
আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন—ভোটের মাঠে ‘অদৃশ্য শক্তির’ প্রভাব ঠেকাবে কে? নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলো বলছে, ন্যায়সংগত ও গ্রহণযোগ্য ভোট নিশ্চিত করতে হলে প্রশাসন, প্রভাবশালী গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার ছায়া থেকে ভোটারদের মুক্ত রাখতে হবে ইসিকেই।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক দলগুলোর বড় উদ্বেগ এখন ‘অদৃশ্য শক্তির’ সম্ভাব্য প্রভাব। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের সংলাপে অংশ নিয়ে দলগুলো স্পষ্টভাবে জানায়—সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন চাইলে এই অঘোষিত চাপ ও প্রভাবকে পুরোপুরি ঠেকাতে হবে। আর সে দায়িত্বে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে ইসি। তাদের হতে হবে আরও দৃঢ়, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ।
দলগুলো ইসিকে মনে করিয়ে দেয়, অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে—প্রশাসনের একাংশের প্রভাব, শক্তিধর গোষ্ঠী এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার অঘোষিত চাপই সবচেয়ে বেশি নষ্ট করে ভোটের পরিবেশ। এবার যেন সেই সুযোগ কেউ না পায়, সে জন্য শুরু থেকেই কঠোর অবস্থান নেওয়ার দাবি জানায় তারা।
সংলাপে নির্বাচন কমিশনও দলের উদ্বেগকে গুরুত্ব দিয়ে জানায়—যারা পেশিশক্তি দেখানোর চেষ্টা করবে, তারাই শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ইসির বার্তা একটাই, এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
এ ছাড়া ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংলাপে অংশ নেওয়া দলগুলো গণভোটের পদ্ধতি, জাতীয় নির্বাচনের দিনে গণভোট আয়োজনের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলে। তাদের অভিমত—জাতীয় নির্বাচনের চাপের মধ্যে গণভোট গুরুত্বহীন হয়ে পড়তে পারে।
সংলাপে সিসিটিভি ব্যবহারের কার্যকারিতা, নির্বাচনে কালোটাকার প্রভাব, নিরাপত্তা, আচরণবিধি প্রতিপালন, জামানত, নির্বাচনি ব্যয়—এসব নিয়েও বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরে দলগুলো। দুই ধাপে অনুষ্ঠিত এ সংলাপে ১২টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্যান্য কমিশনার, ইসি সচিব এবং কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সংলাপে অংশ নিয়ে কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগের প্রধান কাদের সিদ্দিকী বলেন,
“গণভোটে চারটি প্রশ্ন—মানুষ কি দুটি ‘হ্যাঁ’, দুটি ‘না’ দিতে পারবে? জনগণ এখনও জানে না। গণভোটে অংশগ্রহণ কম হলে জাতীয় নির্বাচনই হুমকির মুখে পড়বে। জাতীয় পার্টিকে ব্যান করার কথা শুনছি—এটা ঠিক হবে না। বাম দলকেও বাদ দেওয়া যাবে না। নিবন্ধিত দল হয়েও অধ্যাপক ইউনূসের সরকার আমাদের একবারও ডাকেনি। আপনাদের ডাকায় আমি খুশি। আমি কাউকে শত্রু মনে করি না, শেখ হাসিনাকেও নয়। আল্লাহ অসন্তুষ্ট হলে আল্লাহই শাসকের গদি সরিয়ে দেন। আমার বোন শেখ হাসিনা আল্লাহর গজবেই ক্ষমতা হারিয়েছে।”
গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, গণভোটে চারটি সাংবিধানিক সংস্কারের বিষয় রয়েছে, সরকার এটাকে প্যাকেজ করে ফেলেছে। চারটির মধ্যে আমি দুটিতে ‘হাঁ’ দেব, দুটিতে ‘না’ দেব—সেই বিকল্প রাখা হয়নি। এতে গণভোট অকার্যকর হয়ে যাবে। গণভোট যেন হাস্যকর বিষয়ে পরিণত না হয়, এই বিষয়ে আপনাদের শক্ত থাকতে হবে। সীমানা নির্ধারণ নিয়ে ইসি ভালো সিদ্ধান্ত নিলেও হাইকোর্ট ইন্টারফেয়ার করেছে দাবি করে তিনি বলেন, একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ না করে—তাহলে আপনাদের তো কাজ করার সুযোগই থাকবে না। এছাড়া, দলটির লিখিত প্রস্তাবে ভোটকক্ষে সিসি ক্যামেরা রাখা, জোটের ভোটে পছন্দের প্রতীক বহাল রাখা, জামানত কমানোর কথা বলা হয়েছে।
গণফ্রন্টের মহাসচিব আহমদ আলী শেখ বলেন, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য ইসির সক্ষমতা যা দরকার তা সুনিশ্চিত করতে হবে। এ দলের আরেক প্রতিনিধি বলেন, ইসি শক্তিশালী না হলে, নিয়ন্ত্রণমূলক স্বৈরাচারী শক্তি মাথাচাড়া দেবে। এবার সময় এসেছে, গণতান্ত্রিক আস্থা পুনরুদ্ধার করার।
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ এন এম সিরাজুল ইসলাম নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে বিভাগওয়ারি ভোট নেওয়া, জামানত কমানো, ভোটকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা রাখার সুপারিশ করেন। জোট করলেও স্ব-স্ব দলের প্রতীকে ভোট করার বিধান চালু করায় দলটির মহাসচিব জাফর আহমেদ জয় ইসিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, শঙ্কিত যে, জারি করা বিধিমালা রাখতে পারবেন কি না। আশা করি, অতীতের শিক্ষা থেকে কারো কাছে নতজানু হবেন না।
ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের চেয়ারম্যান সৈয়দ বাহাদুর শাহ মোজাদ্দেদী লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত, সারা দেশে একই দিনে নির্বাচন না করে চার ধাপে আয়োজন করার দাবি করেন। বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির অতিরিক্ত মহাসচিব শাহ মোহাম্মদ আসলাম হোসাইন বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে দেশের মানুষ হতাশ হবে। তাই কমিশনকে নির্বাচন বিতর্কিত করার যে কোনো অপচেষ্টা রুখে দিতে হবে।
বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমদ বলেন, নির্বাচনের আগে যৌথ বাহিনীর অস্ত্র উদ্ধার অভিযান, সন্ত্রাসী গ্রেফতার এবং সিসিটিভি ব্যবহারের উদ্যোগ জরুরি। তার অভিযোগ, ফ্যাসিবাদী শক্তি নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে আগুন-সন্ত্রাস শুরু করেছে—এটা নজরে রাখতে হবে। তিনি আরো বলেন, গণভোট আগে হলে গুরুত্ব বেশি পেত। জাতীয় নির্বাচনের চাপে গুরুত্ব কমে না যায়—সেজন্য ভোটারদের উত্সাহিত করতে ইসিকে কাজ করতে হবে।
ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল-মাদানী বলেন, একই দিনে নির্বাচন হলে গণভোটের গুরুত্ব থাকবে না। অনেক কেন্দ্রে গন্ডগোল-ঝামেলা হবে। আপনারা বলছেন, ঝামেলা হলে ভোটকেন্দ্রে বন্ধ করবেন, তাহলে গণভোটের কী হবে? যাই হোক সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আপনারা এটি প্রচার নিয়ে কাজ করেন। জোটের ভোটেও নিজ প্রতীকের বিষয়টি প্রশংসনীয় উদ্যোগ।
নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, যারা পেশিশক্তি দেখাবে, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে—এটাই ইসির বার্তা। এ ব্যাপারে কোনো ব্যত্যয় হবে না। অপপ্রচার ছড়ালে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কর্মকর্তারা পক্ষাপাতদুষ্ট হলে সে বা তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ তিনটি বার্তা ইসির।
নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, আমরা নতজানু হব না। আমরা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যা যা করার দরকার করছি, ভালো নির্বাচন করার বিকল্প রাস্তা নেই। পোলিং এজেন্ট নিয়োগের বিষয়ে ভোটের আগের দিন চূড়ান্ত না করে আগে আগেই তালিকা করে দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, অনেকে মনে করেন আমরা তার পক্ষে কাজ করলে আমরা নিরপেক্ষ। কিন্তু আমরা কারো পক্ষে কাজ করতে পারব না। আমাদের বিবেক দেশের প্রচলিত আইন বিধিবিধান যা বলে সেট মেনেই আমরা চলব, ইনশাল্লাহ। তিনি এ উদ্দেশ্য সাধনে সব রাজনৈতিক নেতার সহযোগিতা কমনা করেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



