ধর্ম ডেস্ক : আজরাইল শোনো! যারা মৃ’ত্যুর এই হকিকত হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছে তাদের কাছে তো মৃ’ত্যু বন্ধুর হাতের শরবত। তারা কীভাবে দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতা, সৌভাগ্য নিয়ে মত্ত হয়ে থাকবে? তাদের কাছে মরণ মানে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন। কাজেই তাদের কাছে দেহের মরণ মোটেও তিতা নয়। তাদের দৃষ্টিতে মৃ’ত্যু দেহের কারার বন্দিদশা থেকে মুক্তি আর উন্মুক্ত বাগানে উড়াল দেওয়ার সুযোগ এনে দেয়
ফেরেশতা আজরাইল (আ.) আদম তৈরির মাটি আনতে গেলে জমিনের কান্না ও আপত্তির কথা এর আগে আলোচনা করেছি। জমিনের আর্জি ছিল, আজরাইল! আমার বুক থেকে মাটি নেবেন না ঝগড়াটে মানুষ তৈরির জন্য। আপনি আমার প্রতি দয়া করুন। আজরাইল (আ.) অনেকটা শাসনের সুরে জমিনকে বললেন,
আহমকা’নে আয সেনা’ন রা’হমাত মজূ
যা’ন শাহী জূ কা’ন বুয়াদ দর দাস্তে উ
হাতিয়ারের কাছে রহম চেও না আহম্মকের মতো
বাদশাহর কাছে চাও, সব হাতিয়ার যার হস্তগত।
‘দেয়াল পেরেককে বলে, কেন আমার গায়ে বিদ্ধ হও? পেরেক বলে, আমি নই, কে আমাকে তোমার ভেতর বিদ্ধ করছে তার দিকে তাকাও।’
আজরাইল (আ.) জমিনকে বলেন, আমি তার হাতের পুতুল। আমাকে কলসি বানালে তোমাকে পানি দেব। আমাকে খঞ্জর বানালে বুক দীর্ণ করব। যদি ঝরনায় পরিণত করেন সুপেয় পানি বিলাব। আগুন বানালে উত্তাপ দেব। যদি বৃষ্টিতে পরিণত করে সবজির বাগান সাজাব। আমাকে যদি সাপ বানায় ছোবল হানব আর যদি মানুষের বন্ধু বানায় খেদমত করে যাব। আমি তার কুদরতের দুই আঙুলের মাঝখানে কলম স্বরূপ। কাজেই আমার কাছে তুমি কান্নাকাটি করলে কী হবে? তোমাকে ফরিয়াদ জানাতে হবে তারই কাছে। আজরাইল (আ.) জমিনকে এসব তত্ত্বকথায় ব্যস্ত রেখে একমুঠো মাটি তুলে নেন টের পাওয়ার আগে।
বুর্দ তা’ হক তুরবতে বী রায় রা’
তা’ বে মকতব আ’ন গুরীযা’ন পায় রা’
নিয়ে গেলেন আল্লাহর কাছে একমুঠো অবোধ মাটি
পলাতক ছাত্রকে ফিরিয়ে আনা হয় মকতবে যেমনটি।
জমিনকে কথার ভোলে রেখে আজরাইল (আ.) এমনভাবে মাটি নিয়ে গেলেন, যেন মকতব থেকে পলাতক ছাত্রকে কোলে তুলে ফিরিয়ে নেওয়া হলো মকতবে। আজরাইলের এমন কৃতিত্বের জন্য আল্লাহ তাকে পুরস্কৃত করলেন। বললেন, তোমার বিচক্ষণতা দেখে আমার প্রখর জ্ঞানের ফয়সালায় মানুষের প্রাণ হরণ করার দায়িত্বে তোমাকে নিয়োগ দিলাম। আজরাইল (আ.) মিনতি জানিয়ে বললেন, প্রভু হে! মানুষ তো আমাকে শত্রু ভাববে। তাদের প্রাণ হরণকারী তো কখনও তাদের বন্ধু হবে না। প্রভু হে! তুমি কি চাও, মানুষ সারাজীবন আমাকে শত্রু মনে করুক। বললেন, তুমি চিন্তা করো না। তোমাকে শত্রু ভাবার সুযোগ আমি তাদের দেব না। তাদের নানা রোগশোকে আক্রান্ত করব। তখন মনে করবে, তুমি নয়, ওই রোগশোকই তাদের মৃ’ত্যুর কারণ।
আজরাইল বললেন, প্রভু হে! তুমি জান, তোমার এমন বান্দারা আছেন, যারা এসব কারণকে মোটেও পাত্তা দেয় না। কারণ ও উসিলার পর্দা ছেড়ে তাদের দৃষ্টি ঊর্ধ্বলোকে প্রসারিত। আল্লাহ যত রোগ দিয়েছেন তার ওষুধও সৃষ্টি করেছেনÑ এই সত্য তাদের জানা। তাদের কাছে অসুখ-বিসুখ মৃ’ত্যুর কারণ নয়। শীতকালে কম্বল শীত নিবারণ করে; কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা হলে শত কম্বলের ভেতরও শীতার্ত রোগীর দেহে ভূমিকম্প চলে। তখন ডাক্তার কিছুই করতে পারে না।
চোন কাযা’ আ’য়দ তাবীব আবলাহ শাওয়াদ
ওয়াান দাওয়া দর নাফ‘ হাম গোমরাহ শাওয়াদ
তকদিরের ফয়সালা এলে ডাক্তার নির্বোধ হয়ে যায়
অব্যর্থ ওষুধও রোগীর চিকিৎসায় বিভ্রান্ত পথ হারায়।
কাজেই তোমার তত্ত্বজ্ঞানী বান্দারা, যাদের দিব্যদৃষ্টি প্রসারিত তারা তো ঠিকই ধরতে পারবে যে, মৃত্যুর পরোয়ানা আমিই জারি করছি, আসামি পাকড়াও করছি। আল্লাহপাক আজরাইল (আ.) কে সান্ত¡না দিয়ে বললেন, শোনো, আমার তত্ত্বজ্ঞানী যে বান্দাদের কথা বলছ তাদের দৃষ্টি তো তোমার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তারা তোমাকে নিছক হাতিয়ার ও উসিলা মনে করে। তারা জানে, জীবন-মরণ আমারই হাতে। আমিই বান্দার মৃ’ত্যুর হাকিকি কারণ। কোরআন মজিদের এই আয়াতে সে কথাই লেখা আছে।
‘অতঃপর কেন নয়, প্রাণ যখন কণ্ঠাগত হয় এবং তোমরা (মুমূর্ষ ব্যক্তির দিকে) তাকিয়ে থাক (কিছুই করতে পার না), তখন আমি তোমাদের চেয়ে তার অধিক কাছে; কিন্তু তোমরা দেখতে পাও না।’ (সূরা ওয়াকিআ : ৮৩-৮৫)।
আজরাইল! তুমি নিজেকে সাধারণ মানুষের চোখের আড়ালে রাখ সত্য; কিন্তু আমার দিব্যদৃষ্টির বান্দাদের কাছে তুমিও পর্দা ছাড়া আর কিছু নও। সাধারণ মানুষ মনে করে, নানা রোগব্যাধি, দুর্ঘটনা, বার্ধক্য মানুষের মৃ’ত্যুর কারণ। তারা তোমাকে দেখতে পায় না। কিন্তু আমার তত্ত্বজ্ঞানী আরেফ বিল্লাহরা তোমাকে দেখলেও জীবন হরণ ও মৃ’ত্যুর আসল কারণ তোমাকে মনে করে না। তারা জানে, একমাত্র আল্লাহই মানুষকে জীবন দান করেন, মানুষের মৃ’ত্যুও ঘটান তিনিই। আজরাইল তুমি তাদের দৃষ্টিতে আল্লাহর কাজের ওপর পর্দা ও হাতিয়ার।
আজরাইল শোনো! যারা মৃ’ত্যুর এই হকিকত হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছে তাদের কাছে তো মৃ’ত্যু বন্ধুর হাতের শরবত। তারা কীভাবে দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতা, সৌভাগ্য নিয়ে মত্ত হয়ে থাকবে? তাদের কাছে মরণ মানে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন। কাজেই তাদের কাছে দেহের মরণ মোটেও তিতা নয়। তাদের দৃষ্টিতে মৃ’ত্যু দেহের কারার বন্দিদশা থেকে মুক্তি আর উন্মুক্ত বাগানে উড়াল দেওয়ার সুযোগ এনে দেয়। একটি উপমা সামনে আনÑ
দেশের কোনো ক্ষমতাধর কর্তা একদিন বুলডোজার নিয়ে কারাগারের দেওয়ালগুলো গুঁড়িয়ে দিল। কারার দেওয়াল মর্মর পাথরে নির্মিত হলেও কোনো বন্দি কি বলবে, কেন আমাদের কারাগারটি ধ্বংস করলেন, কেন আমাদের মুক্তি দিলেন? সাপের বিষাক্ত ছোবল থেকে উদ্ধার করে কাউকে যদি নিরাপদ প্রান্তরে আনা হয় সে কি আপত্তি করবে?
হ্যাঁ, রুহ যখন দেহের কাঠামোর বন্দিত্ব থেকে মুক্ত হয়, তার দেহের চাহিদা ও প্রয়োজন যখন ফুরিয়ে যায়, তখন দেহের পায়ের সাহায্য ছাড়াই রুহের ডানায় ভর করে উড়াল দেয়। অন্যকথায় আল্লাহর ইবাদত ও বন্দেগির স্বাদ পেয়ে যখন কামনা-বাসনার বন্ধন থেকে রেহাই পায় তখন পার্থিব চাহিদা ও প্রয়োজনের কব্জায় তাকে আর ধরে রাখা যায় না। তার অবস্থা হয় সেই কারারুদ্ধ বন্দির মতো, যে রাতে ঘুমায় আর স্বপ্নে দেখে এক মনোরম বাগানে পায়চারি করছে। সে তখন আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানায়, প্রভু হে! আমাকে দেহের জিন্দানখানায় ফিরিয়ে নিও না। এই বাগানবাড়িতে আমি চিরজীবন থাকতে চাই। আল্লাহ তাকে বলেন, তোমার দোয়া আমি কবুল করলাম। তোমাকে রেখে দিলাম যতনে আমার বাগানে। মওলানা রুমি বলেন,
ইনচুনীন খা’বী বেবীন চোন খোশ বুয়াদ
মর্গে না দীদে বে জান্নাত রওয়াদ
দেখ এমন স্বপ্ন কত মধুর সুখের নন্দন-কানন তলে
মৃ’ত্যু আসার আগেই পাবে জান্নাতের খুশব তাহলে।
যদি কেউ নিদ্রায় এমন স্বপ্ন দেখে আর তাতে মৃ’ত্যুর সঙ্গে সাক্ষাতের আগেই জান্নাতে চলে যায়, তাহলে কতই না মধুর সেই নিদ্রা। যে লোক দেহের কারাগারে বন্দি সে যদি ওই জগতের মধুর স্বপ্ন দেখে তাহলে কী সেই স্বপ্ন ছেড়ে এই জগতে ফিরে আসতে রাজি হবে? নিশ্চয়ই না। কাজেই আধ্যাত্মিকতায় বিশ^াসী হও, প্রত্যয় নিয়ে নফসের সঙ্গে লড়াইয়ের ময়দানে অবতীর্ণ হও। মনেপ্রাণে বিশ^াস কর যে, এই মাটির জগৎ তোমার আসল বাসস্থান নয়, তোমার নিবাস তো আল্লাহর সন্নিধানের ফেরেশতাদের সঙ্গে। সেই ঊর্ধ্বজগতের প্রত্যাশা নিয়ে উঠে দাঁড়াও। দেহের নানা চাহিদা ও বন্ধন ছিন্ন করার উদ্যোগ নাও। জীবনকে আলোকিত করার সাধনায় আত্মনিয়োগ কর।
আশক মী বা’র ও হামী সূয আয তলব
হামচো শমএ সর বুরীদা জুমলা শব
অশ্রু ঝরাও মনের দহনে জ¦লনে অন্বেষণে
প্রদীপের মতো জ¦লো সারা রাত ক্রন্দনে।
তোমার দেহের মাটির গৃহে সারারাত সারাদিন তাকে অন্বেষণের প্রদীপ জে¦লে রাখ। রাত জেগে ইবাদত ক্রন্দন তাহাজ্জুদ নিত্যসঙ্গী বানিয়ে নাও।
লাব ফরোবন্দ আয তাআমো আয শরাব
সূয়ে খা’নে আ’সেমানী কুন শেতা’ব
মুখ বন্ধ কর খাওয়া থেকে, পান করা হতে
উড়াল দাও আসমানি যেয়াফতে যোগ দিতে।
পানাহার করতে হবে যতটুকু না হলে নয় ততটুকু। একথা ঠিক যে, আল্লাহ তায়ালা মানুষের ভোগ ব্যবহারের জন্য প্রচুর খাবার ও পানীয় সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু মানুষকে সৃষ্টি করেননি সবকিছু খাওয়ার বা ভোগ করার জন্য। ‘খাওয়া তো বেঁচে থাকার জন্য, খাওয়ার জন্য বেঁচে থাকা নয়।’ কিন্তু আমাদের অধিকাংশই উদরপূর্তিতে ব্যস্ত। খাওয়ার মুহূর্তকে মনে করি জীবনের সবচেয়ে দামি মুহূর্ত। সত্যিই এমন স্বভাব নিয়ে আধ্যাত্মিক সাধনা অসম্ভব। মানুষ যতক্ষণ খাওয়া-পরাকে অভ্যাসের স্তর থেকে প্রয়োজনের স্তরে নামিয়ে আনতে না পারবে, ততক্ষণ দেহের হারিকেনে রুহের আলোকশিখা নফসের কামনা-বাসনার ঝাপ্টা থেকে নিরাপদ থাকবে না। মওলানা রুমির কাছে খাবারের তেমন গুরুত্ব ছিল না, তাই তিনি ছিলেন ক্ষীণকায়। এই ব্যাখ্যাটুকুন মসনবি গবেষক করীম যামানীর। মওলানা আরও বলেন,
দম বে দম বর আসেমা’ন মী দা’র উমীদ
দর হাওয়ায়ে আসেমান রকসান চো বীদ
দমে দমে রুহের আকাশের বুকভরা আশায় থাক
নীলিমায় ডানা মেলতে হও দেবদারুর মতো নৃত্যরত।
তোমার সত্যিকার রিজিক তালাশ কর আধ্যাত্মিক জগৎ থেকে। তাহলে দমে দমে আসমানি খাবার আসবে তোমার কাছে। তাতে তোমার হৃদয়ের চেতনায় উত্তাপ ও আকর্ষণ অনুভব করতে পারবে। তোমার অন্বেষা যদি তোমাকে নিয়ে যায় আকাশের পানে অবাক হইও না, নিজেকে দুর্বল ভেব না, বরং তোমার অন্বেষার শক্তিতেই বিশ^াসী হও। কারণ তোমার অন্বেষা, আকর্ষণ, তা তো আল্লাহর আমানত। কাজেই তুমি যাকে পেতে চাও তার আন্দাজেই তোমার মূল্যমান নির্ণিত। জেনে রেখ, আশেকের মূল্যায়ন হয় মাশুকের মর্যাদার অনুপাতে। তুমি দিবানিশি চেষ্টায় থাক যাতে এই অন্বেষা দিন দিন বৃদ্ধি পায়, অন্বেষাই তোমাকে মুক্তি দেবে দেহের কারাগার থেকে। তখন রুহের চাহিদা পূরণে তৃপ্তি পাবে দেহের চাহিদার পরিবর্তে।
(মওলানা রুমির মসনবি শরিফ
৫খ. বয়েত-১৬৮৩-১৭৪২)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।