আন্তর্জাতিক ডেস্ক : সম্প্রতি কাতারভিত্তিক আল জাজিরা টেলিভিশন চ্যানেলের একটি প্রতিবেদনে সাক্ষাৎকার দেওয়ায় গ্রেফতার হন বাংলাদেশের ছেলে রায়হান কবির। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় মালয়েশিয়া সরকারের নেওয়া পদক্ষেপে সেখানকার অভিবাসীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
এদিকে বাংলাদেশের অন্যতম একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে রায়হানের মা রাশিদা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলের জন্মের পর এমন কোনো ঈদ নেই যে, সে আমাদের সঙ্গে ছিল না বা আমাদের সঙ্গে কথা বলেনি। এই প্রথম ঈদে আমাদের ছেলে কাছে নেই, তার সঙ্গে কোনো কথাও হয়নি। সে কখন আমাদের কাছে ফিরবে, তাও আমরা জানি না। ’
এসব কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কাঁদছিলেন রায়হানের বাবা শাহ আলমও।
গত ২৪ জুলাই রায়হানকে গ্রেফতার করে মালয়েশিয়া পুলিশ। এরপর ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও তার কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
এ প্রসঙ্গে রায়হানের মা বলেন, ‘আমার যন্ত্রণা আমি কাউকে বোঝাতে পারবো না। আমি সারাদিন কাঁদছি। সব স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে। শুধু একজন মায়ের পক্ষেই বোঝা সম্ভব যে আমার কেমন লাগছে। আমি তাকে জন্ম দিয়েছি। ঈদের সময় এখানে থাকলে, সে সবসময় আমার কপালে চুমু দিতো। আর বিদেশে থাকলে অন্তত ফোনে কথা বলতো। আমার মন ভেঙে যাচ্ছে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছেলেকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। আমি মালয়েশিয়া সরকারের কাছে অনুরোধ করছি আমার ছেলেকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও আমি একই অনুরোধ করছি। আমি নিশ্চিত, আমার ছেলে কোনো অপরাধ করেনি। সে অপরাধ করার মতো মানুষ না। আমার ছেলে না ফিরলে, আমি ঈদ উদযাপন করবো না। যেদিন আমার ছেলে ফিরবে, সেদিন আমার ঈদ হবে। ’
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন বন্দরের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের শাহী মসজিদ এলাকায় রায়হানের বাড়ি। তার বাবা শাহ আলম একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন।
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে কখনো কোনো অন্যায় করেনি। কিন্তু সে সব সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতো। আমি তাকে অনেকবার বলেছি যে, তুমি এভাবে প্রতিবাদ করতে থাকলে, একসময় বিপদে পড়বে। সে বলতো, অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে তার অপরাধবোধ হয়। কে জানে এখন আমার ছেলে কী অবস্থায় আছে। ’
পরিবার এবং স্থানীয়রা জানান, বন্দর এলাকার সবার কাছে রায়হান ‘বিদ্রোহী’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এলাকায় কেউ সমস্যায় পড়লে, রায়হান তার পাশে দাঁড়াতেন। অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের বই ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করতেন তিনি। এলাকায় মাদকপাচারের বিরুদ্ধেও খুব সোচ্চার ছিলেন।
২০১৩ সালে সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে ২০১৪ সালে মালয়েশিয়া যান রায়হান। সেখানেই বিএ পাস করেন তিনি। সেখানে পার্ট টাইম জব করে নিজের লেখাপড়ার খরচ বহনের পাশাপাশি বাড়িতেও কিছু টাকা পাঠাতেন। জানুয়ারিতে সেখানকার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি পান তিনি। কোম্পানি থেকে তাকে গাড়ি ও থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে প্রথম বেতন পাওয়ার পর লকডাউনে বেতন বন্ধ হয়ে যায় তার।
গত ৩ জুলাই, ‘লকড আপ ইন মালয়েশিয়াস লকডাউন’ নামে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রচার করে আল জাজিরা। এতে প্রবাসী কর্মীদের প্রতি মালয়েশিয়া সরকার যে বৈষম্যমূলক আচরণ করছে তা তুলে ধরা হয়। এতে রায়হানসহ মালয়েশিয়ায় কর্মরত বিভিন্ন দেশের প্রবাসী কর্মীরা সাক্ষাৎকার দেন, যার ফলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে কর্তৃপক্ষ।
রায়হানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। পরে ২৪ জুলাই বিকেলে তাকে গ্রেফতার করে মালয়েশিয়া পুলিশ।
এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে দ্রুত রায়হানকে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং বাংলাদেশি সংস্থা।
গ্রেফতার হওয়ার আগেরদিন বাবার সঙ্গে কথা হয়েছিল রায়হানের। এ বিষয়ে তার বাবা বলেন, ‘গত বৃহস্পতিবার তার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছিল। এখন তো সে জেলে তাই জানি না কেমন আছে। শেষ কথার সময় বলেছিল, বাবা ভালো আছি, চিন্তা করো না। তোমরা যেমন আমার জন্য কষ্ট করছো, তেমনি আমিও প্রবাসী ভাইদের জন্য কথা বলেছি। তাদের যেন ভালো হয়, তারা যেন ভালো থাকতে পারে সেজন্য আমি কথা বলেছি। ’
রায়হানের ছোট বোন মেহেরুন মেহের বলেন, ‘আমার ভাই আমাকে সব সময় নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়াতে বলতেন। গত ১৯ জুলাই ভাইয়া তার এক বন্ধুর কাছে একটি মেসেজ পাঠিয়েছিলেন। ওই মেসেজটি পড়ে আমাকে পাঠান ওই বন্ধু। সেটি পড়ে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। ’
গ্রেফতারের আগে আতঙ্কিত রায়হান ওই মেসেজে লেখেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশ এখনো শ্রমিকদের দাস বানিয়ে রাখে। গুগলে সার্চ করলেই জানা যাবে, আমরা সবচেয়ে সস্তায় শ্রম দেই। তারপরও তারা আমাদের আঘাত করে, সাজা দেয়, যদিও এটা অবৈধ, কারণ সিস্টেমই এমন হয়ে গেছে। কেন তারা অন্য দেশের মানুষের সামনে প্রাণিদের মতো শেকলে হাত বেঁধে শ্রমিকদের বিমানবন্দর অতিক্রম করায়? কেন তারা শাস্তির নামে আমার ধর্মপ্রাণ ভাইকে নগ্ন করে ফেলে? এত অন্যায় হওয়া সত্ত্বেও আমরা তাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ করতে পারি না। আমরা কেবল দুঃখে চোখের পানি ফেলি। ’
তিনি আরও লেখেন, ‘আমি ভালো আছি। আমার পরিবার ভালো আছে। আমার মালয়েশিয়ান ডিগ্রি আছে। করপোরেট জব করে আমি আমার জীবন আরামে কাটিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু যখন আমি আমার চোখের সামনে নিজ দেশের ভাইদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হতে দেখলাম, তখন আমি তা সহ্য করতে পারলাম না। এ কারণে এখন আমি পলাতক আসামি। আমি কীভাবে প্রতি মুহূর্ত পার করছি, কীভাবে কষ্ট করছি, তার আর না বলি। সেসব গল্প আরেকদিন হবে। আমার একমাত্র অপরাধ আমি বাঙালি। ’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।