স্পোর্টস ডেস্ক : দেশের কথা, ভক্ত-সমর্থকদের কথা, কমিটমেন্টের কথা – ক্রিকেটারদের আরো ভাবা উচিৎ বলে মনে করেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ।
দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে তো বটেই, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতেই সাকিব আল হাসানকে এখন ভাবতে হচ্ছে, এটা সাকিবের ক্রিকেট খেলা ছেড়ে দেয়ার আলোচনা সামনে নিয়ে এসেছে। অনেকে বলছেন এটাই সময়, সাকিব আল হাসানকে ছাড়াই বোর্ডের ভাবা দরকার।
বাংলাদেশের সাবেক এই প্রধান নির্বাচকও মনে করেন, বোর্ড খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় সাকিবের প্রশ্নে।
‘যেহেতু সাকিব একজন বড় তারকা এবং এই কারণেই বোর্ড তাকে নিয়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এক্ষেত্রে নিজে থেকেই দেশের প্রতি ভক্তদের প্রতি মানুষের প্রতি আরো একটু কমিটেড হওয়া প্রয়োজন ছিল।’
ফারুক আহমেদের মতে, এখন বলাই যায় সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ক্রিকেটারদের কমিটমেন্টের অভাব দেখা যাচ্ছে। টুর্নামেন্টের ফলাফলের দিকে বলেন কিংবা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের খেলোয়াড়দের পরিচালনার দিক থেকে বলেন একটা শূন্যতা দেখা যায়।
একমাত্র কঠোর সিদ্ধান্তই এই অবস্থার একটা পরিবর্তন আনতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড আসলেই কঠোর সিদ্ধান্ত নেবে কি না, সেটা এখনই বলা মুশকিল, বিসিবির ক্রিকেট অপারেশন্সের চেয়ারম্যান জালাল ইউনুস এর আগে বলেছিলেন, বিসিবির সাথে সাকিবের যোগাযোগ হয়েছে – সাকিব কমিটমেন্ট রাখবেন।
কিন্তু এবারে ক্রিকেট বোর্ড আরো একবার অপ্রস্তুত একটা অবস্থায় পড়েছে।
ক্রিকেট অপারেশন্স প্রধান জালাল ইউনুস বলেছেন, এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন না করতে, অন্তত দুই দিন সময় লাগবে বিসিবির।
খেলায় ক্লান্তি, বিজ্ঞাপনে ক্লান্তি নেই
মাঠের খেলায় শতভাগ দিতে পারছেন না সাকিব, এই বক্তব্য এর আগে নানা মুখে শোনা গেলেও এবার বললেন সাকিব নিজেই। একটি মুঠোফোন কোম্পানির ব্র্যান্ড প্রমোশনের কাজে দুবাই যাওয়ার আগে সাকিব জানিয়েছেন মাঠে নিজেকে ‘প্যাসেঞ্জার’ মনে হয়েছে, তার মনে হয় না তিনি ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত’।
শুধু গতকাল রাতে বিমানবন্দরে বলা সাকিব আল হাসানের কথাগুলোও যদি দেখা যায়, তাহলে মনে হতেই পারে যে সাকিবের দিক থেকে কোনো কিছুই ঠিক ‘স্পষ্ট’ নয় ।
প্রথমে তিনি বলেছেন, ‘দক্ষিণ আফ্রিকা দলের সাথেই যাবো’। কিন্তু পরে বলেছেন, ‘এমনও হতে পারে ওয়ানডে না খেলে টেস্ট খেলতে পারেন’।
আবার একই সাথে এটাও বলেছেন, তিনি টেস্ট ক্রিকেট থেকে ছয় মাসের নয়, অন্তত ২০২২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পর্যন্ত অর্থাৎ ৯ মাসের ছুটি চেয়েছেন বোর্ডের কাছে।
আবার বলেছেন, তিনি মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্রিকেট খেলার জন্য প্রস্তুত ‘ফিল করছেন না।’
তবে মানসিক বা শারীরিক সমস্যা নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্ধারিত ব্যক্তিরা কিছুই জানেন না বলেই জানিয়েছেন বিবিসি বাংলাকে।
এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমেও বিস্তর কথাবার্তা হচ্ছে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের নিয়মিত দর্শক রাসয়াত রহমান জিকো তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, আফগানিস্তানের বিপক্ষে শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে সাকিবকে ক্লান্ত দেখা গেছে।
তবে ক্লান্তির কথা উঠলেও এরই মধ্যে খেলার বাইরের বাণিজ্যিক কার্যক্রমে তাকে হরহামেশাই যুক্ত হতে দেখাটা ইতিবাচক হিসেবে নিচ্ছেন না বাংলাদেশের ক্রিকেটের অনেক পর্যবেক্ষক।
যেমন বাংলাদেশের সাংবাদিক রাহিদ রনি তার ফেসবুক পাতায় লিখেছেন, ‘বর্তমান সময়ের সাকিব শুধুই একজন ব্যবসায়ী। যে কি না ক্রিকেটটা খেলেন ব্যবসারই একটা অংশ হিসেবে। বিশ্রাম ক্রিকেট থেকে নেয়া যায়, বিজ্ঞাপন বা ব্যবসা থেকে সাকিবের ছুটি নেয়া অসম্ভব।’
‘খেলার চেয়ে বিজ্ঞাপনে মনোযোগ বেশি সাকিব আল হাসানের’- এমন একটা অভিযোগ হরহামেশাই বাংলাদেশের সেরা এই পারফর্মারকে নিয়ে ওঠে, এবং সাম্প্রতিক বাস্তবতাও এই অভিযোগকে সমর্থন দেবে। বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগের ফাইনালের আগে ট্রফির সাথে ফটোসেশন বাদ দিয়ে সাকিব গিয়েছেন বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ে।
এটা নিয়ে তুমুল সমালোচনা হয়েছে। এমনকি সাকিবের দল ফরচুন বরিশালকে কারণ দর্শানো নোটিশও দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড।
এরপর আফগানিস্তান সিরিজের ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের মাঝে সাকিব আল হাসান একটি মোটরসাইকেল নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের শোরুম উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন, সেটা বোর্ডের অনুমতি নিয়ে করলেও সাকিবের তীব্র সমালোচনা হয়েছে ক্রিকেট সমর্থকদের মাঝে।
আর এখন প্রায়শই সিরিজের আগে সাকিব আল হাসানের নাম স্কোয়াডে এলেও দেখা যায় তিনি খেলতে যেতে চাচ্ছেন না।
অতীত অভিজ্ঞতা বলছে- ২০১৯ সালে তিনি নিউজিল্যান্ড সফরে যাননি, ২০২০ সালে ছিল নিষেধাজ্ঞা, ২০২১ সালে সাকিব গিয়েছিলেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ খেলতে, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে খেলেননি তিনি। এরপর ২০২২ সালের শুরুতে নিউজিল্যান্ড সফর থেকে নাম সরিয়ে নেন সাকিব আল হাসান। এখন দক্ষিণ আফ্রিকা সফর নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের ক্রিকেট অপারেশন্সের প্রধান জালাল ইউনুস বলেছেন, সাকিব কমিটমেন্ট রাখবেন বলেই জানিয়েছিলেন।
অর্থাৎ বোর্ড এখন সাকিবের দিকে তাকিয়ে থাকে সাকিব ‘হ্যাঁ’ বলবেন কি না।
এমনকি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রেসিডেন্ট নাজমুল হাসান পাপন, যতবার গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়েছেন ততবারই তাকে একই প্রশ্ন শুনতে হচ্ছে সাকিব দক্ষিণ আফ্রিকা যাবেন কি না।
তিনি বলেছেন, ‘ওর না যাওয়ার কোনো কারণ দেখি না।’
বাংলাদেশের ক্রিকেটের নিয়মিত ফলোয়ার, ‘দৌড়া বাঘ আইলো’ ফেসবুক ক্রিকেট গ্রুপের সদস্য মইন সৌরভ এখানে দুই পক্ষেরই দায় দেখছেন- ‘তিনি সাকিব আল হাসান বলেই এবং এটা বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড বলেই সম্ভব হচ্ছে এমনটা। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সিনিয়র ক্রিকেটারদের একটা বাড়তি জায়গা দেয়া হয়, যেটা আসলে অন্য তুলনামূলক পেশাদার বোর্ডগুলোতে দেখা যায় না।’
বিবিসি বাংলার সাথে কথোপকথনে বিসিবির সাবেক প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ বলেছেন, “সাকিব আল হাসানও জানেন যে বোর্ড তাকে সেরা ক্রিকেটার হিসেবে কিছুটা ছাড় দেয় – যে কারণে তিনি জানেন বোর্ড তার বিষয়ে ‘হার্ডলাইনে’ যাবে না।”
টেস্ট ক্রিকেটে সাকিব আল হাসান অনেক দিন ধরে অনিয়মিত, বাংলাদেশের খেলা শেষ ২৭টি টেস্ট ম্যাচের মধ্যে মাত্র ৮টিতে খেলেছেন তিনি।
কিন্তু ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে এটা কঠিন হয়ে যায়, যদিও নিষেধাজ্ঞা থেকে ফেরার পর ‘নাম্বার ওয়ান সাকিব আল হাসান’কে আর পাওয়া যায়নি ব্যাট হাতে। বল হাতে তিনি নিয়মিতই ভালো করেন, তবু এখানে অন্য অপশন আছে – যা বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যতের জন্যও বেশ একটা পরীক্ষা হতে পারে।
নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরার পর ১২টি ওয়ানডে ম্যাচে সাকিব ৩৩৭ রান তুলেছেন, ৩৩ গড়ে, যা তার ক্যারিয়ার গড়ের তুলনায় ছয় কম। টি-টোয়েন্টিতে অবস্থা আরো খারাপ, ২০ ম্যাচ খেলে করেছেন ৩৪১ রান, গড় ১৮, স্ট্রাইক রেট ১০৪।
ক্রিকেট সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষক তৌসিয়া ইসলামের মতে, ‘শুধু সাকিব না, গোটা পঞ্চপান্ডব যে টার্মটা ব্যবহার করা হতো এই জায়গা থেকেই সরে আসার সময় এসেছে।’
তিনি উদাহরণ হিসেবে দেখিয়েছেন, ‘তরুণ ক্রিকেটাররা দায়িত্ব নিয়ে খেলা শিখছে। দেখেন আফগানিস্তানের সাথে প্রথম ওয়ানডেতে আফিফ আর মিরাজের ইনিংসটা খুব বড় একটা ইঙ্গিত।’
বিশেষত লিটন দাসের ক্রিকেটটা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলটাকে এখন আশা দেখাচ্ছে, একই সাথে আফিফ হোসেন, নাছুম আহমেদরা ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দেয়া ক্রিকেটটা খেলতে পারছেন- সাকিব আল হাসান পুরো দশটা ওভার বল করেন, পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান হিসেবে ব্যাট করেন এই ঘাটতিটা কাটাতে একটা ইউনিট হিসেবে নতুন দলটাকে খেলাতে হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
নিউজিল্যান্ডের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়কে টেনে এনে তৌসিয়া ইসলাম বলেছেন, ‘এখন বাংলাদেশের যেসব ক্রিকেটারকে আমরা অনেকদিন যাবৎ তরুণ বা উদীয়মান বলে আসছি তাদের ওপর দায়িত্ব ছাড়ার সময় এসেছে।’
নিউজিল্যান্ডের মাটিতে সাকিব আল হাসানের মতো পারফর্মার বাংলাদেশে নেই, সেই সাকিবকে ছাড়াই ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথমবারের মতো নিউজিল্যান্ডের মাটিতে টেস্ট জিতে এসেছে বাংলাদেশ।
সমর্থকরা বলছেন, এটা একটা সাইন, যে সাকিব-তামিম-রিয়াদকে ছাড়াও বাংলাদেশের অনেক ক্রিকেটার আছে যারা দায়িত্ব পেলে ভালো ক্রিকেট খেলতে পারেন।
একটা বড় সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন ক্রিকেট ফলোয়ার রাফিয়া তারান্নুম। তিনি বলছেন, বাংলাদেশে যেটা হয় একটা গ্রুপ তৈরি করা হয় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে – কোর গ্রুপ, এই কোর গ্রুপকেই নায়কোচিত একটা জায়গায় বসানো হয়, এই পুরো প্রসেসটাই টিমগেমের বিরুদ্ধে কাজ করে।
ভারতে রোহিত শর্মা, ভিরাট কোহলিরা আছেন, কিন্তু লোকেশ রাহুলদের গুরুত্বও কম নয়। রবীন্দ্র জাদেজা, রিশভ পান্থরাও কম নন, এটা সমর্থকরা ও বোর্ড এভাবেই দেখে।
মাহেন্দ্র সিং ধোনি যখন অধিনায়কত্ব পান, তখন সৌরভ গাঙ্গুলি, শচিন টেন্ডুলকার, ভিভিএস লক্ষণ, রাহুল দ্রাবিড় সবাই মাঠের ক্রিকেট খেলছেন, সিনিয়রদের নিয়েই ধোনি বিশ্বকাপ পর্যন্ত জেতান।
সূত্র : বিবিসি
আইপিএলে দল পেলে সাকিব মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকত? প্রশ্ন পাপনের
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।