আন্তর্জাতিক ডেস্ক : গাজা ভূখণ্ডে ইসরাইলের সম্ভাব্য অভিযানের দিকে এখন সবার নজর। এই সংঘাত কি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে মোড় নেবে? হামাস কি টিকে থাকতে পারবে শেষ পর্যন্ত? মিসরই বা কেন মুসলমান প্রতিবেশীদের প্রবেশপথ বন্ধ করে রেখেছে?
সেভ দ্য চিল্ড্রেন বলেছে, গাজায় ইসরাইলি বোমার আঘাতে প্রতি ১৫ মিনিটে একটি শিশু নিহত হচ্ছে। মঙ্গলবার রাতে আল আহলি হাসপাতালে বর্বর হামলায় নিহতের সংখ্যা ৮০০ ছাড়িয়ে গেছে। স্মরণকালে ভয়াবহ এ হামলায় হতবাক বিশ্ব। একে ‘নৃশংস যুদ্ধাপরাধ’ বলছে আরব বিশ্ব।
গাজাবাসীর ওপর ইসরাইলের এই বর্বরতার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে পশ্চিম তীর থেকে শুরু করে জর্ডান, সিরিয়া থেকে সুদূর তিউনিসিয়াও। আরব বিশ্বের কয়েক কোটি মানুষও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু ২০১৪ সালে হামাস-ইসরাইলের মধ্যকার ৫০ দিনের যুদ্ধের সময় আরব বিশ্ব যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল, তার থেকে বর্তমানে বেশ কিছু বিষয় আলাদা।
আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এবারের পরিস্থিতি অনেকটাই ভিন্ন। জনরোষ থামাতে বাহ্যিকভাবে গাজাবাসীর প্রতি সমর্থন দিলেও তলে তলে ফিলিস্তিন ইস্যুতে অনেকটা অসহায় অবস্থায় আছেন আরব নেতারা। এছাড়া হামাসের কারণেই গাজাবাসী এমন দূর্ভোগে পড়েছেন- এমন প্রচারণা চালাচ্ছে আরব মিডিয়াগুলো।
২০২০ সালে চারটি আরব দেশ বাহরাইন, মরক্কো, সুদান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত একসময়কার বৈরী ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। সৌদি আরবও উল্লিখিত চারটি দেশের পথেই হাঁটছে।
এর আগে মাত্র দুটি দেশ মিসর ও জর্ডান ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। এই সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের ফলে এসব দেশের গণমাধ্যমেও বর্তমান হামাস-ইসরাইল সংকট কভার করার ধরন বদলে গেছে।
হামাসের অন্যতম দাতা দেশ কাতারের সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা হামাস-ইসরাইল সংকটকে বেশ প্রাধান্য দিচ্ছে। সেখানে গাজাবাসীর খবর প্রাধান্য পাচ্ছে।
কিন্তু সৌদি আরবের গণমাধ্যমগুলোকে গ্রহণ করতে হয়েছে কৌশলী অবস্থান। সৌদি গণমাধ্যমগুলো গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন-ধ্বংসযজ্ঞ তুলে ধরলেও হামাসকে কভারেজ দিচ্ছে না। কিন্তু প্রায়ই আরবিভাষী ইহুদিদের আলোচনায় ডেকে আনছে।
এর পাশাপাশি ফিলিস্তিনের প্রেক্ষাপটে ইসরাইলি সশস্ত্র বাহিনীকে দখলদার বাহিনী বলা হবে কি না, তা নিয়েও সৌদি আরবের গণমাধ্যমগুলোতে বিতর্ক রয়েছে।
দ্বিতীয় আরেকটি বিষয় হলো বড় আকারের সংঘাতের আশঙ্কা। ২০১৪ সালের যুদ্ধ ফিলিস্তিনে সীমাবদ্ধ থাকলেও এবার তা আশপাশের দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়ার তীব্র আশঙ্কা রয়েছে।
বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশগুলোতে। যেমন—যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মিসরকে উদ্বাস্তু গাজাবাসীদের আশ্রয় দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে মিসরীয়দের প্রতিক্রিয়া আগের মতো নয়।
মিসরীয় সমাজের বড় একটি অংশ চায় না গাজার উদ্বাস্তুদের গ্রহণ করতে। এ বিষয়ে মিসরের সরকারপন্থী রাজনীতি বিশ্লেষক ইব্রাহিম ঈসা হামাসকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনারা কেন আপনাদের যুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চাইছেন?
তিনি আরও বলেন, আপনারা কেন আপনাদের স্বার্থে ১০ কোটি মিসরীয়র জীবন বিপন্ন করতে চান?
অনেকে হয়তো বলতে পারেন, এটি মিসর সরকারের অবস্থান। কিন্তু বাস্তবতা হলো, মিসরের জনগণের বড় একটি অংশই এমন মনোভাব পোষণ করে।
একই পরিস্থিতি লেবাননেও। বিগত চার বছর ধরে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে থাকা লেবাননবাসী আশঙ্কা করছে, দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী গেরিলা গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ হয়তো ইসরাইলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে। ফলে রাষ্ট্র হিসেবে লেবানন ২০০৬ সালের মতো আবারও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে।
তৃতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, এই অঞ্চল আগের চেয়ে অনেক বেশি বিভক্ত। যেমন সিরিয়ায় ইসরায়েলবিরোধী মানুষের অভাব নেই। আবার হামাসবিরোধী মানুষেরও অভাব নেই।
এর বাইরেও বিগত কয়েক দিনে বিভিন্ন আরব দেশের অনেকেই গাজা ও হামাস সম্পর্কে এমন কিছু কথা বলেছেন, যা কেবল কট্টর ডানপন্থী ইসরাইলিদের পক্ষ থেকেই শোনা যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা জানিয়েছেন, হামাসের জন্য তাদের কোনো সমর্থন নেই। কিন্তু তারা খোলাখুলি বিষয়টি প্রকাশ করতে সাহস পান না।
অবশ্য বিপরীত চিত্রও আছে। যেমন—ফিলিস্তিন ইস্যুতে আলোচনার আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনকে কয়েক ঘণ্টা বসিয়ে রেখেছিলেন মোহাম্মদ বিন সালমান। তিনি এমনটা করেছেন, কারণ তার দেশের সাধারণ জনগণ এখনো ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার পক্ষে কথা বলে। জনরোষ কমাতে তিনি হয়তো এ ধরনের আচরণের আশ্রয় নিয়েছেন।
আবার জর্ডান ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিলেও গাজার আল আহলি আরব হাসপাতালে ইসরাইলি বোমা হামলার তীব্র নিন্দা করেছে।
এর প্রতিক্রিয়ায় দেশটির বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ ইস্যুতে বাইডেন ও মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসির সঙ্গে যে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল তা বাতিল করেন। এর কারণও একটি। ফিলিস্তিন ইস্যুতে জর্ডানের রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাধারণ জনগণের ক্ষোভ প্রশমন।
মঙ্গলবার রাতে গাজার একটি হাসপাতালে ইসরাইলের বিমান হামলায় ৮শ’রও বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। হামলার পর সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকাজুড়ে ফিলিস্তিনপন্থিদের বিক্ষোভ শুরু হয়েছে।
জর্ডানের পাশাপাশি তুরস্কে অবস্থিত ইসরাইলের দূতাবাস ও লেবাননে মার্কিন দূতাবাসের কাছে বিক্ষোভ শুরু হয়। ইরান, মরক্কো, তিউনিসিয়া, ইয়েমেন ও ইরাকেও বিক্ষোভ সংঘটিত হয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের (ওআইসি) সদস্যদের ইসরাইলের ওপর তেল নিষেধাজ্ঞাসহ অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান।
বুধবার সৌদি শহর জেদ্দায় ক্রমবর্ধমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিয়ে আলোচনার জন্য ওআইসির এক জরুরি বৈঠকে এ আহ্বান জানান তিনি।
এছাড়া গাজায় ইসরাইলের সংঘটিত সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধ নথিভুক্ত করতে ইসলামিক আইনজীবীদের একটি দল গঠনেরও আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।