দেহের প্রতিটি কোষে থাকা ক্রোমোজোমের তথ্যকে কোষগুলোর জন্য নির্দেশিকা বলা যেতে পারে। মানুষের শরীরের প্রায় প্রতিটি কোষেই আছে একই ক্রোমোজোম। তাই প্রতিটি কোষে আছে একই জিন, একই নির্দেশনা। এই নির্দেশনা ক্রোমোজোমের ডিএনএ থেকে মেসেঞ্জার আরএনএতে যায়। এই প্রক্রিয়াকে বলে ট্রান্সক্রিপশন। তারপর মেসেঞ্জার আরএনএর নির্দেশনা অনুযায়ী তৈরি হয় প্রোটিন। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ট্রান্সলেশন।
দেহের বিভিন্ন অঙ্গে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের কোষ। নানা ধরনের কোষের বৈশিষ্ট্য আবার একদম আলাদা। মাংসপেশির কোষ আর স্নায়ুকোষের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়াই কঠিন। তাহলে ঠিক কীভাবে এই পার্থক্যগুলো তৈরি হয়? এর উত্তর: জিন নিয়ন্ত্রণ।
এর মাধ্যমে কোষগুলো ক্রোমোজোম থেকে শুধু তার জন্য উপযোগী নির্দেশনাগুলোই অনুসরণ করে; অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট ধরনের কোষে নির্দিষ্ট কিছু জিনই শুধু কাজ করে। আবার দেহের ভেতর ও বাইরের পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতেও কোষের ভেতরের কোন জিনটি কাজ করবে আর কোনটি করবে না, তা নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়। এই জিন নিয়ন্ত্রণ যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তাহলে ক্যানসার, ডায়াবেটিস ও বিভিন্ন অটোইমিউন রোগ হতে পারে।
গত শতকের ষাটের দশকেই বিজ্ঞানীরা ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর সম্পর্কে জানতেন। এগুলো ডিএনএর নির্দিষ্ট অংশে যুক্ত হয়ে নির্ধারণ করে দেয় কোন কোন অংশ থেকে মেসেঞ্জার আরএনএ তৈরি হবে। এরপর হাজার হাজার ট্রান্সক্রিপশন ফ্যাক্টর আবিষ্কৃত হয়। বিজ্ঞানীরা ভাবতেন, এটিই জিন নিয়ন্ত্রণের মূল উপায়। কিন্তু ১৯৯৩ সালে চলতি বছরের নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীরা জিন নিয়ন্ত্রণের নতুন এক উপায় আবিষ্কার করেন।
১৯৮০-এর দশকে ভিক্টর অ্যামব্রোস ও গ্যারি রাভকুন গবেষণা করছিলেন কীভাবে বিভিন্ন ধরনের কোষ তৈরি হয়, তা নিয়ে। তাঁদের গবেষণার বিষয় ছিল C. elegans নামের মাত্র ১ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের এক গোলকৃমি। এত ছোট হলেও এই গোলকৃমিতে আছে অনেক ধরনের কোষ, যা বড় অনেক প্রাণীতেও পাওয়া যায়। অ্যামব্রোস আর রাভকুন লিন-৪ (lin-4) ও লিন-১৪ (lin-14) জিন দুটি নিয়ে কাজ করছিলেন। এই লিন-৪ জিনটি লিন-১৪-এর কাজে বাধা দেয়—এটুকু তাঁরা বুঝতে পারেন। কিন্তু সেটা ঠিক কীভাবে হয়, তা তখনো ছিল অজানা।
পরে ভিক্টর অ্যামব্রোস লিন-৪ জিন নিয়ে আরও কাজ করতে গিয়ে দেখতে পান, এটি থেকে তৈরি হয় একটি ক্ষুদ্র আরএনএ। পরে এটিকে বলা হবে মাইক্রোআরএনএ। অন্যদিকে গ্যারি রাভকুন লিন-১৪ জিন নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেন, লিন-১৪ জিন থেকে লিন-৪ জিন মেসেঞ্জার আরএনএ তৈরি থামাতে পারে না। বরং লিন-৪-এর প্রভাব পড়ে আরও পরে গিয়ে। আর লিন-১৪ জিনের একটা বিশেষ অংশের উপস্থিতি থাকলেই শুধু লিন-৪ জিন লিন-১৪-এর কাজ থামাতে পারে।
অ্যামব্রোস আর রাভকুন তাঁদের গবেষণার ফলাফল তুলনা করে দেখলেন, লিন-৪ থেকে তৈরি মাইক্রোআরএনএ লিন-১৪-এর ওই বিশেষ অংশের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। এই যুক্ত হওয়ার মাধ্যমেই লিন-৪ মাইক্রোআরএনএ লিন-১৪ মেসেঞ্জার আরএনএর কাজ বন্ধ করে দেয়।
অর্থাৎ এখানে জিনের নিয়ন্ত্রণ ট্রান্সক্রিপশন পর্যায়ে হয় না, হয় ট্রান্সক্রিপশনের পরে। এই যুগান্তকারী আবিষ্কার তাঁরা ১৯৯৩ সালে সেল জার্নালে দুটি আর্টিকেল বা নিবন্ধে প্রকাশ করেন।
আগে আবিষ্কৃত দুটি জিন শুধু ওই গোলকৃমিতে পাওয়া গেলেও লেট-৭ তেমনটা নয়। এই মাইক্রোআরএনএ (আর একে কোড করা জিন) প্রাণের অভিযোজনের ধারায় ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি বছর ধরে ‘সংরক্ষিত’—প্রাণিজগতের সব জায়গায়ই এটি পাওয়া যায়। এই আবিষ্কার নতুন করে মাইক্রোআরএনএ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করে। এর ফলে মাইক্রোআরএনএ নিয়ে গবেষণা এগিয়ে চলে।
বর্তমানে আমরা জানি, মানুষের জিনোম এক হাজারেরও বেশি মাইক্রোআরএনএ তৈরির নির্দেশনা বহন করে। আর বহুকোষী প্রাণীদের বৃদ্ধি ও কাজে মাইক্রোআরএনএর ভূমিকা অপরিহার্য।
বিজ্ঞানীরা শুধু নতুন নতুন মাইক্রোআরএনএ খুঁজে বের করেছেন, তা নয়; মাইক্রোআরএনএ ঠিক কীভাবে আরেকটি আরএনএতে যুক্ত হয়ে এর কাজ নিয়ন্ত্রণ করে, সেটাও বের করেছেন। একটি মাইক্রোআরএনএ অনেক জিনের ওপর কাজ করতে পারে। আবার একটি জিনের ওপরও কাজ করতে পারে অনেক মাইক্রোআরএনএ।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।