপন করছেন।
সেখানে দেখা হলো বিধবা আরতি রানী রবিদাসের সঙ্গে। তাকে সাংবাদিকের পরিচয় দিলে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, এক সময় স্বামী মতিলাল রবিদাস ও দুই ছেলে শ্রী সজল রবিদাস, শ্রী সহোদেব রবিদাস নিয়ে আমাদের সংসার খুব ভালোভাবে চলছিল। আমার স্বামী পুনটহাটে জুতো সেলাই করে আমাদের সংসার চলত। এক অজানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে হঠাৎ করে আমার স্বামী মারা যায়। প্রাথমিক ভাবে ঐ অজানা রোগের লক্ষণীয় বিষয়গুলো ছিলো- প্রথমে তার শরীরে অসম্ভব ঝাঁকুনি বা কাঁপুনি ছিল। সে চলাফেরার সময় তার শরীর কাঁপতো। তার হাত-পা সবসময় অবশ হয়ে থাকত। সে কোন কিছু ধরতে ও ঠিকমত চলাচল করতে না পেরে প্রতিবন্ধী মতো হয়ে থাকত। তার মুখ বাঁকা হত এবং কথাগুলো ছিলো অস্পষ্ট। কোন কিছু ঠিক মতো খেতে পারতন তিনি। তার স্বাস্থ্য ধীরে ধীরে অনেক খারাপ হচ্ছিল। অন্যেও সাহায্য ছাড়া তিনি খাওয়া দাওয়া, চলাফেরা ও প্রসাব-পায়খানা কিছুই করতে পারতেন না।
ঐসব কারণে তার পেশাগত জুতা মেরামতের কাজ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। আর সেই থেকে আমাদের সংসারে এলো অনেক অভাব-অনটন। তখন আমি বাধ্য হয়ে অন্যের বাড়িতে ঝি এর কাজ করে স্বামী ও দুই সন্তানসহ মোট চারজনের পেটের ভাত কোন মতে জোগার করতাম। সেই অবস্থায় টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় আমার স্বামী মারা যান। স্বামীর মৃত্যুর কিছু দিন পরই আমার বড় ছেলে শ্রী সজল রবিদাসের একই ধরণের লক্ষণ দেখা দেয়। আমার কাছে জমানো কিছু অর্থ এবং আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার দেনা করে এলাকার বিভিন্ন চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হলেও মোটা অর্থাভাবে তাদের পরামর্শ মোতাবেক স্বাভাবিক চিকিৎসাসহ কিছু পরীক্ষা করানো আর সম্ভব হয়নি। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ২৮ তারিখে আমার বড় ছেলে সজল রবিদাস মারা যান। আবার সেই রোগের উপসর্গ দেখা দিয়েছে আমার ছোট ছেলে শ্রী সহোদেব রবিদাসের শরীরে। বর্তমান আমার দু’চোখে যেন আঁধারে ঢেকে আসছে। স্বামীর হাফ শতকের উপরে ভাঙ্গা বাড়ি ছাড়া আমার কোন সম্পদ নেই। সরকারি-বেসরকারি ভাবে কোন সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছি না, কেউ খোঁজ-খবরও নেয়নি। আমি কোন কুল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিনা। কী করব এই ছেলেকে নিয়ে। সংসার ও ছেলেকে নিয়ে অনেক বিপদে আছি। চিকিৎসা তো দূরের কথা অসুস্থ ছেলের মুখে ভাত যোগার করাই আমার পক্ষে অসম্ভব হচ্ছে। কোনমতে এদিক সেদিক ভাবে ছোট খাটো কাজ করে পেটের ভাত যোগার করতে হচ্ছে। আবার কখন-বা নিকটজনের দয়া-দক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করে চলতে হচ্ছে। এই সব বলার শেষে না হতেই তিনি হাউ-মাউ করে কেঁদে উঠলেন।
অজানা রোগে আক্রান্ত হওয়া শ্রী সহোদেব রবিদাস (১৪) ভাঙ্গা ভাঙ্গা ভাষায় বলেন, এই রোগ থেকে বাঁচতে চাই। এই রোগে আমার বাবা ও বড় ভাই মারা গেছে। ভালো হয়ে লেখা-পড়া করে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশ ও মানুষের জন্য অনেক সেবা করতে চাই। সরকার, কোন সংস্থা বা কোন সহৃদয়বান ব্যক্তির সহায়তা ছাড়া এখন আর আমাদের কোন পথ নেই। আশা করি কেউ না কেউ এগিয়ে আসবেন আমার সু-চিকিৎসার জন্য।
বিধবা আরতি রানী রবিদাসের এক প্রতিবেশী শ্রী স্বাধীন বলেন, এক সময় সুন্দর চলছিল তাদের সংসার। হঠাৎ করে এক অজানা রোগে অসুস্থ হয়ে আরতি রানীর স্বামী, বড় ছেলে মারা যায়। আবার ঐরোগের উপসর্গ দেখা দিয়েছে তার ছোট ছেলের। এখন তারা খুবই অসহায়।
উপজেলার পুনট ইউনিয়ন পরিষদের ৫নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আব্দুল রাজ্জাক বলেন, সরকারি ও ব্যক্তিগত তহবিল থেকে আরতি রানীর পরিবারকে অর্থ এবং খাদ্য সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে।
কালাই উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. মোবারক হোসের পারভেজ বলেন, আমাদের কাছে তারা আসলে তার ছেলের চিকিৎসা বিষয়টি উপজেলা প্রশাসন পক্ষ থেকে নিয়ম অনুযায়ী আর্থিক সহযোগিতা করা হবে।
সূত্র : ইত্তেফাক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।