অবসর সময়ে একটা বড় বিষয় হলো অর্থনৈতিক সচ্ছলতা। আমার মতে, অবসর পরিকল্পনার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হলো proper, practical and affordable financial management plan থাকা। এতে খরচের খাতগুলো যেমন থাকবে, তেমনি অর্থসংস্থানের উত্সগুলোরও উল্লেখ থাকবে, পরিকল্পনায় বাজেট ঘাটতি দেখা দিলে বিকল্প উেসর অনুসন্ধান করতে হবে।
অবসরকালে সুস্থ থাকাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। অতীতের রোগগুলো, যার অনেকটাই ধামাচাপা দেয়া হয়েছিল, সেগুলো এ সময়ে এসে প্রকটরূপে আবির্ভূত হতে পারে। সবচেয়ে ভালো হয়, রোগ সম্পর্কে কোনোকালেই গাফিলতি না করা। অবসরকালে যেহেতু আমরা ইচ্ছে করলে অতিরিক্ত সময় বের করতে পারি, তাই আমরা যেন বেশ কিছুটা সময় বরাদ্দ রাখি স্বাস্থ্য খাতে। এতে অর্থের অনেকটাই সাশ্রয় হবে এবং মানুষ রুগ্ণতা থেকে অনেক বেশি পরিত্রাণ পাবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো অহংবোধ ও রাগ নিয়ন্ত্রণ করা। আগুন যেমন সবকিছু পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়, রাগও তেমনি আমাদের সম্পর্ক, সুনাম, কর্মসাফল্য সব বিনষ্ট করে দেয়। ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন, কর্মজীবনে অহেতুক অহংবোধ ও রাগ আমাদের কতটা ক্ষতিই না করেছে। তাই অবসরজীবনে ওইসব উপদ্রবের পুনরাবৃত্তি কেন করব? আসুন, রাগ পরিত্যাগ করতে না পারলেও তা নিয়ন্ত্রণে সচেষ্ট হই। তাতে সবারই মঙ্গল হবে।
চাকরিজীবনে আমরা সারা দিন একটা ছকের মধ্যে চলেছি। সকাল থেকে রাত একটা নির্দিষ্ট নিয়মে বাঁধা ছিল। দীর্ঘদিনের এ অভ্যাস। তাহলে অবসরজীবনে এসে কেন ছকহীন, উদ্দেশ্যহীন অলস জীবনে চলে যেতে হবে? কেন এ জীবনে সকাল-দুপুর-রাত সব একাকার? আমার মতে, শিক্ষাকালীন, চাকরিকালীন ও অবসরকালীন একই নিয়মে একইভাবে এগোবে, শুধু কাজগুলো ভিন্নতর হবে।
যেমন আগে আমি সকাল ৮টায় অফিসে যেতাম, এখন ওই সময়ে আমার দিনপঞ্জিতে অন্য কাজ নিয়ে আসব। উদাহরণস্বরূপ, ওই সময়টায় বই পড়া, বাইরে হাঁটা, বাজার করা ইত্যাদি করা যেতে পারে। অবশ্য কারো কারোর কাছে এর কোনো কোনোটি কাজ হিসেবে বিবেচিত না-ও হতে পারে। এ ব্যাপারে আমার মতামত হলো, অবসর সময়ের কাজ বিবেচনায় ‘কাজ’ সম্পর্কে আমাদের সনাতন ধারণায় পরিবর্তন আনতে হবে। মোদ্দাকথা হলো, হেলাফেলায় অলস জীবন না কাটিয়ে সময়ের সঠিক ব্যবহার করুন। এতে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য উভয়ই ভালো থাকবে।
আরেকটি প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চাই, আমরা অনেকেই হলিডে ও রিটায়ারমেন্টকে একই ধরনের বিবেচনা করে তালগোল পাকিয়ে ফেলি। এমনও হতে পারে যে এ দুইয়ের টার্মিনোলজি আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। চাকরিকালে আমরা যেমন অফিস ডে ও হলিডে-কে আলাদাভাবে বুঝতে পারি, তেমনি অবসরকালে হলিডেও যেন আমাদের কাছে ‘সাময়িক কর্মবিরতি’ হিসেবেই আসে অপেক্ষাকৃত কম কর্মব্যস্ত অবসর জীবনে। আমার মনে হয়, এভাবে অবসর জীবনেও ছুটির দিনগুলো নতুন বৈচিত্র্যে উপভোগ্য হয়ে উঠতে পারে।
অতীতের অনেক কাজ, যা সময়ের অভাবে আগে করতে পারেননি, এখন এগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে পারবেন। গ্রামের বাড়িতে অনেক দিন হলো যেতে পারেননি। ঘুরে আসুন, ভালো লাগবে। আপনার স্মৃতিময় সেই পুরনো স্কুল অথবা কর্মস্থল, যেখানে একটা ‘সুখজাগানিয়া’ স্মৃতি রয়েছে। পুরনো বন্ধুদের খোঁজ করে বের করুন অথবা ঘুরতে বেরিয়ে যান। কোনো পিছুটান রাখবেন না, ভ্রমণের পুরো আনন্দটাই উপভোগ করুন।
আপনার যেহেতু অভিজ্ঞতা রয়েছে, এ সময়ে কিছু সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হতে পারেন। হোক না তা অবৈতনিক! সময়টা এতে বেশ ভালো কাটবে, সমাজও উপকৃত হবে। আমরা প্রায় সবাই কোনো না কোনো ধর্মে বিশ্বাসী। ধর্ম পালন আমাদের মনে শান্তি দেয়, সঠিক পথ চলতে সাহায্য করে।
অতীতে ধর্মকর্ম পর্বটা হয়তো সক্রিয়ভাবে করতে পারেননি বা নিজের সামর্থ্য মতো করে গেছেন। এখন যেহেতু হাতে অনেকটা সময় আছে, ধর্মেকর্মে প্রচুর সময় দিতে পারেন। ধর্মীয় বইগুলো বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়ুন, অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজে বের করুন। নিয়মিত উপাসনালয়ে যান, ধর্মীয় আসরগুলোয় যাতায়াত করুন।
আমি বিশ্বাস করি, ধর্মীয় কর্মকাণ্ড জীবনেরই চলমান একটি অংশ। তাই এমনটি নয় যে ধর্মীয় কাজগুলো আপনি অবসর সময়েই শুরু করবেন। অবসর সময়ে আপনি এতে আরো বেশি সময় দিতে পারবেন।
পরিবারকে প্রচুর সময় দিন। স্বেচ্ছায় পরিবারের অনেক কাজের দায়িত্ব নিন। পরিবারের ছোট লাইব্রেরিটা গোছানো হয়নি অনেক দিন! বাগানটা অপরিষ্কার, সংগৃহীত কয়েন ও স্ট্যাম্প কালেকশনের খাতাটা অযত্নে পড়ে আছে! আজই শুরু করে দিন, এখনই, কিছুক্ষণ পরে নয়। পুরনো অভ্যাসগুলো—‘কিছুক্ষণ পরে, কালকে শুরু করছি’—জীবন থেকে চিরতরে বাদ দিয়ে দিন।
অনেককেই দেখেছি রিটায়ারমেন্টের পরে হঠাত্ করেই বৃদ্ধ হয়ে যান। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি, কুঁজো হয়ে, মলিন পোশাক পরে আস্তে আস্তে হেঁটে চলেন। যেমন অনেকটাই ‘অনেক চলেছি, আর কত!’ আপনাকে, আপনাকেই বলছি, ‘উঠুন, দাঁড়ান, সোজা হয়ে চলুন। এখনো হয়তো অনেকদূর যেতে হবে আপনাকে।’
অনেককে আবার বলতে শোনা যায়, ‘কী পেলাম জীবনে! এত কষ্ট করলাম। অমুক তো সারা জীবন ফাঁকি দিয়ে চলল, এখন তো সে ভালোই আছে। বাড়ি-গাড়ি আরো অনেক কিছুই তো করতে পারতাম…’ ইত্যাদি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, যা আপনার আছে, এটা আপনারই জন্য বরাদ্দ। যা আপনার নেই অথবা করতে পারলেও আপনি যা করেননি, তা আপনার জন্য বরাদ্দ ছিল না। আপনার বরাদ্দটাই আপনি পেয়েছেন। এতেই আপনার কৃতজ্ঞ থাকা দরকার।
আমি মনে করি, জীবনের কিছু ঘটনা বা মুহূর্তের স্মৃতি পরিহার করা বা ভুলে যাওয়াই ভালো। যেমন আপনি যে অফিসে কাজ করতেন, যে আপনি সবার প্রিয় ছিলেন, সেখানে আপনার পুরনো সহকর্মীরা এখনো কাজ করছেন। একদিন হয়তো আপনি ওই অফিসের সামনে দিয়ে যাচ্ছেন, ইচ্ছা হলো পুরনো কলিগদের দেখে যাই। আপনি হয়তো নিরাশ হতে পারেন এই ভেবে যে ব্যস্ততার অজুহাতে তারা আপনাকে সময় দিতে পারেননি, অনেকে ওভারলুক করতেও পারেন। এজন্য দুঃখ করে লাভ নেই অযথা চাপই বা নেবেন কেন? চাপ (স্ট্রেস) শুধু তখনই নেবেন, যদি তা কোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারে।
আপনি যে ‘অবসর পরিকল্পনা’ করেছেন, তার কাজগুলো, চিন্তা, টাকা-পয়সা খরচাদি, চলাফেরা ততটুকুই পরিকল্পনায় রাখুন, যা আপনি প্রফুল্লচিত্তে বাস্তবায়ন করতে পারবেন। এমন পরিকল্পনা রচনা থেকে বিরত থাকুন, যা বাস্তবায়নে অন্যের সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে বা যা বাড়তি চাপের জন্ম দেয়। একথা মনে রাখতে হবে যে কোনো কারণে কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা আপনি না-ও পেতে পারেন।
আপনার শরীর, স্বাস্থ্য ও মন একান্তই আপনার নিজস্ব। অন্যদের সাফল্য বা ব্যর্থতার তুলনা করে নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন না। বাস্তবতার নিরিখে নিজের অবস্থান নিরূপণ করুন এবং প্রফুল্লচিত্তে এগিয়ে যান। এটা সবসময়ের জন্য সত্য যে ‘চিন্তা ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন’ একই সমান্তরালে চালাতে হবে, যদি সাফল্য পেতে চান। জীবন চলবে শান্ত ও ছন্দবদ্ধ লয়ে। তখনই দেখবেন চলার পথটি হয়তো হয়ে গেছে মসৃণ।
সামনে তাকান! প্রচুর ঝলমলে আলো অপেক্ষা করছে আপনার জীবন রাঙাতে, আপনার মনকে প্রফুল্ল রাখতে রয়েছে অবারিত ফুলের নিরন্তর মিষ্টি সৌরভ। সবাই শামিল হোক নতুন উদ্দীপনায়, নতুন জীবনবোধে। শুরুটা কিন্তু আপনাকেই করতে হবে, তাই কবি বলেছেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলরে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।