তিন শ বছর শরীর অবিকৃত রাখা সম্ভব?
আধুনিক বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও বিভিন্ন ওষুধ-পদার্থের ব্যবহারের মাধ্যমে শত শত বছর প্রাণীদেহ অবিকৃত রাখার পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে, যেমনটি বিভিন্ন জাদুঘরে দেখা যায়। এমনকি ঘুম, মস্তিষ্কের কোষের কার্যকারিতা ও শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানবদেহের জৈবিক চাহিদা নিয়ন্ত্রণ ও স্বাভাবিক সতেজতা রক্ষা করা সম্ভব। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে ‘কোমা’ আবিষ্কৃত হওয়ার পর প্রমাণিত হয়েছে, ‘সজাগ’ ও ‘সচেতন’ না থেকেও দীর্ঘদিন জীবিত থাকা সম্ভব এবং সে অবস্থা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসে স্বাভাবিক জীবনযাপন করাও সম্ভব। মহান আল্লাহ গুহাবাসীদের জন্য তাঁর বিশেষ ক্ষমতাবলে হয়তো এমন একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন।
কোমার রোগীদের দেখলে মনে হয়, তারা জেগে আছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা অচেতন। এই সময় তাদের শরীরের রক্ত চলাচল, মাংসপেশি ও শিরা-উপশিরা স্বাভাবিক রাখার জন্য ম্যাসাজ ও থেরাপি দেওয়া হয়। (https://bit.ly/39GxGf7)| কোরআনে বর্ণিত আসহাবে কাহফের ঘটনায় তেমনি একটি দৃশ্য দেখা যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি মনে করবে তারা জাগ্রত, কিন্তু তারা ছিল নিদ্রিত। আমি তাদের পার্শ্ব পরিবর্তন করাতাম ডান দিকে ও বাঁ দিকে। …’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ১৮)। তাঁদের এই পার্শ্ব পরিবর্তন ছিল আধুনিক থেরাপির স্থলাভিষিক্ত। যেমন—তাঁদের শরীরের পেশি ও শিরা-উপশিরা বিকল হয়ে না যায়।
কোরআনে ‘জাগ্রত মনে হবে’ বলার একটি অর্থ হতে পারে তাঁদের চোখের পাতা স্থির ছিল না। কেননা তাঁদের চোখের পাতা বন্ধ থাকলে রক্ত সঞ্চালনের অভাবে শিরাগুলো শুকিয়ে গিয়ে চোখ অন্ধ হয়ে যেত, আবার চোখের পাতা খোলা থাকলে তা ‘কর্নিয়া জেরোসিস’-এ আক্রান্ত হতো।
অন্তহীন অবচেতন ঘুমে ছিলেন তাঁরা
একটি সুগঠিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্ক একপর্যায়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের মধ্যে একটি গতিশীল ক্রমহ্রাসমান সিস্টেম সক্রিয় থাকে। ফলে যখন অনিদ্রা থেকে এনআরইএম ঘুমের (স্বপ্নহীন ঘুম) সময় ঘুম যত গভীর হয়, মস্তিষ্কের বেশির ভাগ নিউরন সক্রিয় হয়ে ওঠে। ইলেকট্রয়েন্সফ্লোগ্রাফিক (ইইজি) রেকর্ডে দেখা গেছে, এনআরইএম ঘুমের সময় মস্তিষ্কের তরঙ্গগুলো ধীর হয় এবং ভোল্টেজ থাকে উচ্চ। শ্বাস-প্রশ্বাস ও হূত্স্পন্দন ধীর ও নিয়মিত থাকে এবং রক্তচাপও কম থাকে। এতে ব্যক্তি তুলনামূলক বেশি স্থির থাকে। (https://bit.ly/2FmFR2h) চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের দাবি, কোমার রোগীরা এক ধরনের এনআরইএম ঘুমের মধ্যে থাকে। পার্থক্য হলো, স্বাভাবিক মানুষের ঘুমের একটি টাইম সার্কেল থাকে আর কোমার রোগীদের এই টাইম সার্কেলটা থাকে না। হয়তো কোরআনে বর্ণিত ‘আসহাবে কাহফে’র ঘুমটি ছিল ‘টাইম সার্কেল’হীন।
যোগব্যায়ামের কোনো কোনো স্তরে অনুভূত হয় যে, মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি ধীর হচ্ছে এবং তাতে প্রায় এক মিনিট সময় নিচ্ছে। এই সময় আনুপাতিক হারে মানুষের হৃত্স্পন্দনও কমতে থাকে। এতে অচেতন হওয়ার প্রয়োজন হয় না; বরং যোগব্যায়াম-সাধকদের দাবি, শরীর-তন্ত্রী ঘুমিয়ে পড়লেও এই সময় মানবাত্মা জেগে ওঠে। যোগব্যায়ামের এই বক্তব্য নানাভাবেই পরীক্ষিত। সুতরাং জীবন্ত শরীরের কার্যক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি একেবারেই অমূলক বলার অবকাশ আধুনিক বিজ্ঞানে রাখা হয়নি।
পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় নেওয়া সত্যাশ্রয়ী যুবকদেরও আল্লাহ ঘুমের ভেতর জীবিত রেখে তাঁদের দেহকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। তাঁদের এই ঘুম যে স্বাভাবিক ঘুম থেকে ভিন্ন ছিল তা-ও পবিত্র কোরআনের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়। আল্লাহ বলেন, ‘আমি কয়েক বছর তাদের কানে ঘুমের পর্দা দিয়ে দিলাম।’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ১১)। অর্থাৎ তাদের গভীর ঘুমে অচেতন করে রাখলাম। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ‘কানে ঘুমের পর্দা দেওয়া’ বাক্যের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। কেননা মানুষের ‘অষ্টম ক্রানিয়াল নার্ভ’ (করোটি-ইন্দ্রিয়)-এর ভেতরের অংশ দুই ভাগে বিভক্ত, যার এক অংশ শ্রবণশক্তি হিসেবে কাজ করে এবং অপর অংশ শরীর ও দেহের ভারসাম্য রক্ষায় কাজ করে। ঘুমের মধ্যে এই ‘নার্ভ’ সচল থাকে। ফলে শব্দ হলে ঘুম ভেঙে যায় এবং ঘুমের মধ্যে আমরা অবস্থান পরিবর্তন করি। (https://bit.ly/2T3LOci)| কোরআনের বর্ণনা থেকে বোঝা যায়, ক্রানিয়াল নার্ভের একটি ফাংশন বন্ধ ছিল; ফলে বাইরের শব্দ তাঁদের ঘুম ভাঙত না আর একটি ফাংশন সক্রিয় ছিল ফলে তাঁরা পার্শ্ব পরিবর্তন করতেন। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি মনে করবে তারা জাগ্রত, কিন্তু তারা ছিল নিদ্রিত। আমি তাদের পার্শ্ব পরিবর্তন করাতাম ডান দিকে ও বাঁ দিকে। …’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ১৮)
খাবার ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব?
তাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেও প্রাণীদেহের বিভিন্ন অঙ্গের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। তাপ নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে আধুনিক জীববিজ্ঞানের দুটি পরিভাষা হলো, হাইবারনেশন ও অ্যাসটিভেশন। হাইবারনেশনের শাব্দিক অর্থ শীত উদ্যাপন। বিজ্ঞানের পরিভাষায় হাইবারনেশন হলো এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে প্রজাপতি, কাঠবিড়ালি, বন্য কুকুর, ইঁদুর থেকে বাদুড় পর্যন্ত বিভিন্ন প্রাণী কোনো প্রকার খাবার গ্রহণ ও স্থান পরিবর্তন করা ছাড়া বেঁচে থাকে। এই পদ্ধতিতে তারা তাদের শরীরের ‘ম্যাবিলিজম’ (প্রাণীদেহের রাসায়নিক বিক্রিয়া) বন্ধ রাখার মাধ্যমে এনার্জি সংরক্ষণ করে। (https://bit.ly/37Jatav)| ৯ মাস পর্যন্ত এই পদ্ধতি কার্যকর থাকার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।
আর অ্যাসটিভেশন হলো হাইবারনেশনের অনুরূপ একটি পদ্ধতি, যা গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের প্রাণীরা অবলম্বন করে থাকে। প্রচণ্ড গরমের সময় প্রাণী ঘুমের মাধ্যমে শরীরের তাপমাত্রা ও রাসায়নিক বিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। (ডিকশনারি ডটকম)
শীত ও গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের প্রাণী ও উদ্ভিদের মধ্যে হাইবারনেশন ও অ্যাসটিভেশন পদ্ধতি অবলম্বন করতে দেখা যায়। সুরা কাহফের বর্ণনা থেকে যুবকদের আশ্রয় নেওয়া গুহার তাপ নিয়ন্ত্রণের বর্ণনা পাওয়া যায়। ইরশাদ হয়েছে, ‘তুমি দেখতে পেতে, তারা গুহার প্রশস্ত চত্বরে অবস্থিত, সূর্য উদয়ের সময় তাদের গুহায় ডান পাশে হেলে যায় এবং অস্ত যাওয়ার সময় তাদের অতিক্রম করে বাঁ পাশ দিয়ে। এ সবই আল্লাহর নিদর্শন।’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ১৭)
অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ গুহার তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ও যুবকদের শরীরে হাইবারনেশন ও অ্যাসটিভেশন পদ্ধতির মতো কোনো পদ্ধতি সক্রিয় করে রেখেছিলেন। ফলে তাঁরা দেহের জৈবিক চাহিদা থেকে মুক্ত ছিল।
বদ্ধ পরিবেশে আতঙ্কিত হলো না কেন
প্রশ্ন হতে পারে, একটি বদ্ধ পরিবেশ মানুষের ওপর যে মনোদৈহিক প্রভাব ফেলে গুহায় আশ্রয় নেওয়া যুবকদের ক্ষেত্রে তা হলো না কেন? কোরআনের শব্দ-বাক্য থেকে এই প্রশ্নেরও উত্তর পাওয়া যায়। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা যখন বিচ্ছিন্ন হলে তাদের থেকে এবং আল্লাহ ছাড়া তারা যাদের উপাসনা করে তাদের থেকে, তখন তোমরা গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করো। তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য দয়া বিস্তার করবেন এবং তোমাদের কাজকর্মকে ফলপ্রসূ করবেন।’ (সুরা : কাহফ, আয়াত : ১৬)
আলোচ্য আয়াতে ব্যবহৃত ‘আশ্রয়’ ও ‘দয়া বিস্তার’ শব্দদ্বয় গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ‘আশ্রয়’ শব্দে ভয়মুক্ত হওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে এবং ‘রহমত বিস্তার’ বাক্যাংশে প্রতিকূল পরিবেশ অনুকূল হওয়ার আশ্বাস রয়েছে।
মহান আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
লেখক : আতাউর রহমান খসরু, সূত্র : দৈনিক কালেরকণ্ঠ অনলাইন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।