মহাবিশ্বের কেউই যেন শান্তিতে নেই। অস্থিরতার চিহ্ন সর্বত্র। আকাশের দিকে তাকালে আপাতদৃষ্টে মনে হয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড শান্ত, শাশ্বত। কিন্তু সত্যিই কি তাই? একটু তলিয়ে দেখলেই বেরিয়ে পড়ে তার প্রকৃত চেহারা। আধুনিক বিজ্ঞানীদের গবেষণায় ধীরে ধীরে ফুটে উঠছে মহাবিশ্বের অশান্ত রূপ। নক্ষত্রের বিস্ফোরণ থেকে শুরু করে কৃষ্ণগহ্বরের কাছে পদার্থের চরম অবস্থার গবেষণায় এসব তথ্য জানা গেছে। যেমন গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ।
মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলো একে অন্যের থেকে অনেক দূরে থাকলে কী হবে, সেগুলোর মধ্যেও সংঘর্ষ হয়। আমাদের গ্যালাক্সিতেও অতীতের নানা ঘাত–প্রতিঘাতের চিহ্ন রয়েছে। প্রত্নতত্ত্বে যেমন উৎখনন করে প্রাচীনকালের ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায়, তেমনি নক্ষত্রগুলোর সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ থেকে ছায়াপথের অতীতে ভয়ংকর যুগের কথা জানা গেছে।
গ্রীষ্মকালে সন্ধ্যার আকাশে একটি আলোর ফিতা দেখা যায়। পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে বিস্তৃত। শহর থেকে পরিষ্কার দেখা না গেলেও যেখানে আলোর দূষণ কম, সে রকম কোনো জায়গা থেকে দেখতে অসুবিধা হয় না। এই আলোর ফিতার নাম ‘আকাশগঙ্গা’ বা ‘ছায়াপথ’। এই হলো আমাদের গ্যালাক্সি।
আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে বিজ্ঞানীরা প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন যে আমরা রাতের আকাশে যেসব তারা দেখি, সেগুলো অনন্তবিস্তৃত নয়। এই তারার রাজ্যের সীমান্ত আছে। এক জায়গায় গিয়ে সেই রাজ্য শেষ হয়ে গেছে এবং তার অনেক দূরে রয়েছে অন্য তারার রাজ্যগুলো। এগুলো যেন মহাশূন্যে ভাসমান একেকটি দ্বীপ। নক্ষত্রময় দ্বীপ। এই তারার রাজ্যগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে ‘গ্যালাক্সি’।
উল্লেখ্য, গণ্ডিভুক্ত নক্ষত্রের রাজ্যের এই ধারণা একেবারেই নতুন। খুবই আধুনিক। প্রাচীনকালে, এমনকি ১৫০ বছর আগেও জানা ছিল না। তাই তারার রাজ্যগুলোকে এক নতুন নামে গ্যালাক্সি বলে অভিহিত করাটাই সমীচীন। প্রাচীনকালে আকাশের আলোর ফিতা দেখে যে আকাশগঙ্গা বা ছায়াপথ নাম রাখা হয়েছিল, সেটি শুধু আমাদের গ্যালাক্সির জন্যই রেখে দেওয়া উচিত। এতেই ভুল–বোঝাবুঝির আশঙ্কা কম থাকে। হোক না ‘গ্যালাক্সি’ ইংরেজি শব্দ। ধারণাটি যেহেতু নতুন, তাই নতুন শব্দ আমদানি করতে বাধা নেই। বহু বছর আগে ‘গ্যাস’ শব্দটি বাংলায় ব্যবহার করা উচিত কি না, এ নিয়েও আলোচনা হয়েছিল। প্রাচীনকালে একটি গ্যাসই জানা ছিল, ‘বায়ু’।
তাই অনেকে গ্যাস আর বায়ু একই অর্থে ব্যবহার করতেন। সেটা যে বিভ্রান্তিমূলক এবং এর জন্য যে ‘air is a gas’-এর বাংলা অনুবাদ করতে হতে পারে ‘বায়ু একধরনের বায়ু’, সেটা বোঝার পর থেকে গ্যাস শব্দটিই সাধারণ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়ে আসছে। ইংরেজি শব্দ হলেও। এ ক্ষেত্রেও আমরা যদি গ্যালাক্সির বদলে নক্ষত্ররাজ্যের সাধারণ নাম দিই ছায়াপথ, তাহলে ‘আমাদের ছায়াপথের নাম ছায়াপথ’—এমন বাক্যের সম্মুখীন হতে হবে। তাই গ্যালাক্সি শব্দটি ব্যবহার করাই শ্রেয়।
যাহোক, আমরা যদিও ছায়াপথকে ফিতার আকারে দেখি, তার আসল চেহারা কিন্তু অন্য রকম। এর কারণ, আমরা ছায়াপথকে অন্দরমহল থেকে দেখি। বাড়ির ভেতর থেকে দেখলে একটি বাড়ির প্রকৃত রূপ বোঝা যায় না। এখানেও তা–ই। আসলে আমাদের গ্যালাক্সিটি একটি চ্যাপ্টা থালার মতো। অথবা তুলনা করা যেতে পারে একটি চাকতির সঙ্গে। আর আমরা তার কেন্দ্রে নয়, সেখান থেকে দূরে থালার প্রান্তের দিকে এক অঞ্চলে রয়েছি। যেহেতু থালাটি চ্যাপ্টা, তাই আমাদের আকাশে তাকে একটি ফিতার মতো দেখায়।
এই গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ লেগেই থাকে। নিজেদের গতিপথে একে অন্যের কাছে এলেই এ রকম ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষের ফল কী দাঁড়াবে, সেটা অবশ্য নির্ভর করে সেগুলো কত ভারী, তার ওপর। যখন দুটি গাড়ির মধ্যে ধাক্কা লাগে, তখন তার ফলাফল নির্ভর করে দুটি গাড়ির ভরের অনুপাতের ওপর। একটি বিশাল ট্রাকের সঙ্গে ছোট মোটরগাড়ির ধাক্কা লাগলে ট্রাকটির বিশেষ ক্ষতি হওয়ার কথা নয়, বরং ছোট গাড়িটি দুমড়েমুচড়ে যেতে পারে।
আবার দুটি গাড়ি সমান ওজনের হলে, দুটিরই সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। গ্যালাক্সির ক্ষেত্রেও তা–ই। যদি এমন হয় যে একটি গ্যালাক্সির ভর অন্যটির তুলনায় খুব কম, তাহলে বড় গ্যালাক্সিটি ছোটটিকে আত্মসাৎ করে নিতে পারে। ছোট গ্যালাক্সিটি বড়টির মহাকর্ষের টানে তার চারদিকে কয়েকবার ঘোরার চেষ্টা করবে। ধীরে ধীরে মহাকর্ষ তাকে বড়টির কাছে টেনে নিয়ে এসে একসময় তার পেটের ভেতর পুরে ফেলবে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আমাদের ছায়াপথের মধ্যে অনেকগুলো ছোটখাটো গিলে ফেলা গ্যালাক্সির চিহ্ন আছে। এগুলো একসময় ছায়াপথের খুব কাছে এসে পড়েছিল আর বেরোতে পারেনি। সেই ছোট গ্যালাক্সির নক্ষত্রগুলো এখন ছায়াপথের বাসিন্দা, কিন্তু সেগুলোর আগেকার গতিবিধির স্মৃতি একেবারে হারায়নি। এখনো সেগুলোর গতিবিধির মধ্যে কিছু আলাদা বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়, যা থেকে এগুলোর অতীতের ঘটনার ইতিহাস উদ্ধার করা যেতে পারে। এই গিলে ফেলা ছোট গ্যালাক্সির নক্ষত্রগুলো কয়েক কোটি বছর ধরে দলবদ্ধ হয়ে থাকে। তারপর ধীরে ধীরে ছায়াপথের মহাকর্ষ সেগুলোর মধ্যে সেই বন্ধন আলগা করে আনে।
একটি উদাহরণের সাহায্যে ব্যাপারটা বোঝা যেতে পারে। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রাচীনকালে যুদ্ধের পর যখন পরাজিত দেশের লোকজনকে ক্রীতদাস হিসেবে নিয়ে যাওয়া হতো, তখন কয়েক প্রজন্ম ধরে হয়তো তাদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে পারত, তারপর ধীরে ধীরে অন্য দেশের আর পাঁচটা নাগরিকের মধ্যে মিশে যেতে বাধ্য হতো। এখানেও প্রায় তেমন ঘটনা ঘটে।
এই গবেষণায় ইউরোপ থেকে মহাকাশে পাঠানো একটি দূরবীক্ষণ যন্ত্র বিশেষভাবে সাহায্য করেছে, যার নাম GAIA। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে পাঠানো হয়েছিল এই যন্ত্র। বহু দূরের নক্ষত্রের দূরত্ব ও গতিবিধি সঠিকভাবে নির্ধারণে এর জুড়ি নেই। এর সাহায্যে বিজ্ঞানীরা আমাদের ছায়াপথে প্রায় এক কোটি নক্ষত্রের সঠিক অবস্থান এবং গতিপ্রকৃতি জানার চেষ্টা করছেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।