জুমবাংলা ডেস্ক: আজব এক গ্রাম। এই গ্রামে রয়েছে কর্ণাটকের ধরওয়াড় জেলায়। নাম ভদ্রপুর। এই গ্রামেই জন্ম নিয়েছে আমেরিকা, জাপান, হাইকোর্ট, ইংলিশ, হোটেল, ডলার, সুপ্রিমকোর্ট, অনিল কাপুর, সোনিয়া গান্ধি, ওবামা, গুগল, ফেসবুক। বিশ্বাস হচ্ছে না? বিশ্বাস না হলেও সত্যি।
সব কয়টা সত্যি কথা। চন্দ্র, সূর্য, হিমালয়, ভারত মহাসাগর, বিরিয়ানি, এগ চিকেন রোল যেমন চিরন্তন সত্য, ভদ্রপুর গ্রামের এই নামগুলোও ঠিক তেমনই সত্য। উইলিয়ম শেক্সপিয়র সাহেবের “নামে কিবা এসে যায়” উক্তিকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে পারে এই গ্রাম এবং গ্রামের বাসিন্দারা।
বেঙ্গালুরু থেকে প্রায় ৪১৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ভদ্রপুর গ্রাম। হয়তো আপনি গ্রামে ঢুকেছেন, দেখলেন তিন বছরের সোনিয়া গান্ধি শাহরুখ, অমিতাভ আর অনিল কাপুরের সঙ্গে পার্কে দোলনা চড়ছে। স্কুলের প্রথম দিন থেকেই আমেরিকা ও জাপান বেস্ট ফ্রেন্ড। গুগুল আর ফেসবুক একসঙ্গে বলে লেমন রাইস খায়। হাইকোর্ট আর সুপ্রিমকোর্ট হয়তো দুই ভাই বোন। আসলে এই গ্রামের বাসিন্দারা তাদের সন্তানদের এই রকমই নামকরণ করে থাকেন।
এই গ্রামে বসবাসকারী জনজাতিদের নামটিও বেশ মজার। হাক্কি পিক্কি। এই হাক্কি পিক্কি উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যেই নামকরণের অদ্ভুত রীতির প্রচলন রয়েছে। সন্তান জন্মের পর তার মুখ দেখে তার বাবার মনে প্রথমেই যা মনে আসে সেটাই হয় সন্তানের নাম। নামকরণের অদ্ভুত এই রীতি হাক্কি পিক্কিদের মধ্যে যুগ যুগ ধরে প্রচলিত। তবে মজাদার নামকরণের রীতি চালু হয়েছে ১০ বছর আগে।
এক সময়ে কর্ণাটকের বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে ছিল হাক্কি পিক্কি জনজাতির বাস। এই জাতি মূলত যাযাবর। বর্তমানে কর্ণাটকের ভদ্রপুর গ্রামে এঁরা বসবাস করেন। দেখা মেলে। এই সম্প্রদায়ের উপজাতিরা মূলত জঙ্গলেই বসবাস করতেন। জঙ্গলের ফল, পাখি, ছোট জীবজন্তু শিকার করেই তাদের জীবন চলত। ১৯৭০ সালে কর্ণাটক সরকার পাখি শিকার নিষিদ্ধ করে দেয়। পাখি শিকার আটকাতে তাদের জঙ্গল থেকে সরিয়ে দেয় প্রশাসন। প্রশাসনের তরফেই হাক্কি পিক্কি উপজাতিদের জন্য আলাদা বসতি স্থাপন করে দেওয়া হয়। এরপর থেকেই তারা ভদ্রপুর গ্রামের বাসিন্দা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হাক্কি পিক্কি উপজাতিদের জীবন ধারাতেও অনেক পরিবর্তন আসে। তারা আশপাশের মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করেন। তাদের মধ্যে আধুনিক চিন্তাধারা গড়ে উঠতে শুরু করে। বর্তমানে হাক্কি পিক্কিদের অনেকেই গ্রামের সরকারি স্কুলে ভর্তি হয়েছে। কেউ কেউ চাকরি করতে গ্রাম ছেড়ে শহরে যান। আবার অনেকে এখনো নিজেদের প্রাচীন সংস্কৃতি আঁকড়ে ধরে জঙ্গলোকীর্ণ গ্রামে বসবাস করেন।
গ্রামে কারও সন্তান হলে তার নামকরণ করেন শিশুর বাবা। উপজাতিদের নিয়ম অনুযায়ী সন্তানের মুখ দেখে বাবার মনে যে কথাটি প্রথম আসে সেটিই হয় সন্তানের নাম। জঙ্গল এবং শিকারই ছিল হাক্কি পিক্কিদের জীবন ধারণের মূল অবলম্বন। তাই অতিতে বিভিন্ন শিকারিদের নামেই নাম রাখা হত সন্তানদের। নামকরণ হত প্রাণী, গাছ, ফুল, ফল-এর নামে। এখনও প্রতিটা পরিবারে নামকরণের সেই রীতিই চলে আসছে। তবে এখন হাক্কি পিক্কিরা শহুরে মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন। বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে অনেক বেশি খোঁজ খবর রাখেন। তাই নামকরণের ধরনও কিছুটা বদলেছে।
এখন আর প্রাণী, ফুল, ফলের নামে শিশুদের নামকরণ হয় না। এখন নামকরণ হয় সেলিব্রিটি, রাজনীতিবিদ, খাবার এবং ট্রেন্ডি কোনো কিছুর নামে আর সেই অনুযায়ী গ্রামের শিশুদের নাম দেওয়া হয়েছে মিলিটারি, কফি, বাস, ট্রেন, ইংলিশ, হোটেল, ডলার, গুগল, ওবামা, সোনিয়া গান্ধি, ব্রিটিশ, অনিল কাপুর, হাইকোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট, এলিজাবেথ, ফেসবুক, শাহরুখ খান, কংগ্রেস, ঘাস আরও কত কী। এমনকি অনেক শিশুর নাম আমেরিকা, জাপান, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, গভর্নমেন্ট। রাজনীতি এবং সিনেমা জগতের তারকাদের নামেও নামকরণ করা হয় এই গ্রামে।
হাক্কি পাক্কিদের জঙ্গলের জীবনে নামকরণ নিয়ে কেউ বিশেষ মাথা ঘামাতো না। প্রশাসন তো নাই-ই। কিন্তু ক্রমে গ্রামের মাজাদার নামকরণ সম্পর্কে আশপাশের এলাকার মানুষরা জানতে পারেন। অনেকেই মজা পান। কেউ কেউ কৌতূহলী হন। অনেকে আবার রেগে যান। ফলে নামকরণ নিয়ে আইনি বাধার মুখোমুখি পড়তে হয় অনেককে। এখন অবশ্য হাক্কি পিক্কি উপজাতিদের নামকরণে ছাড়পত্র দিয়েছে আদালত। ফলে এই সব মজাদার নামেরই ভোটার কার্ড, লাইসেন্স এবং পাসপোর্টও তৈরি হয়ে গিয়েছে হাক্কি পিক্কিদের। আর মজাদার নামকরণের কারণেই গ্রাম হয়ে উঠেছে পর্যটকদের আকর্ষণের স্থান।
নামকরণের জট কাটিয়ে পাসপোর্ট, ভোটার কার্ডের অধিকারী হাক্কি পিক্কিরা নিজেদের এলাকার বাইরেও যাতায়াত করেন। এখানকার প্রায় কয়েকশো বাসিন্দারই ভারতীয় পাসপোর্ট রয়েছে। এঁদের মধ্যে অনেকেই ব্যবসার জন্য প্রচুর ভ্রমণ করেন। মূলত নেপাল, চীন এবং তিব্বতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গেই এঁদের লেনদেন চলে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।