রাতের অন্ধকারে চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করছে সাঙ্গু নদীর জলরাশি। কয়েকজন তরুণ-তরুণী হাতে প্যাডেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রাবিং বোটে। হঠাৎ একজনের কণ্ঠে উচ্ছ্বাস: “আরে, হেলমেটটা ভুলেই গেছি!” অ্যাডভেঞ্চারের এই মুহূর্তে সামান্য একটি ভুলই ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ পরিণতি। বাংলাদেশের পাহাড়, নদী, সমুদ্র—প্রকৃতির কোলে লুকিয়ে আছে রোমাঞ্চের অসংখ্য সম্ভাবনা। কিন্তু সেই রোমাঞ্চ যখন প্রাণঘাতী বিপদে রূপ নেয়, তখনই বোঝা যায় অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস গাইড ও প্রাথমিক টিপস জানা কতটা জরুরি। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের রিপোর্ট বলছে, শুধুমাত্র সেন্ট মার্টিন ও কক্সবাজারে ডাইভিং ও কায়াকিং এর সময় প্রাথমিক সতর্কতা না জানার কারণে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার হার বেড়েছে ৩০%। এই গাইডে আমরা শিখব কীভাবে নিরাপদে উপভোগ করবেন অ্যাডভেঞ্চারের রোমাঞ্চ।
অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস গাইড: কেন প্রাথমিক টিপস জানা জরুরি?
“একটা রক ক্লাইম্বিং সেশনে নতুন এক অংশগ্রহণকারী সেফটি হার্নেস সঠিকভাবে বাঁধতে না জানায় মাটি থেকে মাত্র দেড় মিটার উঁচুতেই পড়ে গিয়ে হাঁটু ভেঙে ফেলেন,” বলছিলেন ঢাকার ‘পিক অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব’-এর প্রধান প্রশিক্ষক রিফাত হোসেন। বাংলাদেশে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জনপ্রিয়তা বাড়লেও প্রাথমিক জ্ঞানের অভাব এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। ইন্টারন্যাশনাল মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ক্লাইম্বিং ফেডারেশন (UIAA) এর মতে, ৭০% এর বেশি অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস দুর্ঘটনার মূল কারণ প্রাথমিক প্রস্তুতি ও সতর্কতার অভাব।
প্রাথমিক টিপস শেখা কেন অপরিহার্য:
- জীবনরক্ষাকারী সিদ্ধান্ত: সেন্ট মার্টিনে স্নরকেলিংয়ের সময় কারেন্টের দিক বোঝা বা বান্দরবানে ট্রেকিং রুটে আবহাওয়া পরিবর্তনের লক্ষণ চিনতে পারা সরাসরি প্রাণ বাঁচাতে পারে।
- আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি: সঠিক গাইডলাইন জানা মানসিক ভয় কমায়। রাবিং বা কায়াকিং এ প্যাডেল ধরা, শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখার মৌলিক কৌশল রপ্ত করলে আনন্দ দ্বিগুণ হয়।
- সুবিধাজনক অভিজ্ঞতা: অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে ভরে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার চেয়ে একটি ভালো অ্যাডভেঞ্চার গাইড অনুসরণ করে শুধু প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিলে ভ্রমণ হয় আরামদায়ক।
- স্থানীয় পরিবেশ রক্ষা: রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্যে ট্রেকিংয়ের সময় প্লাস্টিক ফেলা বা শৈলশহর রাঙামাটিতে বোট ক্যাম্প ফায়ার করার সময় সতর্কতা—এসব প্রাথমিক টিপস প্রকৃতি সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে।
অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি: আপনার সফলতার ভিত্তি
শারীরিক প্রস্তুতি: শরীরই আপনার প্রধান সরঞ্জাম
লালাখাল ট্রেইলে প্রথম দিনেই হাঁপিয়ে উঠেছিলেন রিয়াদ ভাই। পরের দিনের ১৬ কিলোমিটার ট্রেক তিনি শেষই করতে পারেননি,” শেয়ার করলেন ট্রাভেলার নুসরাত জাহান। বাংলাদেশের ট্রেকিং রুটগুলো যেমন বান্দরবানের কেওক্রাডং বা নীলগিরির উচ্চতা, কিংবা কক্সবাজারে সার্ফিং এর শারীরিক চাহিদা অবমূল্যায়ন করা মারাত্মক ভুল।
ফিটনেস প্ল্যান:
- কার্ডিওভাস্কুলার সহনশীলতা: সপ্তাহে ৩-৪ দিন ৩০-৪৫ মিনিট দৌড়, সাইক্লিং বা দ্রুত হাঁটা। লক্ষ্য রাখুন হৃদস্পন্দন যেন টার্গেট জোনে (১৭০ বিয়াম আপনার বয়স) থাকে।
- শক্তি প্রশিক্ষণ: স্কোয়াট, লাঞ্জ, পুশ-আপ, প্ল্যাঙ্ক—এগুলো পা, কোর ও উপরের শরীর শক্তিশালী করবে। বিশেষ করে রক ক্লাইম্বিং বা কায়াকিং এর জন্য।
- নমনীয়তা: প্রতিদিন স্ট্রেচিং, বিশেষ করে হ্যামস্ট্রিং, কাঁধ ও পিঠের পেশী। ইয়োগা অ্যাডভেঞ্চারারের সেরা বন্ধু।
- বাস্তব অভিজ্ঞতা: ঢাকার বলধা গার্ডেনে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা, সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে সিঁড়ি ট্রেনিং, বা শহরের পার্কে হাঁটার পথে ব্যাকপ্যাক নিয়ে ওজন বহন অনুশীলন করতে পারেন।
মানসিক প্রস্তুতি: ভয়কে জয় করার কৌশল
“কাপ্তাই লেকে প্রথমবার কায়াক করতে গিয়ে পানিতে পড়ে যাওয়ার ভয়ে হাত-পা কাঁপছিল,” স্বীকার করলেন অ্যাডভেঞ্চারার তানজিনা তাসনিম। “কিন্তু প্রশিক্ষক যে শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম শিখিয়েছিলেন, সেটাই আমাকে শান্ত করেছিল।”
মাইন্ড ম্যানেজমেন্ট টিপস:
- শ্বাসের শক্তি: ৪-৭-৮ পদ্ধতি (৪ সেকেন্ড শ্বাস নিন, ৭ সেকেন্ড ধরে রাখুন, ৮ সেকেন্ডে ছাড়ুন) তাৎক্ষণিক উদ্বেগ কমায়।
- ভিজ্যুয়ালাইজেশন: ঘরে বসে মনে মনে আপনার ট্রেক, ক্লাইম্ব বা সার্ফিং সেশনের ইতিবাচক পরিণতি কল্পনা করুন।
- ধাপে ধাপে লক্ষ্য: বিশাল চূড়ার দিকে না তাকিয়ে ছোট ছোট মাইলফলকে মনোযোগ দিন। “এবার শুধু ওই বাঁকটা পার হওয়া,” এই মনোভাব।
- ভুলকে ভয় না করা: বিখ্যাত পর্বতারোহী এডমন্ড হিলারির উক্তি মনে রাখুন: “এটা ভয় নয়, ভয়ের মুখোমুখি না হওয়াই ব্যর্থতা।”
গিয়ার ও সরঞ্জাম: আপনার জীবনরক্ষাকারী সহচর
“ভুল হাইকিং বুট পরায় নীলাচল ট্রেইলে পায়ে ফোসকা পড়ে ট্রেকিং ভাঙতে হয়েছিল,” বললেন শিক্ষার্থী আরাফাত রহমান। উপযুক্ত গিয়ার নির্বাচন কোনো বিলাসিতা নয়, বাধ্যতামূলক।
অপরিহার্য গিয়ার চেকলিস্ট:
সরঞ্জামের ধরন | উদাহরণ | কেন গুরুত্বপূর্ণ | বাংলাদেশে কোথায় পাবেন |
---|---|---|---|
পাদুকা | হাইকিং বুটস, ওয়াটার শুজ | পা রক্ষা, পিচ্ছিল পথে গ্রিপ | ঢাকার বনানী, উত্তরা বা চট্টগ্রামের এজিআই শপিং মলে বিশেষায়িত দোকান |
সুরক্ষা | হেলমেট, লাইফ জ্যাকেট, হ্যারনেস | মাথা ও শরীর রক্ষা | বাংলাদেশ অ্যাডভেঞ্চার কাউন্সিল অনুমোদিত সরবরাহকারী বা অভিজাত স্পোর্টস শপ |
উপযুক্ত পোশাক | ময়েশ্চার-উইকিং টি-শার্ট, কুইক-ড্রাই শর্টস, রেইন জ্যাকেট | তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, আরাম | ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম (Daraz, Pickaboo) বা ব্র্যান্ড আউটলেট |
প্রাথমিক চিকিৎসা কিট | ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক, ব্যথানাশক, প্লাস্টার | জরুরি চিকিৎসা সহায়তা | নিজে তৈরি করুন বা ফার্মেসি থেকে কিনুন |
ন্যাভিগেশন | টপোগ্রাফিক্যাল ম্যাপ, কম্পাস (ফোনের জিপিএস ব্যাকআপ হিসাবে) | পথ হারানো এড়ানো | বাংলাদেশ জরিপ অধিদপ্তরের ম্যাপ বা গুগল ম্যাপস অফলাইন ডাউনলোড |
বাংলাদেশে গিয়ার কেনার টিপস: স্থানীয় ব্র্যান্ড যেমন ‘ব্লেড’ বা ‘ট্রেক বাংলাদেশ’ ভালো মানের ও সাশ্রয়ী বিকল্প দেয়। ঢাকার দামুন্দিয়া লেকের নিকটবর্তী দোকানগুলোতে হাইকিং গিয়ারের ভালো সংগ্রহ আছে। কিনতে যাওয়ার আগে বাংলাদেশ অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইটে গিয়ার রেটিং চেক করুন।
নিরাপত্তা ব্যবস্থা: অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসে সুরক্ষা নিশ্চিত করার মূলনীতি
প্রশিক্ষক ও গাইড নির্বাচন: আপনার জীবনের দায়িত্ব যাঁর হাতে
সাজেক ভ্যালিতে এক ‘অভিজ্ঞ’ গাইডের ভুল নির্দেশনায় পথ হারিয়ে ১২ ঘণ্টা আটকে থাকার ঘটনা এখনও সবার মনে আছে। একটি ভালো অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস গাইড শুধু রোমাঞ্চই দেন না, দায়িত্বও নেন।
গাইড নির্বাচনের মানদণ্ড:
- প্রমাণিত যোগ্যতা: দেখুন বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন (বিপিজিসি) বা বাংলাদেশ অ্যাডভেঞ্চার কাউন্সিল (BAC) এর সার্টিফিকেশন আছে কি না।
- স্থানীয় জ্ঞান: যিনি শুধু রাস্তা চেনেন না, আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা, স্থানীয় উদ্ভিদ-প্রাণী ও জরুরি প্রোটোকলও জানেন।
- প্রথম সাহায্যে দক্ষতা: বেসিক ফার্স্ট এইড, সিপিআর, স্নেক বাইট বা অ্যালার্জিক রিয়াকশন ম্যানেজমেন্ট জানা আবশ্যক।
- কমিউনিকেশন স্কিল: স্পষ্ট, ধৈর্য্যশীল ও ইতিবাচক যোগাযোগের ক্ষমতা। বিপদের সংকেত কীভাবে দেবেন, তা আগে থেকে জিজ্ঞাসা করুন।
আবহাওয়া ও পরিবেশগত সচেতনতা: প্রকৃতির সংকেত বুঝুন
“সুন্দরবনে কায়াকিং করতে গিয়ে হঠাৎ কালবৈশাখীর মুখে পড়েছিলাম,” স্মরণ করছিলেন পরিবেশকর্মী ম Marin Khan। “আগে থেকে আবহাওয়া অ্যাপ ও স্থানীয় মৎস্যজীবীদের সঙ্গে কথা বলে সতর্ক হওয়া উচিত ছিল।”
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সতর্কতা:
- মৌসুম বুঝে যাত্রা: জুন-সেপ্টেম্বর মৌসুমি বৃষ্টি ও বন্যার সময় পাহাড়ি অঞ্চলে ট্রেকিং বিপজ্জনক। অক্টোবর-মার্চ আদর্শ সময়। সাগরে ডাইভিং/সার্ফিং নভেম্বর-ফেব্রুয়ারিতে ভালো।
- স্থানীয় তথ্য: স্থানীয় বন কর্মী, জেলে বা গ্রামবাসীরা প্রকৃতির পরিবর্তন সম্পর্কে সেরা তথ্য দিতে পারেন। তাঁদের অবমূল্যায়ন করবেন না।
- জরুরি প্রস্তুতি: বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের (DDM) মোবাইল অ্যাপ ড্যাশ ডাউনলোড করুন। এতে স্থানীয় সতর্কতা ও জরুরি নম্বর পাবেন।
- প্রাণী ও উদ্ভিদ: সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চট্টগ্রামের পাহাড়ে সাপ বা বিষাক্ত গাছগাছড়া সম্পর্কে আগে থেকে পড়াশোনা করুন। বাংলাদেশ বন বিভাগের গাইডলাইন ফলো করুন।
জনপ্রিয় অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস এবং তাদের জন্য বিশেষ টিপস
রক ক্লাইম্বিং: উঁচুতে উঠার কৌশল (বান্দরবান, চন্দ্রঘোনা)
“বগা লেকের কাছে ছোট পাহাড়ে ক্লাইম্বিং শিখতে গিয়ে বুঝেছিলাম, পায়ের কারিশমাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, হাত নয়,” বললেন ক্লাইম্বার শিহাব শারার।
বাংলাদেশি ক্লাইম্বারদের জন্য টিপস:
- থ্রি-পয়েন্ট কন্টাক্ট: সর্বদা দুই পা ও এক হাত, বা দুই হাত ও এক পা—এভাবে তিনটি যোগাযোগ বিন্দু শিলার সঙ্গে রাখুন।
- পায়ের কাজ: পায়ের আঙুলের ডগায় ভর দিয়ে হালকা ভাবে দাঁড়ান। পা দিয়ে ঠেলে উঠুন, হাত দিয়ে টানবেন না।
- চোখ উপরে: পরবর্তী হোল্ড বা পা রাখার জায়গা আগে থেকে চিহ্নিত করুন। নিচে বা পিছনে তাকাবেন না।
- স্থানীয় প্রস্তুতি: চন্দ্রঘোনার রক ক্লাইম্বিং সেন্টারে শুরু করুন। বাংলাদেশ মাউন্টেইনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের (BMTC) ওয়ার্কশপে অংশ নিন।
র্যাফটিং / কায়াকিং: স্রোতের সঙ্গে নাচ (সাঙ্গু, মাতামুহুরী, কাপ্তাই)
“সাঙ্গু নদীতে র্যাফ্টিং করতে গিয়ে বুঝলাম, ‘হাই-সাইড’ ও ‘লো-সাইড’ কমান্ড না জানলে দল কাজ করতে পারে না,” জানালেন দলনেতা ফাহিম আহমেদ।
নৌকাভিত্তিক অ্যাডভেঞ্চারের মূল টিপস:
- প্যাডলিং মেকানিক্স: প্যাডেলের শ্যাফটে এক হাত উপরে (টি-গ্রিপ), অন্য হাত নিচে। শরীর ঘুরিয়ে, বাহু না গুঁজে শক্তি প্রয়োগ করুন।
- ক্যাপসাইজ ড্রিল: ইচ্ছাকৃতভাবে নৌকা উল্টে জলে পড়া ও তা সোজা করার অনুশীলন করুন। আত্মবিশ্বাস বাড়বে।
- স্রোত পড়া: পানির রঙ (গাঢ় = গভীর), বুদবুদ বা ভাসমান ডালের গতিপথ দেখে স্রোতের দিক ও শক্তি বুঝুন।
- স্থানীয় সহায়তা: কাপ্তাই লেকে ‘কর্ণফুলী কায়াকিং অ্যাসোসিয়েশন’ বা রাঙ্গামাটিতে ‘সাঙ্গু র্যাফটার্স’ এর মতো স্থানীয় অপারেটরদের সাথে যোগাযোগ করুন।
ট্রেকিং / হাইকিং: পায়ে পায়ে পথ খোঁজা (কেওক্রাডং, নীলগিরি, সাজেক)
“নাফাখুমে ট্রেক করতে গিয়ে ডিহাইড্রেশনে প্রায় জ্ঞান হারাচ্ছিলাম,” স্বীকার করলেন ভ্রমণপিপাসু সাদিয়া ইসলাম। “পানির বোতল শেষ হওয়ার আগেই রিফিলের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল।”
ট্রেকারদের জন্য স্বর্ণালি নিয়ম:
- প্যাকিং স্মার্ট: ব্যাকপ্যাকের ওজন আপনার শরীরের ওজনের ২০% এর বেশি না হওয়াই ভালো। ভারী জিনিস কাছাকাছি রাখুন (পিঠের দিকে)।
- হাইড্রেশন ও পুষ্টি: প্রতি ৩০ মিনিটে এক-দুই চুমুক পানি। এনার্জি বার, ড্রাই ফ্রুটস, চিনাবাদাম নিয়মিত খান।
- লিভ নো ট্রেস: আপনার সমস্ত আবর্জনা ব্যাগে নিয়ে ফিরুন। প্লাস্টিক বর্জ্য বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকার জন্য ভয়াবহ হুমকি।
- স্থানীয় নির্দেশিকা: বান্দরবান বা রাঙ্গামাটিতে ট্রেকিং এর আগে স্থানীয় ফরেস্ট অফিস থেকে অনুমতি নিন। বাংলাদেশ ইকোট্যুরিজম প্রকল্পের ওয়েবসাইটে অনুমোদিত রুট খুঁজুন।
সার্ফিং ও অন্যান্য: কক্সবাজারের পেঁজা পয়েন্ট বা ইনানী বিচে সার্ফিং শিখুন স্থানীয় ক্লাব (Bangladesh Surf Club) এর মাধ্যমে। শুরু করুন বডি বোর্ডিং দিয়ে, তারপর স্ট্যান্ড-আপ প্যাডেল বোর্ডিং (SUP), শেষে সার্ফ বোর্ড। সবসময় লিশ (পায়ের রশি) বেঁধে রাখুন।
অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস গাইড শুধু কৌশল শেখায় না, শেখায় প্রকৃতির কাছে বিনয়ী হতে। এই গাইডের প্রতিটি প্রাথমিক টিপস আপনার অভিজ্ঞতাকে নিরাপদ ও আনন্দময় করবে। মনে রাখবেন, সবচেয়ে সাহসী অ্যাডভেঞ্চারাররাই সবচেয়ে বেশি প্রস্তুত হন। আজই শুরু করুন—একটি নির্ভরযোগ্য অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব খুঁজুন, ছোট্ট একটি হাইকিং দিয়ে যাত্রা করুন, এবং নিজের সীমাকে চিনতে শিখুন। প্রকৃতির রোমাঞ্চ অপেক্ষা করছে, কিন্তু সাবধানের মার নেই!
জেনে রাখুন
১. বাংলাদেশে কোন অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্য বয়সের সীমাবদ্ধতা আছে?
বাংলাদেশে সাধারণত ১২ বছরের নিচে শিশুদের উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস (যেমন রক ক্লাইম্বিং, র্যাফ্টিং) করার সুপারিশ করা হয় না। ১২-১৮ বছর বয়সীদের অবশ্যই অভিভাবকের লিখিত সম্মতি ও প্রশিক্ষকের তত্ত্বাবধানে অংশ নিতে হবে। বাংলাদেশ প্যারাগ্লাইডিং অ্যাসোসিয়েশনের নিয়ম অনুযায়ী প্যারাগ্লাইডিং এর ন্যূনতম বয়স ১৬ বছর। সবচেয়ে ভালো হয় সরাসরি নির্ভরযোগ্য অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব বা অপারেটরের সাথে যোগাযোগ করে তাদের নীতিমালা জেনে নেওয়া।
২. অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্য শারীরিক ফিটনেস লেভেল কীভাবে নিজেই পরীক্ষা করব?
আপনি নিজেই কয়েকটি সহজ পরীক্ষা করতে পারেন। ট্রেকিং এর জন্য: ৩০ মিনিটে ৩ কিলোমিটার হাঁটুন পাহাড়ি রাস্তা বা সিঁড়িতে (ঢাকায় স্মৃতিসৌধ ভালো জায়গা), যদি শ্বাসকষ্ট বা অতিরিক্ত ক্লান্তি না হয় তবে ধরে নিন মৌলিক ফিটনেস আছে। ক্লাইম্বিং এর জন্য: দরজার চৌকাঠে ঝুলে থাকুন (চিন-আপ), কমপক্ষে ৩০ সেকেন্ড ধরে রাখতে পারা উচিত। কার্ডিও ফিটনেসের জন্য: সিঁড়ি দিয়ে ৪ তলা দ্রুত উঠুন, হৃদস্পন্দন ৫ মিনিটের মধ্যে স্বাভাবিক হওয়া উচিত। সন্দেহ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৩. বাংলাদেশে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের সময় জরুরি অবস্থায় কী করব?
প্রথমেই গাইড বা দলনেতাকে জানান। বাংলাদেশের রিমোট অ্যাডভেঞ্চার স্পটে (যেমন বান্দরবানের দূরবর্তী ট্রেইল) মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকতে পারে। তাই সবসময় একটি স্যাটেলাইট ফোন বা ইপিআইআরবি (ইমার্জেন্সি পজিশন ইন্ডিকেটিং রেডিও বীকন) ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করুন। জরুরি নম্বর (৯৯৯) ডায়াল করুন। স্থানীয় ফরেস্ট অফিস, আর্মি ক্যাম্প বা ইউনিয়ন পরিষদের সাহায্য নিন। প্রাথমিক চিকিৎসা কিট এবং স্থানীয় ভেষজ গাছ (যেমন নিম পাতা জীবাণুনাশক) সম্পর্কে জ্ঞান রাখুন।
৪. বাংলাদেশে অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসের জন্য বীমা করা যায় কি?
হ্যাঁ, তবে তা সাধারণ ভ্রমণ বীমা থেকে আলাদা। কিছু আন্তর্জাতিক কোম্পানি (World Nomads, AXA) হাই-রিস্ক অ্যাক্টিভিটি কভারেজ দেয়, কিন্তু বাংলাদেশে দাবি প্রক্রিয়া জটিল হতে পারে। স্থানীয়ভাবে বাংলাদেশ জেনারেল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড (BGIC) বা সাদার্ন ইন্স্যুরেন্স কিছু অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস কভারেজ দিতে শুরু করেছে। সরাসরি কোম্পানির শাখায় যোগাযোগ করে পলিসির বিস্তারিত জেনে নিন, বিশেষ করে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, স্থায়ী অক্ষমতা ও মেডিকেল ইভাকুয়েশনের কভারেজ আছে কিনা।
৫. বাংলাদেশে অ্যাডভেঞ্চার গিয়ার ভাড়া করা কি নিরাপদ?
ভাড়া নেওয়া যায়, তবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবশ্যই কয়েকটি জিনিস খেয়াল করুন: সরঞ্জামের বয়স ও অবস্থা (চাক্ষুষ পরিদর্শন করুন, ফাটল বা ক্ষয় আছে কিনা দেখুন), সরবরাহকারীর রেপুটেশন (অনলাইন রিভিউ বা অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবের রেকমেন্ডেশন নিন), সনদপত্র (যেমন হেলমেটে UIAA বা CE স্ট্যান্ডার্ড মার্কিং থাকা জরুরি), এবং মেইনটেনেন্স রেকর্ড (কখন শেষ চেক করা হয়েছিল জিজ্ঞাসা করুন)। লাইফ জ্যাকেট বা হ্যারনেস ভাড়া না নেওয়াই ভালো, এগুলো ব্যক্তিগতভাবে কেনা নিরাপদ।
৬. অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টসে শুরুর জন্য সবচেয়ে সহজ অপশন কোনটি বাংলাদেশে?
বাংলাদেশে শুরু করার জন্য সবচেয়ে সহজ ও নিরাপদ অপশন হল হাইকিং বা ন্যাচার ওয়াকিং। ঢাকা বা চট্টগ্রামের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছোট ট্রেইল দিয়ে শুরু করুন (যেমন: ঢাকার চন্দ্রিমা উদ্যান, চট্টগ্রামের ফয়’স লেক)। এরপর গ্রুপ ট্যুরে সহজ ট্রেকিং (বান্দরবানের বগা লেক, রাঙ্গামাটির ঝুলন্ত সেতু)। এরপর ধীরে ধীরে এগিয়ে কায়াকিং (কাপ্তাই লেক), তারপর র্যাফ্টিং (সাঙ্গু) বা রক ক্লাইম্বিং (চন্দ্রঘোনা)। বাংলাদেশ অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব বা ‘ট্রেক বাংলাদেশ’ এর মতো সংগঠনের নভিস প্রোগ্রামে অংশ নিন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।