চলমান আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিলতার ভেতর একটি বড় প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে—ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন দিকে যাচ্ছে? বর্তমান পরিস্থিতি শুধু মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নয়, বিশ্বশক্তির ভারসাম্যের জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ। এই সম্পর্কের সাম্প্রতিক গতিপ্রকৃতি যেমন উত্তেজনা ও সম্ভাবনার দ্বন্দ্বে ঘেরা, তেমনি দুই দেশের ভবিষ্যত পদক্ষেপ বিশ্ব নিরাপত্তার চিত্রপটকেও প্রভাবিত করবে। সাম্প্রতিক সময়ের বৈঠক, পরোক্ষ আলোচনা ও নিষেধাজ্ঞার উত্তাপ দুই পক্ষকেই এমন এক মোড়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে, যেখান থেকে হয়তো কোনো নির্দিষ্ট সমঝোতার দিকে এগোনো সম্ভব কিংবা উল্টো পথ ধরাও হতে পারে।
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের বর্তমান চিত্র ও বৈঠকের প্রেক্ষাপট
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বিশেষভাবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। ইরান-যুক্তরাষ্ট্র এই সম্পর্কের ভিত্তি বিগত কয়েক দশকে বারবার পরিবর্তিত হয়েছে, যার মাঝে আছে পারমাণবিক চুক্তি, নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক টানাপোড়েন এবং আঞ্চলিক যুদ্ধনীতি।
Table of Contents
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অধীনে ২০১৮ সালে আমেরিকা পুরনো পরমাণু চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসে, যার ফলে সম্পর্কের উত্তেজনা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে। এর পর থেকে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ভয়াবহভাবে বেড়েছে। আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ইরান ইতোমধ্যেই ৬০% বিশুদ্ধতার ইউরেনিয়াম মজুত করেছে যা প্রায় পারমাণবিক অস্ত্র গ্রেডের কাছাকাছি। এই প্রেক্ষাপটে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ওমানের মাস্কাটে অনুষ্ঠিত আলোচনাকে দেখা হচ্ছে একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্ত হিসেবে।
মাস্কাটে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা মূলত পরোক্ষ হলেও তাৎপর্যপূর্ণ। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ আলোচনায় নেতৃত্ব দেন। আলোচনার ধরণ সরাসরি না হলেও বার্তাবাহকদের মাধ্যমে চালানো হয়, যেখানে উভয় পক্ষ ‘ন্যায্য ও সম্মানজনক’ চুক্তির পক্ষে মত দেয়।
কেন এখন গুরুত্বপূর্ণ ইরান-যুক্তরাষ্ট্র আলোচনা
বর্তমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় এই আলোচনাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে কয়েকটি বিষয়। প্রথমত, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যা কয়েকদিন বা সর্বোচ্চ কয়েক সপ্তাহেই একটি কার্যকর পারমাণবিক বোমা তৈরির সক্ষমতা অর্জন করতে পারে। দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক উত্তেজনা—বিশেষ করে ইসরাইল-ইরান সম্পর্ক এবং হামাস ও অন্যান্য প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোর কর্মকাণ্ড—এখন এক মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছেছে।
তৃতীয়ত, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে আলোচনার মাধ্যমে একটি চুক্তির মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করছে, যা যুদ্ধ এড়াতে পারে। রিপাবলিকান দলীয় সমর্থকরাও এই চুক্তির পক্ষে। তবে এখানেই মূল প্রশ্ন—এই চুক্তি কতটা টেকসই হবে?
ইরান চাইছে এমন একটি চুক্তি যা একদিকে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করবে না, বরং কিছু সীমারেখার মধ্যে রাখবে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র চায় ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিতে। দুই পক্ষের এই অবস্থানের ফারাকই চুক্তির ভবিষ্যত নির্ধারণ করবে।
আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে চুক্তির প্রয়োজনীয়তা
মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিদিন যেভাবে অস্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক একটি নির্ধারক ভূমিকা পালন করছে। সাম্প্রতিককালে ইসরাইলের পক্ষ থেকে ইরানের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় হামলা এবং পারমাণবিক স্থাপনার ওপর বোমাবর্ষণের হুমকি—সবমিলিয়ে অঞ্চলজুড়ে এক উত্তেজনার আবহ তৈরি হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইরান ইতোমধ্যেই ৬টি পারমাণবিক বোমা তৈরির উপযোগী ইউরেনিয়াম সংগ্রহ করেছে এবং ‘ব্রেকআউট টাইম’ এখন শুধুমাত্র কয়েক দিনের বিষয়। এই অবস্থায়, যদি কোনো চুক্তি না হয়, তাহলে বড়সড় একটি সামরিক সংঘর্ষের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এছাড়া, রাশিয়ার সাথে পূর্বে হওয়া আলোচনার সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন বেশ কিছু আঞ্চলিক বিশ্লেষক। ইউক্রেন যুদ্ধের মতো এখানেও দেখা যাচ্ছে যে ইরান দীর্ঘসূত্রতা পছন্দ করে এবং সময় বাড়াতে থাকে যখনই চুক্তির কাছাকাছি আসে। এই ধরণের রাজনৈতিক চালচাতুরিই আলোচনাকে দুর্বল করে তোলে।
সম্ভাব্য সমঝোতার রূপরেখা ও চ্যালেঞ্জ
যদিও আলোচনার সূচনা হয়েছে, তবে এখনো পর্যন্ত পরিষ্কার নয় যে দুই পক্ষ কী ধরণের চুক্তি করতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র চায় এমন একটি চুক্তি যাতে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে একেবারে অক্ষম হয়ে পড়ে, অন্যদিকে ইরান চায় কিছু নিষেধাজ্ঞা শিথিলের বিনিময়ে তাদের গবেষণা ও পরমাণু শক্তি ব্যবহারের অধিকার রক্ষা করতে।
ইরান চাইছে একটি ‘সিনেট অনুমোদিত’ চুক্তি, যাতে আগামীতে কোনো প্রেসিডেন্ট সেটি একতরফাভাবে বাতিল করতে না পারে। কিন্তু, ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন প্রশাসন সিনেটে প্রয়োজনীয় ৬৭টি ভোট আদায় করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
এই আলোচনার সফলতা নির্ভর করছে মধ্যস্থতাকারী ওমান, রাশিয়া ও সৌদি আরবের মতপ্রকাশের ওপরও। পাশাপাশি, ইসরাইল ও সৌদি আরবের মধ্যে স্বাভাবিকীকরণ চুক্তির সম্ভাবনা এবং আমেরিকার ভূমিকা এই সমঝোতাকে আরও জটিল করে তুলছে।
প্রতিরক্ষা ও সামরিক প্রস্তুতির প্রেক্ষাপট
যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই ভারত মহাসাগরে বি-২ স্টিলথ বোমারু ও দ্বিতীয় বিমানবাহী রণতরী মোতায়েন করেছে। এই সামরিক উপস্থিতি ইরানকে বার্তা দিচ্ছে যে যুদ্ধের হুমকি কেবল কথার কথা নয়। তবে, এই উচ্চমাত্রার বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে রাখা সম্ভব নয়।
যদি আলোচনার মাধ্যমে দ্রুত চুক্তি না হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এই বাহিনী সরিয়ে নিতে পারে, যা ইরানিদের কাছে দুর্বলতার বার্তা দিতে পারে। এক্ষেত্রে ইসরাইল একা লড়াই করার জন্য প্রস্তুত হতে পারে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশল ও ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি
ট্রাম্প প্রশাসন আলোচনার মাধ্যমে একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে আগ্রহী হলেও, তাদের মধ্যে এখনও পর্যন্ত পরমাণু বিশেষজ্ঞের অভাব রয়েছে, যেমনটা ছিল ওবামা প্রশাসনের সময়। অতীতে আর্নেস্ট মনিসের মতো প্রযুক্তিগত বিশেষজ্ঞ আলোচনা প্রক্রিয়াকে সহজ করেছিলেন। বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসনে সেই ধরণের প্রস্তুতি এখনও স্পষ্ট নয়।
তবুও, মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে তারা এমন একটি ‘যাচাইকরণ কর্মসূচি’ চায়, যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে যে ইরান পরমাণু অস্ত্র তৈরি করছে।
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন দিকে যাচ্ছে তা এখনো অস্পষ্ট
ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এখনো অনেক অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। মাস্কাটে আলোচনার মাধ্যমে কিছুটা আশার সঞ্চার হলেও, চুক্তির চূড়ান্ত রূপরেখা ও এর বাস্তবায়ন এখনো অনেক দূরে। যদি এই আলোচনা ব্যর্থ হয়, তাহলে যুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়বে। আবার সফল হলে এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ এনে দিতে পারে।
FAQs
- ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের মূল কারণ কী?
মূল কারণ পারমাণবিক কর্মসূচি ও মধ্যপ্রাচ্যে কৌশলগত কর্তৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব। - বর্তমান আলোচনার মূল উদ্দেশ্য কী?
পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করার বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা শিথিল এবং শান্তিপূর্ণ সমঝোতা প্রতিষ্ঠা। - চুক্তির সফলতা কোন বিষয়ের ওপর নির্ভর করছে?
উভয় দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছা, মধ্যস্থতাকারীদের ভূমিকা এবং বাস্তব কৌশল নির্ধারিত প্রস্তাবের ওপর। - যদি চুক্তি না হয় তাহলে কী হতে পারে?
যুদ্ধ বা সামরিক সংঘর্ষের সম্ভাবনা বাড়বে এবং মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা তীব্র হবে। - ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশল কী?
সরাসরি আলোচনা ও যাচাইকরণ কর্মসূচির মাধ্যমে চুক্তি নিশ্চিত করা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।