তসলিমা নাসরিন: টাকা যারা খায়, তারাই ভাবে অন্যরাও টাকা খায়। দুর্নীতির সমাজে যারা বাস করে, যারা দুর্নীতি দেখে দেখে বড় হয়, তাদের বদ্ধ ধারণা, কেউ যদি কারও প্রশংসা করে, তারা নির্ঘাত টাকা খেয়ে করে। নিঃস্বার্থভাবে কেউ কারও জন্য কিছু করতে পারে তা তারা বিশ্বাস করে না। মেয়েদের বেলায় তো এরকম আরও হয়, কোনও মেয়ে গানে, নাচে, অভিনয়ে, চাকরিতে, ব্যবসায় সুযোগ পেলেই বলবে বসের সঙ্গে বা প্রডিউসারের সঙ্গে বা ডিরেক্টরের সঙ্গে শুয়েছে। টাকা অথবা শরীর, এই দুটোর বিনিময়েই সব কিছু ঘটছে, এরকমই মত অসংখ্য মানুষের। আমি টাকা কোনওদিন খাইনি। জানিও না কী করে টাকা খেতে হয়।
টাকা খাওয়ার কথা আমি প্রথম শুনি ১৯৯৩ সালে। তখন প্রচুর লোক বলতো, আমি বিজেপির টাকা খেয়ে লজ্জা বইটা লিখেছি। যেন টাকা না খেলে বাংলাদেশের হিন্দুদের নিরাপত্তাহীনতা আর দেশত্যাগ নিয়ে কিছু লেখা যায় না। আমি খুব অবাক হতাম শুনে। অন্যায়ের প্রতিবাদ তো প্রতিদিনই করছি, তাহলে হিন্দুদের ওপর হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে এমন টাকা খাওয়ার অপবাদ কেন শুনতে হয়! তারা বলতো আমি নাকি র-এর এজেন্ট। র কাকে বলে, র কী, আমি তখন জানতাম না।
১৯৯৩ সালেই ফ্রান্সের এডিশন স্টক নামের প্রকাশনী আমার বই ছাপাবার জন্য অগ্রীম রয়্যাল্টির চেক পাঠিয়েছিল আমাকে। আমার ঠিকানায় সেই চেক কখনও পৌঁছোয়নি। চেক এর ছবি আমি দেখি ইনকিলাব পত্রিকার প্রথম পাতায়। ব্যানার হেডলাইন ছিল, বিজেপির টাকা ভারত থেকে ফ্রান্স হয়ে বাংলাদেশে তসলিমার কাছে আসছে। ওদিকে আমার প্রকাশক ফ্রান্স থেকে জানিয়েছেন, চেক পাঠানো হয়েছে, চেক জমাও হয়ে গেছে, টাকা আমি তুলেও নিয়েছি। অথচ চেক আমার হাতেই আসেনি। চেক-চোরেরা চেক চুরি করে আমার নামে একাউন্ট খুলে চেক ভাঙ্গিয়ে নিয়েছে, তাদের সঙ্গে ইনকিলাব পত্রিকার কী করে যোগাযোগ –সে ইনকিলাব নামক মৌলবাদি পত্রিকাটিই জানে।
১৯৯৪ সালে দেশ ত্যাগ করতে আমাকে বাধ্য করেছিল বাংলাদেশের সরকার। ইউরোপে যেতে আমি বাধ্য হয়েছিলাম কিন্তু কিছুদিন পরই দেশে ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। দেশে আমার আত্মীয় স্বজন, আমার সাজানো ঘর বাড়ি, বইপত্র, আমার লেখার টেবিল, কম্পিউটার, বন্ধু বান্ধব, আমার প্রকাশক, আমার পাঠক, আমার শুভাকাংক্ষী সব ফেলে একা একা দূরের দেশে বাস করার সামান্যতম ইচ্ছে ছিল না। ওদিকে দেশে ফেরার উপায়ও ছিল না। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ আমার বই প্রকাশ করতে চাইছে তখন। খুব বড় ‘লিটারেরি এজেন্ট’রা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। বড় বড় লেখকদের নাকি লিটারেরি এজেন্ট থাকে। এতে নাকি বিভিন্ন ভাষায় বই প্রকাশে অনেক সুবিধে, অনেক টাকা। আমি সোজা বলে দিলাম, ‘আমি কোনও লিটারেরি এজেন্ট চাই না, লেখালেখি আমার পেশা নয়, আমার প্যাশন।’ কোনও লেখকই বোকা না হলে এই কাজ করে না। কিন্তু বোকা হতে আমার খারাপ লাগেনি।
নব্বই দশকের মাঝামাঝিতে ইউরোপে আমাকে বিশাল এক সেলেব্রিটি হিসেবে ট্রিট করা হত। জার্মানি, নরওয়ে, ফ্রান্স, সুইৎজারল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী আমার সঙ্গে দেখা করে জিজ্ঞেস করেছেন কী চাই আমার, তাঁরা কী করতে পারেন আমার জন্য। নিশ্চিন্তে বাকি জীবন আমার বসবাসের জন্য, নিশ্চিন্তে লেখালেখি করার জন্য। আমি বলেছি, ‘আমার নিজের জন্য কিছুর দরকার নেই। আপনারা যদি কাউকে সাহায্য করতে চান, তবে বাংলাদেশের গরিব এবং অসহায় মেয়েদের সাহায্য করুন। ‘ নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমরা তো প্রচুর টাকা দান করি বাংলাদেশকে, আমরা কি দান বন্ধ করে দেব?’ আমি বলেছি,’ সরকার দোষ করেছে, একজন লেখককে নিরাপত্তা দিতে পারেনি, মৌলবাদী অপশক্তির কাছে মাথা নুইয়েছে, কিন্তু সাধারণ দুঃস্থ মেয়েদের তো দোষ নেই। আপনাদের দান তো গরিব দুঃখীদের কাছেই যাবে, দান বন্ধ করবেন না দয়া করে।’
নারীর সমানাধিকারের প্রতিবন্ধক হিসেবে ধর্ম এবং পুরুষতন্ত্রকে চিহ্নিত করেছি সেই আশির দশক থেকেই। এবং লোকে তখনও বলেছে, আজও বলছে, ইহুদি খ্রিস্টানদের টাকা খেয়ে ইসলামের সমালোচনা করেছি। যারা বলে, তারা মনে করে, কারওর টাকা না খেলে কোনও বিপ্লব করা যায় না, সমাজ বদলাবার আন্দোলন করা যায় না, কোনও আদর্শের পক্ষে লড়া যায় না। আসলে একটি সৎ কাজকে কলুষিত করার জন্য বদ লোকেরা ওত পেতে থাকে।
আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। এমনকী কারাগার পদ্ধতিরও বিরুদ্ধে। আমি মনে করি ক্রিমিনালদের জন্য কোনও শাস্তি নয়, বরং সংশোধনাগার দরকার। কেউই ক্রিমিনাল হিসেবে জন্ম নেয় না, সমাজ তাদের ক্রিমিনাল বানায়। তাদের সুশিক্ষা দিয়ে ভালো মানুষে পরিবর্তন করা জরুরি। আমি তো সেদিনও কাল্পনিক পরলোকে গিয়ে ঈশ্বরকেও বলেছি দোযখ বন্ধ করে দিতে, সব ক্রিমিনালকে বেহেস্তের বাগানে বেড়ানোর সুযোগ দিতে, এবং দরকার হলে তাদের জন্য সংশোধনাগার বানাতে।
দেশদ্রোহীদের ফাঁসি চেয়ে যখন শাহবাগে আন্দোলন হচ্ছিল, একের পর এক আমি কলাম লিখেছি ফাঁসির বিরুদ্ধে। এই মৌলবাদি রাজাকাররা যারা আমার ফাঁসির দাবিতে বছরের পর বছর সারা দেশ কাঁপিয়েছে, তাদের যেন ফাঁসি না হয়, সে জন্য আমি সরব হয়েছি। জানিনা কেউ তখন বলেছিল কিনা, ওদের টাকা খেয়ে আমি ওদের ফাঁসি না হওয়ার জন্য বলছি। সারাজীবন ধর্ষণের বিরুদ্ধে বলেছি, ধর্ষকদের নিন্দে করেছি, আর বাংলাদেশে যখন ধর্ষকদের শাস্তি ফাঁসির আইন আনা্র কথা হচ্ছে, তখন আপত্তি করেছি। লোকেরা তো অবাক, এত বড় অপরাধীর জন্যও সর্বোচ্চ শাস্তি চাইছি না আমি! কেউ হয়তো তখনও বলেছিল, ধর্ষকদের টাকা খেয়ে আমি ধর্ষকদের জন্য অন্য শাস্তি চাইছি, মৃত্যুদণ্ড নয়। কেন মানুষ মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে তা বোঝার ক্ষমতা কি ভায়োলেন্সে বিশ্বাসীদের থাকতে পারে!
মানবতার জন্য লড়াই করলে অপরাধীর পাশেও দাঁড়াতে হয়, তাদের ভালো মানুষ হওয়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করতে হয়। অপরাধের জন্য ধিক্কার দিলেও তাদের সামান্য ভালো কাজেরও প্রশংসা করতে হয় যেন প্রেরণা পায় আরও ভালো কাজ করার।
এত যে সেলিব্রিটি জীবন যাপন ইউরোপ আমেরিকায়, এত যে যশ খ্যাতি, এত যে নিরাপত্তা, নিশ্চিতি — সব স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে দেশে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়ে ভারতে এসে বাংলা ভাষার টানে বাস করেছি পশ্চিমবঙ্গে। ধনী দেশ ছেড়ে গরিব দেশে ঠিকানা গড়েছি। আমাকে এ দেশ থেকেও কমিউনিস্ট তাড়ালো, কংগ্রেস হেনস্থা করলো। বিজেপিও এক বছরের ভিসা দেওয়ার বদলে আমাকে দু’ তিন মাসের ভিসা দেয়। বিজেপির কারও সঙ্গে আমার পরিচয় নেই। কোনও বিজেপি নেতার সঙ্গে আমার আলাপ নেই। আর এস এসের কাউকে আমি চিনি না। ভিসা না পেলে এমন কেউ নেই যাকে জানাতে পারি। অগত্যা প্রতিবার আমাকে টুইটারের আশ্রয় নিয়ে সরকারকে অনুরোধ করতে হয় ভিসা দেওয়ার জন্য। টুইটারের সাধারণ মানুষ সরকারকে ট্যাগ করে অনুরোধ করার পর আমার ভিসা জোটে। অথচ নিন্দুকেরা বলেই যাচ্ছে আমি বিজেপিকে তেল দিচ্ছি, আর-এস-এসকে তেল দিচ্ছি। বিজেপি আর-এস -এস আমাকে টাকা দিচ্ছে। তেলটা কবে দিলাম কী করে দিলাম, কেউ অবশ্য বলতে পারে না। টাকাটাই বা কে কখন আমাকে দিল, তাও বলতে পারে না। কিছু একটা বলে ঘৃণা ছুড়তে হয়, তাই বলে। আমি যে কোনও রাজনৈতিক দলের ভালো মন্দ নিয়ে বলি, কেউ ভালো কাজ করলে ভালো বলি, মন্দ কাজ করলে মন্দ বলি। এমনকী সিপিএম দল, যে দল আমাকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্যায়ভাবে তাড়িয়েছে, সেই দলও কোনও ভালো কাজ করলে আজও প্রশংসা করি।
কিছুদিন আগে যে মানুষটি তাঁর জন্মদিনে এগারো হাজার এতিম বাচ্চাকে খাইয়েছেন বলে প্রশংসা করেছি, আর সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের কিছু লোক বলতে শুরু করেছে যে আমি তাঁর টাকা খেয়ে প্রশংসা করেছি, সে মানুষটি ধনী। ধনী বলেই তারা নিশ্চিত আমি টাকা খেয়েছি। কোনও প্রমাণ ছাড়াই চারদিকে কুৎসা রটিয়ে দিয়েছে। যেন টাকা না খেলে তাঁর ভালো কাজটির প্রশংসা করা যায় না। যেন কারও কোনও ভালো কাজের প্রশংসা আমি কোনওদিনই করি না। আমি সৌদি রাজপুত্রের ভালো কাজের প্রশংসা যেমন করি, গলির ধারের গরিব ছেলেটিরও ভালো কাজের প্রশংসা করি। প্রশংসা করি ভালো কাজের প্রেরণা দেওয়ার উদ্দেশে। অবাক হয়ে গেলাম, এমনকী তারাও এমন অবিবেচকের মতো কথা বলছে যারা দাবি করে তিরিশ বছর ধরে আমার লেখা পড়ছে, আমার লেখা পড়ে তাদের বোধবুদ্ধি হয়েছে, তারা সচেতন হয়েছে। এত দীর্ঘ দীর্ঘ বছর আমার লেখা পড়ে, আমার আত্মজীবনী পড়ে আমার সততা সম্পর্কে কারও যে সন্দেহ থাকতে পারে, এ আমি কোনওদিন কল্পনাও করিনি। তাহলে হয়তো এ আমার লেখার দুর্বলতা বা লেখা বিশ্বাসযোগ্য করার অক্ষমতা, অথবা এ স্বার্থপর সমাজে তাদের বসবাসের কুফল, সব কিছুর পেছনে স্বার্থ দেখা। যাঁর ভালো কাজের প্রশংসা আমি করেছি, তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই, কোনওদিন আলাপ হয়নি, কোনওদিন তাঁকে আমি দেখিনি। তাঁর মালিকানাধীন যে কাগজে আমি লিখি, সেখানে আট বছরের বেশি একই পারিশ্রমিকেই লিখছি।
টাকাকে কোনওদিন বড় করে দেখিনি। ছোটবেলা থেকে আদর্শবান বাবার কাছ থেকে শিখেছি জ্ঞানকে মূল্য দিতে, টাকাকে নয়। আজও মানবতা, উদারতাকেই মূল্য দিই, অর্থকড়িকে নয়। আমার উপার্জিত রয়্যাল্টির টাকা, লেখার সম্মানী, পুরস্কারের টাকায় আমার জীবন চলেছে, বাকি জীবনও চলে যাবে।
নিজের ঘর বাড়ি হারিয়ে, আরাম আয়েশ ধন দৌলত বিসর্জন দিয়ে, শুধু বৈষম্যহীন একটি সমাজের স্বপ্ন নিয়ে, সমতার স্বপ্ন নিয়ে, জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও, অনন্ত নির্বাসনে, পায়ের তলায় মাটি-না-থাকা একটি অনিশ্চিত জীবন যাপন করছি, অথচ অপপ্রচার, অপবাদ, অপমান থেকে মানুষ আমাকে রেহাই দেয়নি একটি দিনের জন্যও।
(লেখাটি লেখিকার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।