পৃথিবীর ঠিক কাছের নীল আকাশ যেন জলাভূমির ওপরে ভোরের কুয়াশার মতো। আর নীল আকাশটা যেমন ভাবা গিয়েছিল মোটেই তেমন পুরুও নয়—মাত্র ৩০ কিলোমিটার। তাকে বিঁধানো আদৌ কঠিন নয়। তবে কি না কোনো ফুটোও থাকছে না। তা ধোঁয়া বা কুয়াশার মধ্যে ফুটো থাকেই বা কী করে?
তাহলে দাঁড়াচ্ছে এই যে আকাশ আছে দুটো—দুটো সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের। একটা নীল, যেটা আমাদের কাছাকাছি, আরেকটা কালো, ওই আকাশের পেছনে, ‘দ্বিতীয় সারিতে’। অথচ আমরা কিনা ভেবেছিলাম একই ‘ছাদ’ দিনে আর রাতে রং বদলায়। দেখা যাচ্ছে কালো ‘ছাদটা’ দিনের বেলায়ও কালো। সেটা দিন-রাত সব সময়ই নিজের জায়গায় আছে। তারাগুলোও তার গায়ে সবসময় জ্বলে। কেবল দিনের বেলায় নীলাকাশ তাকে আমাদের কাছ থেকে আড়াল করে রাখে।
বায়ু স্বচ্ছ তবে একেবারে স্বচ্ছ নয়। তার ভেতরে বহু ধূলা আছে। যখন অন্ধকার হয় তখন ধূলা দেখা যায় না। রাতে আমরা ধূলা দেখতে পাই না, তাই আমাদের মনে হয় বাতাসই বুঝি নেই আমাদের মাথার ওপরে। কিন্তু দিনের বেলায় বাতাস সূর্যের আলোয় আলোকিত। কোনো ধূলিকণা যখন বাতাসে ভেসে বেড়ায়, তখন তার ওপর আলো পড়লে ঝলমল করতে থাকে একটা ছোট ফুলকির মতো। বাতাস হয়ে ওঠে ঘোলাটে।
একবার মনে করে দেখো, একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে সূর্যরশ্মি এসে পড়লে ধূলিকণায় বাতাস কী রকম ঘোলাটে দেখায়।পৃথিবী ছাড়িয়ে আরও দূরে আমরা উড়তে থাকি। অনেকক্ষণ ধরে চলি। উচ্চতা—১০ হাজার কিলোমিটার। অথচ তারাগুলো এতটুকু কাছে এলো না। কিন্তু পৃথিবীটাকে এখান থেকে দিব্যি ভালো দেখা যাচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি ভূমণ্ডলটা ঠিক যেন একটা সূক্ষ্ম নীল মসলিন কাপড়ে জড়ানো। তার সর্বাঙ্গজুড়ে সূক্ষ্ম নীল আবরণের ঢল নেমেছে।
আমাদের এখন আর বুঝতে বাকি থাকে না এটা কী। এটা হলো ঘোলাটে বাতাস। এই আবরণটার ভেতরে, ঠিক পৃথিবীর বুকে যারা আছে, তাদের কাছে এটা নীল আকাশ। এখন তারা ওখানে, ‘চাঁদোয়ার’ নিচে তারাদের দেখতে পায় না, কিন্তু আমরা দেখতে পাই।
বায়ুর আবরণ বাইরে থেকে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়। তবে পৃথিবী থেকে ৩ হাজার কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত বায়ু আছে। অবশ্য সে বায়ুর স্তর একেবারেই হালকা। আরও ওপরে বাতাস একদম নেই। সেখানে বিরাজ করছে শূন্যতা। শূন্যতা বলতে কী বোঝায়? বায়ুর সঙ্গে শূন্যতার পার্থক্য কোথায়? আসলে পার্থক্যটা বেশ বড় রকমের।
বাতাসে আমরা নিঃশ্বাস নিতে পারি। শূন্যতার মধ্যে নিশ্বাস নেওয়া সম্ভব নয়। শূন্যদেশে আমাদের নিরাপত্তায় পরতে হয় এক বিশেষ ধরনের রবারের পোশাক। কাঁধে-ঝোলানো সিলিন্ডার থেকে ভেতরে বাতাস ছাড়তে হয়। বাতাস ঠান্ডা হতে পারে, আবার গরমও হতে পারে। তাই বাতাসে অনেক সময় আমাদের ঠান্ডা লাগে, অনেক সময় গরম লাগে।
কিন্তু শূন্যতায় সব সময় একই রকমের ঠান্ডা। সেখানে বেশ গরম করে শরীর জড়াতে হয়। হিমের সময় ধুনির সামনে যেমন লাগে শূন্যতায়ও অবস্থাটা হয় তেমনি। এক দিক থেকে সূর্য তোমাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে আবার অন্যদিক থেকে তারাভরা কালো আকাশ তোমার ওপর ‘ঠান্ডা নিশ্বাস’ ছাড়ছে।
নিবাত নিষ্কম্প আবহাওয়ার সামনে একটা পাখির পালক ছুঁড়ে দেখ—পালকটা উড়বে না, সঙ্গে সঙ্গে সামনে এসে পড়ে যাবে। বায়ুর বাঁধা থাকায় উড়তে পারে না। কিন্তু শূন্যতায় সেই বাঁধা নেই। সেখানে আমাদের পালকটা অনেক অনেক দূরে চলে যাবে, যেন ওটা কোনো ভারী লোহার জিনিস।
বাতাসে পাখিরা ওড়ে। শূন্যতায় তাদের হাঁটতে হতো মাটিতে। ডানা সেখানে কোনো কাজে লাগে না। সেখানে তাদের অবলম্বন করার মতো কিছু নেই। এরোপ্লেনও উড়তে পারে না শূন্যতার মধ্যে।
বায়ুর প্রলেপ লাগানো ভূমণ্ডলের চারপাশের এই শূন্যতাকে বলা হয় মহাশূন্য। সাধারণভাবে তাকে নিছক ‘মহাকাশ’ নামেও অভিহিত করা হয়। এখন দেখা যাচ্ছে এই শূন্যতার মধ্যে আমরা যেকোনো দিকে, যত দূরেই যাই না কেন, এক মাস, এক বছর, এমনকি হাজার বছর উড়লেও শূন্যতার শেষে, মহাকাশের শেষে, ‘কালো ছাদটার’ শেষে আমরা কস্মিনকালে পৌঁছাতে পারব না।
মহাকাশের বুকে পৃথিবী হলো অকূল সমুদ্রে ভাসমান একটি দ্বীপের মতো। মহাকাশে আরও ‘দ্বীপ’ আছে। পৃথিবী থেকে তাদের দেখা যায়। তারা হলো চন্দ্র-সূর্য-তারা। এদের কাছে পৌঁছানো যায়। কিন্তু এদের পরেও আবার আছে সেই শূন্যতা।শূন্যতার কোনো শেষ নেই। ‘কালো ছাদ’ বলে আদৌ কিছু নেই—না পাথরের, না স্ফটিকের। এই কারণে ফুটো করা যায় কেবল নীলাকাশটা। সে কাজটা মোটে কঠিন নয়। এই নীলাকাশ আমাদের খুবই কাছে। আর তা ‘কোমল’—ধোঁয়ার মতো, কুয়াশার মতো।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।