আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইসরায়েলে তৈরি একটি সফটওয়্যার দিয়ে ভারতের বেশ কয়েকজন সামাজিক কর্মকর্তা, মানবাধিকার কর্মী ও সাংবাদিকের হোয়াটসঅ্যাপে নজরদারি চালানোর কথা স্বীকার করেছে ফেসবুক মালিকানাধীন মেসেজিং সংস্থাটি। পেগাসাস নামের ওই নজরদারি সফটওয়্যার যাদের ফোনে ইন্সটল করা হয়েছিল, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে হোয়াটসঅ্যাপ।
যদিও ওই ইসরায়েলি কোম্পানিটি বলেছে, তারা শুধুমাত্র সরকারি এজেন্সিকেই ওই সফটওয়্যার দেয়, তবে ভারত সরকার ওই সফটওয়্যার দিয়ে নজরদারী চালানোর কথা অস্বীকার করছে।
মানবাধিকার কর্মীরা অবশ্য সন্দেহ করছেন যে সরকার-বিরোধী আওয়াজ তুলছেন যারা, তাদের ওপরে কারা নজর রাখছে কোটি কোটি টাকা খরচ করে, সেটা বোঝা কঠিন নয়।
এমনিতে হোয়াটসঅ্যাপে ‘এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন’ থাকে, যাতে যিনি মেসেজ পাঠাচ্ছেন আর যাকে পাঠানো হচ্ছে- শুধু তারাই দেখতে পারবেন। কিন্তু পেগাসাস নামের ওই সফটওয়্যারটি যাদের ফোনে ইন্সটল করা হয়েছিল, তাদের ‘এনক্রিপশন ব্রিচ’ করা হয়েছে বলে হোয়াটসঅ্যাপ নিজেই জানিয়েছে।
এই নজরদারির শুরু এপ্রিল-মে মাস নাগাদ। ওই সময়েই হোয়াটসঅ্যাপে একটা ভিডিও কল এসেছিল শুভ্রাংশু চৌধুরীর। তিনি সেটা ধরেছিলেন কী না, তা এখন আর তার মনে নেই ছত্তিসগড় রাজ্যে আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করা এই সাবেক সাংবাদিকের।
তিনি বলেন, ‘অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আমার কাছে টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটা মেসেজ আসে যাতে বলা হয়েছে যে আমার হোয়াটসঅ্যাপে সম্ভবত নজরদারি চলছে। আমি প্রথমে গুরুত্ব দিই নি। কিন্তু তারপরে বেশ কয়েকবার একই মেসেজ আসায় আমি কয়েকজন পরিচিত সাইবার বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারাও জানান যে সত্যিই এরকম একটা তদন্ত চালাচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপ। তখনই আমাকে জানানো হয় যে ইসরায়েলের একটি সংস্থা এই স্পাইওয়্যারটি বানিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপে নজরদারি চালানোর জন্য।’
ওই একই সময়ে হোয়াটসঅ্যাপেই ভিডিও কল এসেছিল আরও বেশ কয়েকজনের কাছে- যাদের কেউ মানবাধিকার কর্মী, কেউ পত্রিকার সম্পাদক বা সাংবাদিক, কেউ দলিত আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আর কেউ আবার এমন কয়েকজনের আইনজীবী, যাদের বিরুদ্ধে সরকার বিরোধী কাজের অভিযোগ আনা হয়েছে।
শুভ্রাংশু চৌধুরী জানান, টরোন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সিটিজেন ল্যাব’ হোয়াটসঅ্যাপের সঙ্গে যৌথভাবে এ বিষয়টি তদন্ত করছিল।
তার কথায়, ‘এতদিন আমাদের বিষয়টা প্রকাশ না করতে অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু দিন-দুয়েক আগে হোয়াটসঅ্যাপ আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে বলেছে যে সত্যিই আমার ফোনে ওই নজরদারির সফটওয়্যার ইন্সটল হয়েছে একটি ভিডিও কলের মাধ্যমে। আমি জানি না আমার ফোনে রাখা কোন তথ্য ফাঁস হয়েছে বা আদৌ কিছু চুরি হয়েছে কী না। তবে আমার ফোনে এমন কোনও গোপন তথ্য থাকে না যেগুলো কেউ জেনে ফেললে আমার সমস্যা হবে।’
ভিডিও কলের মাধ্যমেই স্পাইওয়্যারটি মোবাইল ফোনে ইন্সটল হয়ে যায়। যদি সেই ফোন রিসিভও না করা হয়, তবুও সফটওয়্যারটি ফোনে ইন্সটল হয়ে যায় – অর্থাৎ যার ফোনে নজরদারি চালানো হবে বলে টার্গেট করা হয়েছে, তার বিশেষ কিছু করার নেই বলেই মন্তব্য সাইবার বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত কুমার রায়ের।
তিনি বলেন, ‘সাধারণত কোনো লিঙ্কে ক্লিক করলে ফোন বা কম্পিউটারে এরকম স্পাইওয়্যার ইন্সটল হয়ে যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে হোয়াটসঅ্যাপ আর ফোনের অপারেটিং সিস্টেমগুলোর একটা গলদ খুঁজে বার করেছিল ওই সংস্থাটি। সেটা ব্যবহার করে গোটা ফোনেরই দখল নিয়ে নিচ্ছিল তারা। এনক্রিপ্টেড মেসেজ ডিক্রিপ্ট হয়ে যাচ্ছিল আবার ফোনের মাইক আর ক্যামেরা দিয়ে আপনি যা বলছেন বা দেখছেন, সেগুলোও দেখা যাচ্ছিল। হোয়াটসঅ্যাপ অবশ্য এখন সেই গলদটা খুঁজে বার করেছে আর একটা আপডেট দিয়েছে ব্যবহারকারীদের। কিন্তু তার আগেই পৃথিবী জুড়ে বহু মানুষের হোয়াটসঅ্যাপের দখল নিয়ে নিয়েছিল পেগাসাস।’
হোয়াটসঅ্যাপ বলছে ইসরায়েলি সংস্থা এন.এস.ও পেগাসাস নামের ওই স্পাইওয়্যার তৈরি করেছে যা দিয়ে দুদিক থেকেই এনক্রিপ্টেড এই মেসেজিং ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে পড়ে নজরদারি চালানো যায়। ওই ইসরায়েলি সংস্থাটির বিরুদ্ধে মামলা করেছে হোয়াটসঅ্যাপ।
এন.এস.ও এক বিবৃতিতে অবশ্য বলছে, তারা শুধুমাত্র সরকার এবং সরকারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষী বাহিনী এবং গোয়েন্দা দপ্তরগুলোকে এই সফটওয়্যারটি বিক্রি করে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অস্ত্র হিসাবে।
হোয়াটসঅ্যাপে নজরদারি চালানোর এই ঘটনা সামনে আসার পরে ভারতের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিজেপি সরকারের দিকেই আঙ্গুল তুলছে। ভারত সরকার বলছে, তারা এই নজরদারির সঙ্গে যুক্ত নয়।
কিন্তু মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক বা মাওবাদীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগ রয়েছে যাদের বিরুদ্ধে, সেইসব ব্যক্তি এবং তাদের আইনজীবীদের ওপরে তাহলে কারা নজর রাখছিলেন কোটি কোটি ডলার খরচ করে?
মানবাধিকার আন্দোলনের নেতা সুজাত ভদ্রের কথায়, ‘এই সর্বগ্রাসী নজরদারি ভারত রাষ্ট্রই চালিয়েছে। যারাই সরকার-বিরোধী কথা বলছে, নির্দিষ্টভাবে তাদের ফোনেই এভাবে নজরদারি চালানো হয়েছে। এখনও হয়ত পুরো তালিকা আমরা পাই নি। কিন্তু সরকার ছাড়া কে এ কাজ করবে? বিষয়টা জানাজানি হতেই দেখছি সরকার একটা বিবৃতি দিয়ে বসল। চারদিকে এত কিছু হয়- কই তখন তো সাত তাড়াতাড়ি বিবৃতি দিতে দেখি না? সেখান থেকেই সন্দেহ হয় যে আরও বেশি তথ্য বেরিয়ে আসা যাতে আটকানো যায়, সেজন্যই আগেভাগে বিবৃতি দিয়ে দিল সরকার।’
সাইবার বিশেষজ্ঞ প্রশান্ত কুমার রায় বলেন, ‘যাদের হোয়াটসঅ্যাপে এই পেগাসাস ইন্সটল করা হয়েছিল, তারা যা কাজকর্ম করেন, সেকারণেই ভারতের রাষ্ট্রীয় এজেন্সিগুলি এই নজরদারিতে যুক্ত আছে বলে সন্দেহ হচ্ছে। এরা সকলেই সামাজিক কর্মকর্তা বা সাংবাদিক বা আইনজীবী যারা দলিত আর আদিবাসীদের সঙ্গে কাজ করেন। আমি তো অনেক ভেবেও এমন কোনো দেশের নাম খুঁজে পেলাম না যাদের এই কয়েকজনের কাজকর্ম নিয়ে আগ্রহ থাকার বিন্দুমাত্র কারণ আছে। এমন কি পাকিস্তানও বা কেন এদের ব্যাপারে আগ্রহী হবে?’
শুভ্রাংশু চৌধুরী বলেন, ‘আমি জানি না কে বা কারা আমার ফোনে নজরদারি চালাচ্ছিল। তবে যেই করে থাকুক সেটা বেআইনি এবং আমার ব্যক্তিগত পরিসরে সরাসরি হস্তক্ষেপ। আমরা মাওবাদী অধ্যুষিত অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনার কথা বলি- ছত্তিশগড়ের আদিবাসীদের তাদের নিজেদের সমস্যার কথা সরকারের কাছে তুলে ধরার কাজ করি। তাই আমরা চাই সরকার সেগুলো শুনুক। কিন্তু সেই কথাবার্তা শোনা যদি আইনি উপায়ে হত, আমার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু বেআইনিভাবে কেউ কেন আমার কাজের ওপরে নজরদারি চালাবে?’ সূত্র: বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।