জুমবাংলা ডেস্ক : আম গাছের ওপর সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ থাকবে আম চাষীর। এক একটি আম গাছের উচ্চতা হবে একজন মানুষের সমান। ফলে পরিচর্যাও করা যাবে ইচ্ছেমতো। আর উচ্চতা কম হওয়ায় গাছে আসা শতভাগ আমেই ফ্রুট ব্যাগিং করা সম্ভব। গুড এ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস-গ্যাপ অনুযায়ী চাষাবাদ হওয়ার কারণে এই আম সম্পূর্ণ বিদেশে রফতানি উপযোগী। এছাড়াও বাগানের প্রতি ইঞ্চি জায়গা ব্যবহার করা সম্ভব ইসরায়েলের প্রযুক্তি আলট্রা হাইডেনসিটি বা অতি ঘণ পদ্ধতিতে।
সাধারণত চিরাচরিত নিয়মে যেখানে এক বিঘা বাগানে কৃষি বিভাগ ১.৩ টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে থাকেন সেখানে ইসরায়েলের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধডু ব্যবহার করে বিঘা প্রতি আমের উৎপাদন হবে ৫ টন। আর ইসরায়েলের এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আম চাষে সফলতা পেয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের একজন সফল আম চাষী, ব্যবসায়ী, রফতানিকারক এবং শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রোডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিডেটের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল খান শামীম।
তিনি জানান, ফিলিপাইনে কোকাকোলার ম্যাংগো প্রজেক্ট, ভারতের তামিলনাড়– প্রদেশের কয়েমবাটরের জেইন এগ্রোর বিভিন্ন বাগান ও থাইল্যান্ডের বিভিন্ন বাগান পরিদর্শণ করে আম চাষের প্রতি আগ্রহ বাড়ার কারণে ইসরায়েলের আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতি ব্যবহার করে তিন বছর আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার একাডেমী মোড়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় এই আম বাগান। যদিও সেচের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের ডিপ ইরিগেশন প্রযুক্তি বাদ দিয়ে দেশীর পদ্ধতি ব্যবহার করে গড়ে তোলা হয় ৪ বিঘার এই বাগান। কারণ ওই পদ্ধতি ব্যবহার করলে ৪ বিঘার একটি আম বাগানে প্রায় লাখ টাকার মতো ব্যায় বৃদ্ধি পাবে। আর আমাদের এই এলাকায় এতো বেশি পানির প্রয়োজন হবে না বিধায় সেচের ক্ষেত্রে দেশীয় পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। এখানে বারোমাসি কাটিমন জাতের প্রায় ১ হাজার আমগাছ রয়েছে। আর মাত্র তিন বছরেই এখন এই বাগানে থোকায় থোকায় ঝুলছে আম।
তিনি আরো বলেন, আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে একই পরিমান জমিতে প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় অনেক বেশি গাছ রোপন করা যায়। ফলে ফলন হয় অন্তত তিনগুন বেশি। ইসরায়েলের এই আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে আম উৎপাদন হলেও বাংলাদেশে এই প্রথম এই পদ্ধতি ব্যবহার করে আম চাষ শুরু করেছি। ইতোমধ্যে সুইজারল্যান্ড ও বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে এবং সুইচকন্টাক্ট ও স্থানীয় সরকার বিভাগের (এলজিইডি) যৌথ বাস্তবায়নে আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে আম চাষের উদ্ভাবনী দিকগুলো নিয়ে কাজ শুরু করা হয়েছে।
আমচাষি ইসমাইল খান শামীম বলেন, ভারতের তামিলনাড়ু ও ফিলিপাইনে কোকাকোলার ম্যাংগো প্রজেক্ট দেখে ইসরায়েলের আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে আমচাষের প্রতি আগ্রহ বাড়ে। সেই থেকে তিন বছর আগে এই বাগান শুরু করি। কিন্তু ইসরায়েলের এই প্রযুক্তির একটি অংশ ড্রিপ ইরিগেশন (বিন্দু সেচ) আমি বাদ দিয়েছি। কারণ আমাদের এই এলাকায় এতো বেশি পানির প্রয়োজন হবে না এবং ড্রিপ ইরিগেশনে অনেক বেশি খরচ হবে। যা চার বিঘার একটি আম বাগানে প্রায় লাখ টাকার মতো। তাই ইসরায়েলের আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতির সঙ্গে এখানে শুধুমাত্র সেচের ক্ষেত্রে দেশীয় পদ্ধতি যুক্ত করেছি।
তিনি জানান, বারোমাসি কাটিমন জাতের আম চাষ করেছেন। ফলে আমের মৌসুম থাকবে এমন সময়ে তার গাছে ফলন দেবে। দেশে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে বিদেশ থেকে এক শ্রেণির ক্রেতার জন্য আম আমদানি করতে হয়। এই প্রযুক্তির সম্প্রসারণ হলে বিদেশ থেকে আম আমদানির প্রয়োজন হবে না। তার বাগানে বিঘা প্রতি প্রথম বছরে খরচ হয়েছে ৫৮ হাজার টাকা। দ্বিতীয় বছর ২৫ হাজার ও তৃতীয় বছরে বিঘা প্রতি আমগাছের সেচ ও পরিচর্যা করতে ব্যয় হয়েছে ২৭ হাজার টাকা।
ইসমাইল খান শামীম বলেন, বারোমাসি জাতের আম হওয়ায় প্রচলিত দামের তুলনায় ৪-৫ গুণ দামে বিক্রি করা যাবে আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে চাষ করা আম। এই প্রযুক্তির বাগানে উৎপাদন খরচ কম। এই প্রযুক্তির বাগানে ৯৫ শতাংশ প্রিমিয়াম কোয়ালিটির আম পাওয়া যায়। গাছ লাগানোর পাঁচ বছর পর থেকে প্রতি বিঘা জমিতে উৎপাদন হয় ৪-৫ মেট্রিক টন আম। আমাকে দেখে চলতি বছরে শিবগঞ্জের কয়েকজন চাষিও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আম বাগান শুরু করেছেন। তাদেরকে বিভিন্ন সময়ে নানা রকম পরামর্শ দিচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আম পাড়ার পরই গাছের ওপর থেকে ৬-১০ ইঞ্চি করে ডাল কেটে ফেলতে হয়। এমনকি এই পদ্ধতিতে ২৫-৩০ বছর পর্যন্ত ভালো ফলন পাওয়া যায়। আমাদের প্রচলিত ধারণা, আম গাছ লাগানোর কয়েক বছর পর থেকে গাছে ফলন দেবে। কিন্তু ইসরায়েলের এই প্রযুক্তি ব্যবহারে গাছ লাগানোর প্রথম বছর থেকেই আম উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। উত্তর-দক্ষিণ বরাবর সাড়ে ৬ ফুট পরপর এবং পূর্ব-পশ্চিম বরাবর সাড়ে ৯ ফুট গাছ লাগানোর কারণে বাগানের প্রতি একক জায়গা ব্যবহার করা যায়।
প্রচলিত পদ্ধতিতে আম চাষে প্রায় ৩০ শতাংশ আম নষ্ট হলেও এই পদ্ধতিতে নষ্ট হওয়ার সুযোগ নেই। সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো- বাগান পরিচর্যায় লোকবল ও খরচ কম লাগে। এছাড়াও গাছের প্রত্যেকটি ডাল ও আমের প্রতি নজর রাখা যায় ও পরিচর্যা করা সহজ। আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে ল্যাংড়া, আম্রপালি, গৌড়মতি, বারি আম-৪, বারি আম-১১, কাটিমন, হাড়িভাঙ্গা, ব্যানানাসহ বিভিন্ন প্রচলিত জাতের আম চাষ করা যায় বলে জানান এই আমচাষি।
আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. কামরুল ইসলাম আলট্রা হাইডেনসিটি প্রযুক্তি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথম এই পদ্ধতিতে আম চাষাবাদ শুরু হয়েছিল। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা সেখানে গিয়ে দেখতে পান, অতিঘন মাত্রায় লাগানো হয়েছে আমগাছ। এর ফলাফল ও কার্যকারিতা নিয়ে এরপর থেকেই গবেষণা শুরু হয়েছে ভারতে। বাংলাদেশেও আমরা এ নিয়ে গবেষণা করে আসছি।
তিনি আরও বলেন, মূল বিষয়টি হলো একটি জায়গার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে অল্প সময়ে অধিক ফলন নিশ্চিত করায় এই পদ্ধতির লক্ষ্য। ধরুন, প্রচলিত পদ্ধতিতে দুটি গাছ ২০ ফুট দূরত্বে লাগালে ১০ কেজি করে ২০ কেজি ফলন দেবে। এই গাছ দুটির মাঝখানে অনেক ফাঁকা থাকবে। অথচ আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে একই পরিমাণ জায়গায় ৬টি গাছ লাগালে ১০ কেজির বদলে ৮ কেজি করে ফলন দিলে ৪৮ কেজি আম পাওয়া যাবে। অর্থাৎ একই পরিমাণ জায়গায় প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে ২-৩ গুণ বেশি ফলন পাওয়া সম্ভব।
ড. কামরুল হাসান আরও বলেন, প্রচলিত পদ্ধতিতে আমের পূর্ণ ফলন পেতে ৭-১০ বছর সময় লাগে। অথচ আলট্রা হাইডেনসিটি প্রযুক্তি ব্যবহারে ৩ বছরেই পূর্ণ ফলন পাওয়া যায়। আমরা এখন স্বাস্থ্য সচেতনতার দিকে বেশি জোর দিচ্ছি। সেক্ষেত্রে আলট্রা হাইডেনসিটিতে প্রতিটি ফল ব্যাগিং করা যায়। গাছে রোগ-বালাই দমনের কিছু পদ্ধতি রয়েছে যা হাত দিয়ে দমন করতে হয়। এক্ষেত্রে তা করা সম্ভব। যা প্রচলিত পদ্ধতিতে বড় গাছে সম্ভব নয়। বিভিন্ন রোগাক্রান্ত ডালপালা কেটে ফেলা যায় সহজেই। সার্বিক দিক বিবেচনায়, এটি আগামীতে অত্যান্ত কার্যকরী পদ্ধতি হতে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) রাজিবুর রহমান বলেন, আলট্রা হাইডেনসিটি একটি খুবই ভালো প্রযুক্তি। আমরা জানি, একটি গাছের ফলন মাটি ও পানি থেকে খাদ্যগ্রহণ, সূর্যের আলো ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। এছাড়াও যেই গাছের ডোগায় সূর্যের আলো পৌঁছাবো, সেই ডোগাতেই আম ধরবে। আর যেগুলোতে সূর্যের আলো যাবে না, সেখানে আম ধরবে না। যেহেতু চাঁপাইনবাবগঞ্জের পরিবেশ আম চাষের উপযোগী। সেক্ষেত্রে আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে গাছের প্রত্যেকটি ডোগায় সূর্যের আলো পায়। প্রত্যেকটি গাছ প্রয়োজনমতো পানি পায়। নিদিষ্ট পরিমাণ দূরত্ব বজায় রেখে পরিচর্যা করা যায় বলে আমের উৎপাদন কয়েকগুণ বেশি হয়।
তিনি আরও বলেন, আমরা চাই সবগুলো আমের বাগান আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে হোক। পুরাতন সব গাছ কেটে নতুনভাবে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আম চাষাবাদ শুরু হোক। আলট্রা হাইডেনসিটি পদ্ধতিতে আম চাষে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কৃষকদের নানা ধরনের পরামর্শ ও সহায়তা প্রদান করা হয়। এছাড়াও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আম চাষাবাদ করতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে কাজ করছে কৃষি বিভাগ। সূত্র : ঢাকা পোস্ট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।