আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ২০ বছর পর ইউরোর দর ডলারের নীচে নেমে গেছে৷ ২৫ বছরের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে৷ কিন্তু মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের এমন ফল কি এড়ানোর উপায় ছিল? খবর ডয়চে ভেলে’র।
অর্থনীতির নিম্নমুখী প্রবণতার এই ধাক্কা বিশ্বের সবদেশেই আঘাত হেনেছে৷ কিন্তু সব দেশের জন্য এটি সমান ফল বয়ে আনেনি৷
জার্মানিতে জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর অতি নির্ভরশীলতা নিয়ে আলোচনা কয়েক দশকের৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি পুঁজিবাদী এবং সমাজতন্ত্রী এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে পূর্ব-পশ্চিমে বিভক্ত হয়৷ কিন্তু ১৯৯১ সালে বার্লিন দেয়াল পতনের পর থেকে একদিকে যেমন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা ছিল প্রতিটি সরকারের, অন্যদিকে জার্মানদের এক অংশের মধ্যে রাশিয়ার প্রতি সন্দেহের দৃষ্টিও ছিল বরাবরাই৷
সবসময়ই এমন আশঙ্কা ছিল, রাশিয়ার গ্যাসের ওপর জার্মানদের অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা যে-কোনো বিপর্যয়ের সময় ভোগান্তির কারণ হয়ে দেখা দেবে৷ কিন্তু তারপরও সেই নির্ভরশীলতা কমানো হয়নি, বিকল্প কোনো ব্যবস্থার চিন্তাও মাথায় রাখা হয়নি৷ ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রাইমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় রাশিয়া৷ এরও আগে ২০০৮ সালে জর্জিয়ার দুটো অংশ আবখাজিয়া এবং সাউথ ওশেটিয়াকে একই ভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাশিয়া৷ কিন্তু তারপরও আরো বড় কিছু হওয়ার সম্ভাবনা বা আশঙ্কা থেকে জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি৷
২০২১ সালেও জার্মানিতে আসা গ্যাসের ৫৫ শতাংশই ছিল রাশিয়া থেকে৷ জার্মান অর্থ মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে, এখন তা ৩৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে৷ কিন্তু গ্যাসের এই ঘাটতি পূরণ করতে যেমন টালমাটাল অবস্থায় পড়তে হচ্ছে জার্মানিকে, অন্যদিকে যে-কোনো সময় ৩৫ শতাংশ গ্যাসও রাশিয়া বন্ধ করে দিতে পারে, এমন শঙ্কা দেখা দিয়েছে৷
ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানির অবস্থা এখন শাঁখের করাতের মতো৷ একদিকে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ এবং ইউরোপে পশ্চিমা অংশীদার রাষ্ট্রগুলোকে নিয়মিত হুমকিধামকি দেয়াটা জার্মানির নীতিগত অবস্থানের কারণেই প্রতিবাদ করতে হচ্ছে৷ অন্যদিকে, রাশিয়ার ওপর জ্বালানি ছাড়াও অন্য নানা নির্ভরতার কারণে চাইলেই কড়া পদক্ষেপ নিয়ে রাশিয়াকে একঘরেও করে দেয়া যাচ্ছে না৷
মুখে কড়া কথা বললেও আদতে কড়া অর্থনৈতিক, সামরিক বা কূটনৈতিক কোনো পদক্ষেপই নিতে পারছে না জার্মানি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ শুরু থেকেই ইউক্রেন ইস্যুতে জার্মানির অপেক্ষাকৃত নরম অবস্থানের ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে৷ অস্ত্র বা ভারি সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর সিদ্ধান্ত অন্য দেশগুলোর তুলনায় বেশ দেরিতে নিয়েছে৷
কিন্তু জার্মানি নরমই থাক বা গরম, এককভাবে এখন আর অর্থনীতিকে সামলে রাখার কোনো উপায় নেই৷ রাশিয়ায় গণতন্ত্র নেই৷ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের কথাই শেষ কথা৷ ফলে রুবলের দাম কতটা কমলো, রুশ অর্থনীতি কতটা নিম্নগামী হলো, তাতে আসলে পুটিনের তেমন একটা মাথাব্যথা থাকার কথাও না৷ কিন্তু ইউরোপের ক্ষেত্রে ঘটনাটা ভিন্ন৷ জার্মানি-ফ্রান্সের মতো গণতান্ত্রিক দেশে অর্থনীতি নিম্নগামী হতে থাকলে তার প্রভাব সমাজ এবং রাজনীতিতে পড়তে বাধ্য৷
করোনার মহামারিতে এরই মধ্যে বিপর্যস্ত অর্থনীতি ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আরো সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে৷ যুদ্ধ শুরুর মাসখানেক পরই জার্মানির বাজারে গম ও সূর্যমুখী তেলসহ নানা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট দেখা দেয়৷ ডোমিনো ইফেক্টের মতো এইসব পণ্যের বিকল্প পণ্য যেমন চাল, জলপাই বা অন্য উদ্ভিজ্জ তেলের দামও বাড়তে থাকে৷
জ্বালানির দাম বাড়তে থাকায় এখন প্রায় প্রতিটি পণ্য ও সেবার খরচ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে৷ তারচেয়ে বড় ভয়ের কারণ সামনে শীতকাল৷ ঘর গরম রাখার জন্য পর্যাপ্ত গ্যাস বা তেল না পেলে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে৷
এখনই বাসায় চিঠি আসছে, শিগগিরই ঘর উষ্ণ করার খরচ বাড়তে পারে৷ বার্লিনের একটি প্রতিষ্ঠান গ্যাস বা তেলে ঘর উষ্ণ রাখার খরচ দ্বিগুণ করে দিয়েছে৷ জার্মানির তিন হাজার হাউজিং প্রতিষ্ঠানের সংগঠন জিডিডাব্লিউ জানিয়েছে, আগামী বছরে প্রতিটি বসতবাড়িকে জ্বালানির জন্য তিন হাজার ৮০০ ইউরো বাড়তি খরচ করতে হতে পারে৷ ফেডারেল নেটওয়ার্ক এজেন্সি জানিয়েছে, ঘর উষ্ণ রাখার মাসিক খরচ আগামি বছর অন্তত তিন গুণ হতে পারে৷
উচ্চবিত্তরা কোনোভাবে এ খরচ সামাল দিলেও, নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য করোনার পর এই বাড়তি খরচ হবে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা৷ কিভাবে এই পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছেন জার্মান রাজনীতিবিদরা? সম্ভবত, পরিস্থিতি তাদের হাতে খুব একটা নেই৷ শীতকালে বাঁচতে এখন থেকেই সবাইকে বিদ্যুৎ বাঁচানোর চেষ্টা করার আহ্বান জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী রবার্ট হাবেক৷
আর নির্বাচনে জিতেই একীভূত জার্মানির সবচেয়ে বড় সংকট মোকাবিলার দায়িত্ব পাওয়া চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস কী বলছেন? জানিয়েছেন, বিশ্বের কোনো দেশই দামবৃদ্ধির সংকট এড়াতে পারবে না৷ ফলে, ‘‘সবকিছুতে আমরা ভর্তুকি দিতে পারবো না৷’’
তাহলে ভবিষ্যৎ কী? অচিরেই যদি পুটিনকে ঠেকিয়ে ইউক্রেন পরিস্থিতি শান্ত করার মাধ্যমে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বাণিজ্যের চাকা জোরেসোরে চালু না করা যায়, তাহলে ভয়াবহ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কা রয়েছে৷
রাশিয়ার সরবরাহ করা গ্যাস পুরোপুরি বন্ধ হলে ঠিক কী ঘটতে পারে, এ নিয়ে জুনে এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রোগনোস৷ সেখানে দেখা গেছে, চার সপ্তাহ পরই সবার জন্য গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে না৷ আইন অনুযায়ী, বসতবাড়ি, সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান এবং হিটিং সরবরাহকারীদের গ্যাস দিতেই হবে৷ ফলে গ্যাস বন্ধের প্রথম প্রভাব পড়বে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উপর৷ ইস্পাত, অপরিশোধিত লোহা, রাসায়নিক এবং কাচের কারখানায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসবে৷
সমগ্র অর্থনীতিই এর ফলে সংকটে পড়বে৷ প্রোগনোস ধারণা করেছে, রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হলে বছরের শেষে জার্মানির অর্থনীতি ১২ দশমিক সাত শতাংশ সংকুচিত হতে পারে৷
গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে জার্মানিতে৷ কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম রপ্তানির চেয়ে বেশি আমদানি করছে জার্মানি৷
মানুষের না খেয়ে-পরে থাকলে পুটিনের কিছু যায় আসে কিনা জানি না৷ কিন্তু জার্মানি এবং ইউরোপকে নৈতিক কারণে নিজের জনগণের পাশাপাশি বিশ্বের কথাও ভাবতে হবে৷ এই কথাটা পুটিন জানেন বলেই জ্বালানি ও খাদ্যকে প্রয়োজনে‘যুদ্ধের অস্ত্র’ হিসাবেও তিনি ব্যবহার করতে প্রস্তুত৷
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।