লাইফস্টাইল ডেস্ক : ধরুন, আপনি অফিসে একটি কাজ প্রায় সফলভাবে শেষ করলেন। সবাই আপনাকে বাহবা দিচ্ছেন। আর আপনার একজন সহকর্মী হুট করে বলে বসলেন, ‘কাজটি হয়েছে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু এটা আরও ভালোভাবে করা যেত। আমি হলে আরও আগেই কাজটা করে ফেলতাম। এসব কত করেছি!’
হ্যাঁ, এমনটা শুনলে খারাপ তো লাগবেই। যদিও এ ধরনের আচরণ সব অফিসেই বিদ্যমান। সরকারি বা বেসরকারি করপোরেট—সব অফিসেই এমন দু-একজন সহকর্মী আপনি পেয়ে যাবেন, যাদের কাজই হলো অন্যের পেছনে লাগা। অন্য সহকর্মীর কৃতিত্ব খাটো করে দেখা বা আরেকজনের বিষয়ে নানা কল্পকাহিনি সবাইকে বলে বেড়ানোই তাদের কাজ। এ ধরনের ব্যক্তিরা সব সময় আপনার যে কোনো কাজের নেতিবাচক দিকটি সবার সমানে তুলে ধরতে উদগ্রীব হয়ে থাকেন। এমনকি আপনার বিষয়ে সামান্যতম নেতিবাচক দিকও তাদের শ্যেন দৃষ্টিতে এড়ায় না। শুধু আপনার ইতিবাচক দিকে মনোনিবেশ করতেই তাদের যত আপত্তি!
এ ধরনের সহকর্মী কেউ কোনো অফিসে পাননি—এমনটা দাবি করা খুবই কঠিন। ভালো-মন্দ মিশিয়েই মানুষ। কেউ বেশি ভালো হয়, কেউ আবার ভালো-মন্দের মিশেল। কিন্তু কেউ যদি কর্মস্থলে আপনাকে বারবার পদানত করার চেষ্টা করতে থাকে, বা ইচ্ছে করে আপনার কাজের খুঁত ধরতে থাকে (তা থাকুক বা না থাকুক), কিংবা আপনার ব্যাপারে নানা গালগপ্পো ফেঁদে সবাইকে আপনার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে—তবে কাঁহাতক আর সহ্য করা যায়? তখনই আপনার বুঝতে হবে যে, ওই নির্দিষ্ট ব্যক্তির আসলে যুক্তিতে মুক্তি মেলে না, মুক্তি মেলে কটুক্তিতে! এবং তিনি আসলেই আপনার পেছনে লেগেছেন।
এর মানে কিন্তু এই নয় যে, আপনি কাজ পারেন না বা আপনার কর্মকুশলতায় ঘাটতি আছে। কেউই শতভাগ নিখুঁত হয় না—তা কর্ম বা ব্যক্তিজীবন, যেটিই হোক না কেন। সবাই চেষ্টা করে যায়। কিন্তু কর্মস্থলে কিছু মানুষ আছেন, যারা নিজেদের কাজ বাদ দিয়ে অন্যের কাজের ভুল শুধু খুঁজে বেড়ান। অন্যদের কাঠগড়ায় দাঁড় করান অবলীলায়, যদিও নিজেদের ক্ষেত্রে তাদের সম্বল শুধু চাপা!এরাই অন্য সহকর্মীদের জীবন বিষিয়ে তোলেন নানা উপায়ে। অন্যকে টেনে নিচে নামানোতেই তাদের আনন্দ।
যে পেছনে লাগে, সে কেমন?
সাম্প্রতিক সময়ে ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিনের কয়েকজন গবেষক একটি গবেষণায় অংশ নেন। সেই গবেষণাপত্রটি ছাপা হয়েছিল জার্নাল অব লিডারশিপ অ্যান্ড অরগানাইজেশনাল স্টাডিজে। তাতে দেখা গেছে, অন্যকে টেনে নিচে নামানোর উপরিউক্ত কাজগুলো সাধারণত করে থাকেন কর্মস্থলে যাদের কর্মকুশলতা কম, তারাই। স্বাভাবিকভাবেই তারা বেশি কর্মকুশল সহকর্মীদেরই লক্ষ্যে পরিণত করেন। কারণ দিনশেষে সব কাজ মুখ দিয়েই শেষ করে ফেলা যায় না, কিছু কাজ মাথা খাটিয়েও করতে হয়। আর যেহেতু তাদের ওখানেই ঘাটতি, তাই যাদের মাথা বেশি কাজ করে তাদের মাটিতে টেনে নামানোর মিশনে নামা হয়। কারণ যাদের পারফরম্যান্স ভালো, তাদের জন্য অন্য সহকর্মীকে খাটো করে দেখানোর কোনো প্রয়োজন হয় না। তারা এমনিতেই ঊর্ধ্বতনদের গুড বুকে থাকেন। কিন্তু যার পারফরম্যান্স দেখানোর সামর্থ্য কম থাকে, তারা ঈর্ষাবশত বেছে নেন বাঁকা পথটি এবং তা অবশ্যই ক্যারিয়ারের উন্নতির জন্যই। এক কথায়, ল্যাং মারার চেষ্টা একেই বলে।
মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, কর্মস্থলে যারা অন্য সহকর্মীর পেছনে লাগেন এবং অন্যদের যারা টেনে নামিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, তাঁরা আসলে নিজেরাই এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন জীবনের কোনো না কোনো সময়ে। আর এই অভিজ্ঞতা যে শুধু তাঁদের কর্মজীবন থেকেই পাওয়া হয় তেমনটা কিন্তু নয়। অনেক সময় ব্যক্তিজীবনেও তাঁরা ক্রমাগত অপমানিত হতে থাকেন, পরিবারের কেউই হয়তো তাঁদের ক্রমাগত ব্যক্তিক আক্রমণ করে থাকেন। আর সেই ট্রমাই তাঁদের প্ররোচিত করতে থাকে অন্যদের ক্ষেত্রেও তেমনটাই করতে। অর্থাৎ, তাঁরা সুবিধাজনক পদে গেলেই মনে করেন যে, এবার অন্যদের পালা! আর সেই মনোভাব থেকেই শুরু হয় অন্যকে টেনে নামানোর চেষ্টা। মূলত, কর্মস্থলে শক্তিশালী হওয়ার চেষ্টা থেকে এই ল্যাং মারার কাজ চলে। কারণ জীবনের অন্য কোনো সময়ে এই একই পরিস্থিতির শিকার হয়ে তাঁদের প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কাটাতে হয়েছে। তাই তাঁদের ইচ্ছা হয় শক্তিশালী হয়ে নিরাপদ থাকার। সে কারণেই মূলত অন্যদের যন্ত্রণা দিতে থাকেন তাঁরা।
পেছনে লেগেছে ফেউ, কীভাবে বুঝবে কেউ?
দলাদলি সব দলেই থাকে। সব অফিসেই থাকে এসব। তবে কখনো কখনো তা অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায়। এই অসহনীয় পরিস্থিতি যারা তৈরি করেন, তাঁদের থাকে মুখে মধু, অন্তরে বিষ। তাঁরা মূলত ‘উপদেশ’, ‘পরামর্শ’, ‘সমালোচনা’ ইত্যাদির নামে অন্যদের পেছনে লাগতে থাকেন। এভাবেই সবার সামনে একজনকে অযোগ্য প্রমাণ করার চেষ্টা চলে। আর এসবের মাধ্যমে একজনের ওপরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়।
আসুন তবে জেনে নেওয়া যাক, কোন কোন লক্ষণ দেখে বুঝবেন অফিসে কেউ আপনার পেছনে লেগেছে। জেনে নিন কীভাবে চিনবেন এমন ব্যক্তিত্বকে।
১. অফিসে সহকর্মীর পেছনে যারা লাগেন, তাঁরা অত্যন্ত প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়ে থাকেন। এরা সবাইকে হারানোর চিন্তায় থাকেন সব সময়। মুখে দশে মিলে করি কাজ বললেও, আসলে তাঁরা একাই কাজের কৃতিত্ব নিতে চান। এদের কাছে জেতা-হারাই সব।
২. কাজ করার বদলে এদের বেশির ভাগ সময় কাটে গসিপ করে। বিভিন্ন সহকর্মীর নামে বা অফিসের বিভিন্ন বিষয়ে অন্যের কান ভারী করাই এদের প্রধান কাজ। গুজব ছড়াতে এরা ভালোবাসে। কারণ গুজবের মাধ্যমে এ ধরনের ব্যক্তি আপনার মাথায় নেতিবাচক চিন্তা ঢুকিয়ে দিতে চায়। এভাবে যার নামে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, শুধু যে তার ক্ষতি করা হয়, তা কিন্তু নয়। একইসঙ্গে যাকে গুজব গেলানো হয়, তাকেও অনুৎসাহিত করা হয়। মনে রাখতে হবে, যে আপনার কাছে অন্যের ব্যাপারে গসিপ করে, সে অন্যের কাছে আপনার ব্যাপারেও গসিপ করতেই পারে!
৩. এরা অন্যের নাম ভাঙিয়ে চলতে ভালোবাসে। বিশেষ করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম ভাঙিয়ে নিজেকে সবার ওপরে স্থান দিতে চায় তারা। এমনকি কখনো কখনো এক ঊর্ধ্বতনের কাছে আরেক ঊর্ধ্বতনের নাম জাহির করে কাজ আদায়ের চেষ্টা চালায়।
৪. এ ধরনের ব্যক্তিরা নিজেদের ‘মুই কি হনু রে’ দাবি করতে খুবই ভালোবাসে। এবং এই প্রক্রিয়ায় সবাইকে আদেশ-নির্দেশ দিতে থাকে, বিশেষ করে নিজেরা সক্রিয়ভাবে কাজ না করে। নিজেকে ‘বস’ দাবি করায় এদের জুড়ি মেলা ভার। একটা কথা মনে রাখবেন, যারা নিজেরাই নিজেদের ‘বস’ দাবি করেন, তাঁরা কখনো আদর্শ নেতা হতে পারেন না। আর আদর্শ নেতা না হতে পারলে কারও পক্ষেই দল পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তিনি হতে পারেন শুধুই ‘হুকুমের বস’।
৫. অফিসের গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে এরা কেবলই নিজেরা কথা বলতে থাকেন, শোনেন কম। কখনোই অন্যকে কথা বলতে দিতে চান না। কখনো কখনো এরা অন্যের যৌক্তিক কথাতেও বাম হাত ঠেলে দেন এবং কথা শেষ করতে না দিয়ে প্রসঙ্গান্তরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ, উপকারী হোক বা না হোক—মিটিংয়ে তাঁদের কথা বলা চাই-ই চাই। প্রয়োজনে অন্যের কথা শেষ করতে না দিয়ে হলেও।
৬. এরা অন্যদের নৈতিক মাপকাঠিতে মাপার চেষ্টা করেন সর্বদা। অন্যের মূল্যবোধকে প্রশ্নের মুখে ফেলার চেষ্টাও চলে। যদিও এরা নিজেরাই অনেক অনৈতিক কাজে যুক্ত থাকেন। এ সময় এরা নিজেদের রাখতে চেষ্টা করেন সব বিচারের ঊর্ধ্বে। অর্থাৎ, বিচারের মুখোমুখি কখনো তিনি হতে চান না। আর বাধ্য হয়ে সেটি হতে হলেই শুরু হয় অজুহাত দেখানো।
৭. এরা প্রকাশ্যে আপনার ছোটখাটো ভুলও বড় করে দেখানোর চেষ্টা করে। হয়তো একটি বিষয়ে আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে সতর্ক করলেই চলে। কিন্তু তারা এটি যথোপযুক্ত সময়ে করবে না। বরং আপনার যেকোনো ভুল সময় পার হয়ে যাওয়ার পর সবার সামনে বলে আপনাকে হেয় করার চেষ্টা করবে। মনে রাখতে হবে, এ ক্ষেত্রে সহকর্মীকে ছোট করাই তার উদ্দেশ্য, ভুল সংশোধন নয়। অর্থাৎ, দল হিসেবে সফলভাবে কাজ সমাধা করা একসাথে এগিয়ে যাওয়া এদের উদ্দেশ্য নয়। এদের লক্ষ্য, ভুল জিইয়ে রেখে অন্যকে ল্যাং মেরে শুধু নিজের সামনে এগিয়ে যাওয়া।
৮. ছোট ভুল বড় করে দেখানোর পাশাপাশি এরা আপনার অর্জনকেও ছোট করতে চায়। এই কাজটি যখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হতে দেখবেন, তখন বুঝতে হবে আপনার পেছনে ফেউ লেগেছে। এ ধরনের ব্যক্তি আপনার দক্ষতা নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করতেও ছাড়ে না। বরং প্রায় সময়ই সেটিকে নিয়মিত বিষয় করে ফেলে।
৯. কখনো কখনো এরা কর্মস্থলের কাজ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ইচ্ছে করেই সহকর্মীকে জানায় না। যাতে করে ওই সহকর্মী না জেনে ভুল করে বসেন এবং তখন শুরু হয় এই তালিকার ৭ নম্বর কর্মপ্রক্রিয়া। অর্থাৎ, জেনেশুনে ভুল হতে দেওয়া হয় এবং তা নিয়েই চলে পরবর্তী বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী কার্যক্রম।
১০. এবার সর্বশেষ লক্ষণে আসা যাক। যদি দেখেন কর্মস্থলে কোনো সহকর্মী আপনার কাজের কৃতিত্ব নিজের বলে দাবি করা শুরু করেছেন, তবে সাবধান হয়ে যান। তখন বুঝতেই হবে যে, ওই ব্যক্তি আপনাকে ল্যাং মারতে ব্যগ্র হয়েছে। কৃতিত্ব ছিনতাইয়ের এই বিষয়টি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ—দুই উপায়েই হতে পারে। সুতরাং চোখ-কান খোলা রাখতে হবে অবশ্যই।
কী, কোনো লক্ষণ কি চেনা চেনা লাগে? পরিচিত মনে হলে মিলিয়ে নিন দয়া করে। তাহলেই পেয়ে যাবেন কর্মস্থলে থাকা আপনার বন্ধুরূপী শত্রুকে!
তথ্যসূত্র: হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ, সাইকোলজি টুডে, ইনডিড ডট কম, বিজনেস ইনসাইডার, হাফপোস্ট ডট কম, মিডিয়াম ডট কম এবং সিডনি মর্নিং হেরাল্ড
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।