সাইদুল ইসলাম : প্রায় ২৫ বছর পর এশিয়ার দেশগুলোতে আবারও অর্থনৈতিক মন্দার ঢেউ লেগেছে। ছোটখাটো অর্থনীতির দেশ তো আছেই, চীন এবং জাপানের মতো শক্তিশালী অর্থনীতির দেশও এ মন্দার রেশ কাটাতে পারছে না। চীনা মুদ্রা ইউয়ান এবং জাপানি মুদ্রা ইয়েনের পতনে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ছে অর্থমন্ত্রীদের।
শক্তিশালী মুদ্রা মার্কিন ডলারের সঙ্গে বিনিময় হার ঠিক রাখতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু ফল তেমন আসছে না। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, করোনার দীর্ঘ ধকল কাটিয়ে উঠে দেশগুলোর অর্থনীতি মূল ধারায় ফেরার প্রচেষ্টায় ছিল। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি আরো জটিল করেছে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে এশিয়ার দেশগুলোতে মন্দা শুরু হয়। মূলত পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ডের মাধ্যমে এটি শুরু হলেও পরে এটি ছড়িয়ে পড়ে পুরো এশিয়া জুড়ে। সে সময় কোনো কোনো দেশের মুদ্রার মান মার্কিন ডলারের বিপরীতে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। অধিকাংশ শেয়ারের দাম পড়ে যায়। অবশ্য তখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মন্দার হাওয়া কিছুটা কম লেগেছিল। তবে অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিশেষ কোনো অঞ্চলে সীমাবদ্ধ না থেকে এবার তা কম-বেশি ছড়িয়ে পড়তে পারে সব দেশে।
চীন এবং জাপান সর্বাগ্রে
২০২২ সালের এশিয়ার পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিশ্লেষকরা বলেছেন, বড় অর্থনীতি যেমন চীন ও জাপানের পরিস্থিতি সবচেয়ে বেশি খারাপ। গত কয়েক দশকের মধ্যে এমন পরিস্থিতি দেখেনি দেশগুলো। জাতিসংঘের নতুন রিপোর্টে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছে তাতে চীনের মন্দার বিষয়টি ত্বরান্বিত হয়েছে। ইতিমধ্যে চীনা মুদ্রা ইউয়ানের বিনিময় মূল্য মার্কিন ডলারের চেয়ে প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ কমে গেছে। চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইউয়ানের পতন ঠেকাতে নানা ব্যবস্থা নিলেও তা কাজ করছে খুব কম।
অপরদিকে, বিশ্বের তৃতীয় অর্থনীতির দেশ জাপানের অর্থনীতিও মন্দার ধারায় যোগ দিয়েছে। চলতি বছরের মধ্যে জাপানি মুদ্রা ইয়েনের মূল্য মার্কিন ডলারের বিপরীতে ২৬ শতাংশ কমেছে। এছাড়া এশিয়ার আরেক বড় অর্থনীতির দেশে ভারতের মুদ্রা রুপির দামও এক বছরের মধ্যে ৯ শতাংশ পড়ে গেছে। হংকং-সাংহাই ব্যাংকিং করপোরেশনের (এইচএসবিসি) এশিয়া অঞ্চলের প্রধান অর্থনীতিবিদ ফেড্রিক নিউম্যান বলেছেন, ফেডারেল রিজার্ভেও কঠোর নীতির কারণে এশিয়ায় তার আঁচ লেগেছে। এ অঞ্চলের বড় দেশগুলোর সামষ্টিক অর্থনীতির জোর থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা কতটুকু ধরে রাখা যায় সেটি বিবেচ্য। কিছু কিছু অর্থনৈতিক বিশ্লেষক এও বলছেন যে, পরিস্থিতি এখন এশিয়ার দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নেই। শেষ পর্যন্ত এটি একটি মন্দাবস্থার দিকে যাচ্ছে। মর্গান স্টান্টলির এশিয়ার অর্থনীতির বিশ্লেষক চেতন অঞিয়া বলেছেন, মার্কিন ডলারের শক্ত অবস্থান অব্যাহত থাকলে এশিয়ার পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যাবে।
কি ব্যবস্থা নিচ্ছে দেশগুলো
১৯৯৭ সালের অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশগুলোও বসে নেই। অনেক দেশই অর্থনীতিতে টাকা ঢেলেছে। জাপানের অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে তারা অর্থনীতিতে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মতো জোগান দিয়েছে। এতে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হবে বলে মনে করছে তারা। ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয়ও এ পর্যন্ত ৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরছ করেছে। গত সপ্তাহে দেশটির অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন বলেছেন, মার্কিন ডলারের সঙ্গে ভারতীয় রুপির তাল মেলাতে তার সরকার আরো ব্যবস্থা নেবে। তবে চীন কি পরিমাণ করেছে তা এখনো খোলাসা করেনি। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পিপলস ব্যাংক অব চায়না ইউয়ান ব্যবসায়ীদের এ বলে সতর্ক করে দিয়েছে যে, কিছুটা রয়ে সয়ে না গেলে ডলারের বিপরীতে বাজিতে তারা হারবে।
সামনে আরো বিপদ
কোন কোন অর্থনীতিবিদ বলেছেন, এশিয়ার সামনের পরিস্থিতি ১৯৯৭ সালের মতো নাও হতে পারে। এএনজেড রিচার্স বিভাগের এশিয়া প্রধান খুন গহ বলেছেন, এসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় এশিয়ার ঐতিহ্য আছে। অনেক দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির বুনিয়াদ শক্ত। তবে দেশগুলোর বৈদেশিক ঋণ এখানে চিন্তার বিষয়। এছাড়া দেশগুলোর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সহজে একেবারে তলানিতে নেমে যাবে বলেও মনে হয় না।
কিন্তু এ অঞ্চলের দেশগুলোর শঙ্কা একেবারেই যে নেই তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার আরো বাড়ালে মার্কিন ডলার আরো চড়ে যাবে। দেশগুলোর প্রবৃদ্ধিও কমবে। বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি কয়েকটি দেশের মোট দেশজ উত্পাদনের প্রবৃদ্ধি প্রক্ষেপণ করেছে। এতে দেখা যায়, এই অঞ্চলের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি পাঁচ শতাংশ থেকে নেমে তিন দশমিক দুই শতাংশে নেমে যাবে। ২০২৩ সালে তা একটু বাড়তে পারে।
বাংলাদেশের অবস্থা কেমন?
বিশ্ব অর্থনীতিতে যে মন্দা তা থেকে বাংলাদেশও যে একেবারে মুক্ত সে কথা বলা যাবে না। প্রায় দেড় বছর ডলারের দর ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় স্থিতিশীল থাকলেও গত বছরের আগস্ট থেকে তা বাড়তে থাকে। খোলা বাজারে একপর্যায়ে ১২০ টাকা থেকে ১২১ টাকায় লেনদেন হতে দেখা যায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেও পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ এখন ৩৭ বিলিয়ন ডলারের নিচে। গত বছরের ২৫ আগস্ট রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৮ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে প্রায় ১১ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার।
২১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত প্রতিবেদনে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উত্পাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। বৈশ্বিক অর্থনীতির শ্লথগতি এবং স্থানীয় পর্যায়ে মানুষের ভোগ ব্যয় কমে যাওয়ায় গত অর্থবছরের চেয়ে প্রবৃদ্ধি কমে আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দুই বছরের কোভিড-১৯ এর ধাক্কার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে সংকটের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এ অবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হলে সেটা সন্তোষজনক। সূত্র : ইত্তেফাক।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।