আন্তর্জাতিক ডেস্ক : পলিভিনাইল ক্লোরাইড বা সামান্য পিভিসি পাইপ দিয়ে অসাধ্যসাধন করে ফেলেছেন ডাচ শিল্পী। তাঁর শিল্পের নমুনা দেখতে হলে যেতে হবে সেই সমুদ্রতটে। যেখানে অতিকায় সব কৃত্রিম প্রাণী দাপিয়ে ঘুরছে সমুদ্রতট বরাবর। বাইরে থেকে বিনা ইন্ধনে কী ভাবে দিব্য হেঁটে চলে বেড়ানো সম্ভব হচ্ছে? মুগ্ধ দর্শকদের প্রশ্ন এখন এটাই।
ডাচ শিল্পী থিয়ো জানসেন। পেশায় পদার্থবিদ, নেশায় শিল্পী। তিনি বলেন, ‘‘শিল্প আর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মধ্যে কোনও দেওয়াল নেই। যা আছে তা আমাদের মনে।’’ এ হেন শিল্পীই আমূল বদলে দিয়েছেন সমুদ্রতটে বেড়ানোর অভিজ্ঞতাকে।
নেদারল্যান্ডসের স্কেভেনিনজেনের সমুদ্রতট আপাতত ‘বিচ বিস্টের’ দখলে। প্লাস্টিকের জলের পাইপ দিয়ে তৈরি এই অতিকায় কাঠামো কেবল যে দাঁড়িয়ে আছে তা-ই নয়, রীতিমতো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত।
শিল্পী জানিয়েছেন, একে প্রাণী না বলে প্রাণীর কঙ্কাল বলা ভাল। মানুষ নিজের খুশি মতো এর অবয়ব ভেবে নেবেন। কিন্তু এই কৃত্রিম প্রাণীর কঙ্কাল দৌড়ে বেড়াচ্ছে কোন জাদুতে? শিল্পী জানাচ্ছেন, স্রেফ বাতাস হজম করেই দৌড়চ্ছে ‘বিচ বিস্ট’।
এমন ভাবে কাঠামো তৈরি করা হয়েছে যাতে সমুদ্রতটের প্রবল বাতাসের ধাক্কায় দিব্য নড়াচড়া করতে পারে এগুলো। যেমন ভাবা তেমন কাজ। ১৯৯০ নাগাদ প্রথম এ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে শুরু করেন থিয়ো।
এই কৃত্রিম প্রাণীগুলোকে তৈরি করা হয়েছে আশপাশের পরিবেশের সঙ্গে মানানসই করে। যাতে কোনও অবস্থাতেই তাদের মাধ্যমে দৃশ্যদূষণের কোনও সম্ভাবনা না থাকে এবং অনায়াসে তারা সমুদ্রতট দাপিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে।
ব্যাপারটি যে এমন আকর্ষক হয়ে উঠবে, তা অবশ্য প্রথম দিকে ভাবতেও পারেননি থিয়ো। উল্টে এই কাঠামোকে অন্য কোনও উপায়ে সমুদ্রতটে ভূমিক্ষয়রোধী করে তোলা যায় কি না, তা নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন থিয়ো।
কবে প্রথম তাঁর মাথায় এমন কল্পনা এল? এই প্রশ্নের উত্তরে থিয়ো বলেন, ‘‘আমি নেদারল্যান্ডসের সংবাদপত্রে কলাম লিখতাম। ১৯৯০ সালে সমুদ্রতটে কঙ্কাল নিয়ে লিখে খুব মজা পেয়েছিলাম। আমার ভাবনা ছিল, কঙ্কালগুলোর আশেপাশে বালি আটকে বালিয়াড়ি তৈরি হবে। এতে সমুদ্রের এগিয়ে আসা রোধ করা যাবে। তবে গোটাটাই আমার কল্পনা ছিল।’’
তার পর থেকেই শুরু হয় বিচ বিস্ট নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা। কেমন হবে কাঠামো। কী ভাবে বাতাসের ধাক্কায় এত বড় চেহারা নিয়ে তারা দৌড়বে তা ঠিক করতেই সময় যায় অনেক। কিন্তু এরই মধ্যে আবিষ্কারের নেশা ভর করেছে পদার্থবিদ থিয়োর মাথায়।
গ্রীষ্মকালটা সমুদ্রতটেই কাটান আদতে স্কেভেনিনজেনের বাসিন্দা থিও। গত প্রায় দু’দশক ধরে তিনি বিস্ট নিয়ে গবেষণা করছেন শিল্পী। এ ক্ষেত্রে তাঁকে সহায়তা করেছে নিজের পদার্থবিদ্যার জ্ঞান। দৈর্ঘ্যের অনুপাতও নিখুঁত ভাবে পরিকল্পনা করেছেন।
কী ভাবে হাঁটছে বা উড়ছে বিস্ট? থিয়ো জানিয়েছেন, প্রত্যেকটি বিচ বিস্টের মধ্যে রয়েছে একটি করে ‘মেরুদণ্ড’। যার গতি চক্রাকার। হাওয়া গিলে সেই চক্রাকার সঞ্চালনই হাঁটার কাজ করে। হাওয়ার বেগের তারতম্যের উপর নির্ভর করে বিস্ট কখনও দৌড়য়, কখনও আবার উড়ে যায়।
থিয়ো ব্যাখ্যা করেছেন সেই প্রযুক্তি। তিনি বলেন, ‘‘একটি দণ্ডের গতি সরলরৈখিক। কিন্তু চক্রাকার মেরুদণ্ডের গতি তো তেমন নয়। তা হলে উপায়? এ ক্ষেত্রে মেরুদণ্ডের চক্রাকার গতিকে সরলরৈখিক গতিতে রূপান্তরিত করা হয়। অর্থাৎ উপরের কাঠামো হাওয়া থেকে টানা শক্তি মেরুদণ্ডে পাঠায়। চক্রাকার গতি তার পর রূপান্তরিত হয় সরলরৈখিক গতিতে। আর পা ফেলে ফেলে এগিয়ে চলে বিস্ট।’’
নির্মাণশৈলির দক্ষতায় বিস্ট হয়ে উঠেছে বুদ্ধিমান। বিস্টগুলো ভুলেও সমুদ্রে নেমে যায় না। অতিরিক্ত যন্ত্র বা পিস্টনের সাহায্যে কতটা হাওয়া গ্রহণ করা ঠিক হবে, তা-ও নির্দিষ্ট করা আছে। ফলে, আক্ষরিক অর্থে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ না করেও বুদ্ধিমানের মতোই আচরণ করে কৃত্রিম প্রাণীগুলোর কঙ্কাল। এমনকি সমুদ্রতটে বায়ুর গতি কম থাকলেও সঞ্চয় করে রাখা ইন্ধনেই সে এগিয়ে যাবে পায়ে পায়ে।
সমুদ্রপৃষ্ঠের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা রুখতে প্রথম যে উদ্ভাবনের ধারণা জন্ম, তা আদতে হয়ে উঠেছে বহুমুখী এক হাতিয়ার। সমুদ্রতট দাপিয়ে বেড়ানো স্ট্র্যান্ড বিস্ট বা বিচ বিস্ট পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে যেমন সফল তেমনই বায়ুশক্তি সঞ্চয় করে রাখার পাশাপাশি জোয়ার-ভাটার দিকে নজর রাখা এমনকি আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস দেওয়ার সঙ্গেই ঝড় ঠেকাতে দেওয়ালের মতোও কাজ করে।
কিন্তু তাঁর এই উদ্ভাবন মানবসভ্যতার বিকাশে কী কাজে লাগবে? এ ব্যাপারেও স্পষ্ট ধারণা আছে থিয়োর। তিনি জানিয়েছেন, হয়তো তাঁর এই কাজ দেখে কেউ সত্যিই বানিয়ে ফেলবেন এমন পরিবেশবান্ধব কোনও কৃত্রিম প্রাণী, যা বিনা ইন্ধনে পরিবেশ রক্ষার কাজ করে যাবে। মূলত, আগামী প্রজন্মকে ভাবনার খোরাক জোগাতেই নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্ধাবনকে উৎসর্গ করেছেন থিয়ো।
থিয়োর তৈরি বিস্টের মেয়াদ ফুরোবে এ বছরের শেষেই। তার পর হয়তো কোনও আস্তাকুড়ে স্থান হবে এক সময় তট দাপিয়ে বেড়ানো বিস্টগুলোর। কিন্তু থিয়ো জানেন, তাঁর তৈরি এই ‘কাইনেটিক বিচ বিস্ট’ অমর হয়ে থাকবে নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের কাছে। সেই সব শিল্পী, যাঁরা শিল্প ও ইঞ্জিনিয়ারিংকে অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে মনে করেন, ঠিক তারই মতো।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।