মীযান মুহাম্মাদ হাসান : প্যারেন্ট ইংরেজি শব্দ। গুগলের যুগে আমরা গুগল সার্চ করে দেখতে পারি, গুগল কী লিখেছে, একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে যাদের ভূমিকা থাকে এবং যাদের ওপর শিশু নির্ভর করে, তাদেরকে প্যারেন্টস বলা হয়।
আবহমানকালের চিরাচরিত প্রথা হলো– সন্তান লালন পালনে মায়ের ভূমিকাই মুখ্য। সময়ের ব্যবধানে নারী ও পুরুষ উভয়ে যখন কর্মমুখী। সারাক্ষণ ব্যস্ত অফিস আদালত কিংবা ব্যবসায়; তখন সন্তান লালন পালনের গুরু দায়িত্বটি হয়ত পালন করছেন তাদের নানা নানি; দাদা দাদি অথবা অন্য যে কেউ।
কর্মব্যস্ত জীবনে একজন পুরুষ সারাদিন বাইরে অফিসে, ব্যবসায় কিংবা খেত খামারে মাঠে সময় দিচ্ছেন। তার জন্য ঘরে সময় দেওয়া বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলা। ঘোরাঘুরি করা। কোথাও বেড়াতে যাওয়া– চাইলেও এসব আর সম্ভব হচ্ছে না। হয়ে উঠছে না।
একই সঙ্গে এখনকার মায়েরাও যেহেতু কর্মসচেতন। আত্মসচেতন। সুতরাং তারাও কর্মী হচ্ছেন। কাজ করছেন। অফিস আদালতে ব্যবসায় ঝুঁকছেন।
তাই চাইলেও তারা ঘরে সময় দিতে পারছেন না। সম্ভব হয়ে উঠছে না। সুতরাং সন্তানের দেখভাল করার সময় সুযোগ হয়ে উঠছে না। ফলে আমাদের অবহেলা অনাদরে অকাতরে বখে যাচ্ছে আমাদের আদরের ছেলে মেয়ে। তবে কীভাবে আমরা প্যারেন্টিং বা সন্তান লালন পালন করব?
এভাবে নিজেদের অজান্তেই আমাদের শিশুরা মাতৃস্নেহের অভাব বোধ করছে। তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তারা সঠিক পরিচর্যায় বেড়ে উঠছে না। অনেক সময় কাজের বুয়া বা বেবিকেয়ারের তত্ত্বাবধানে লালিত পালিত হবার কারণে, শিশুরা তাদের মতো আচার আচরণ করতে শুরু করছে। বখে যাচ্ছে। বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বিপদগামী হচ্ছে আমাদের অজান্তেই।
দৈনিক পত্রিকাগুলো বলছে– অভিভাবকদের সচেতনতার অভাবে অনেক ছেলে মেয়ে বখে যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে তাদের আচরণ, চলাফেরা। তারা গভীর রাত পর্যন্ত বাইরে সময় পার করছে। পড়াশোনাও করছে না নিয়মিত।
আরও ভয়াবহ চিত্র হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রায় ৭০ লাখ মানুষ মরণব্যাধি মাদকে আসক্ত। যার ৮০ শতাংশ যুবক। ০২/০২/১৮ দৈনিক ইত্তেফাক। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরাও আজ মাদকে আসক্ত। ১৬/০৩/১৭ বাংলাদেশ প্রতিদিন
অনুমান করা যায়, কীভাবে আমাদের সন্তানরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম! ইসলাম সন্তান লালন পালনের ক্ষেত্রেও আমাদেরকে দিয়েছে দিকনির্দেশনা। কুরআনে কারিমে, আল্লাহ তাআলা বলেন– হে মুমিনগণ! তোমরা নিজেরা বাঁচো। তোমাদের পরিবার পরিজনকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচাও। (সুরা তাহরিম ০৬)
হযরত আলি রা. এ আয়াতের তাফসিরে বলেন, তোমরা নিজেরা উত্তম জিনিস শিখো। তোমাদের পরিবার পরিজনকে উত্তম জিনিস শিক্ষা দাও। (মুস্তাদরাকে হাকিম : ৩৮৬২)
উল্লিখিত আয়াত ও হাদিসের ব্যাখ্যা থেকে আমরা জানতে পারলাম, সন্তানকে ভালো ও উত্তম জিনিস শেখানো আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
এজন্য অভিভাবক হিসাবে আমাদেরকে সন্তানের জন্য আদর্শ শিক্ষা ও তার নৈতিক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করাও জরুরি। নয়ত সন্ত্রাসবাদ, মাদক ইয়াবার মতো ভয়াবহ অন্যায় ও অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়বে আমাদের সন্তানরা।
গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ঢাকার বেইলি রোডে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা কারও অজানা নয়। যেখানে অভিশ্রুতি শাস্ত্রী নামের একটি মেয়ের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তার বাবা তাকে মুসলিম বলে দাবি করেছেন। তার নাম হলো বৃষ্টি খাতুন। মেয়েটি একটি কলেজে পড়াশোনা করতেন।
পাশাপাশি সাংবাদিকতা করতেন অনলাইন জার্নাল-এ। দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন শিরোনাম করেছে– ‘অভিশ্রুতি না বৃষ্টি এখনও অজানা’ মূল সংবাদে তারা বলছে, রমনার কোনো মন্দিরের সভাপতি দাবি করেছেন, অভিশ্রুতি সনাতন ধর্মাবলম্বী। ০৪/০৩/২৪
চিন্তার বিষয় হচ্ছে, মা বাবা তাকে পড়াশোনার জন্য পাঠিয়েছেন। কিন্তু বেচারি তার দীন ধর্ম আদর্শ এমনকি নামও পরিবর্তন করে ছেড়েছেন। ঠিক এভাবেই আমাদের অবহেলার কারণে আমাদের সন্তানও যে ধর্মীয় পরিচয় বাদ দিয়ে কখন কীভাবে বিধর্মী হয়ে উঠবে। আছে কী আমাদের কোনো খবর? আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করুন আমাদেরকে।
সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত হয়েছে, রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- তোমরা সাত বছর বয়সে সন্তানকে নামাজের আদেশ করো। দশ বছর বয়সে নমাজ আদায় না করলে, শাসন করো। এ হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি, সন্তানের শিক্ষার বয়সটাও শৈশবে হওয়া উচিত। এজন্য শৈশবে সন্তানদেরকে আদর্শ শিক্ষা, নীতি নৈতিকতার জ্ঞান, বড়োদের শ্রদ্ধা-সম্মান করা ইত্যাদি শেখানো কর্তব্য। অন্যথায় তারা বখে যেতে পারে।
সেই সাথে পারিবারিক বন্ধন। সন্তানকে সময় দেওয়া। তার সঙ্গে কথা বলা ইত্যাদি বিষয়ে খোঁজ খবর নেওয়াও একজন সচেতন অভিভাবকের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
অন্যথায় ডিপ্রেশনে পড়ে। মানসিক বিকারগস্ত থেকে। কিংবা হীনমন্যতা থেকে যে কোনো সময় আমার আপনার সন্তান নষ্ট হতে পারে। বখাটে উগ্র হয়ে যেতে পারে। বেছে নিতে পারে আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ পথও। যা ইদানীং খুব বেশি ঘটে চলছে আমাদের এই সমাজে।
এজন্য প্রতিটি বাবা মার দায়িত্ব হলো, সন্তানের সুশিক্ষা ও আদর্শ জীবন যাপন নিশ্চিত করা। যা সন্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকারও। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিকভাবে সন্তানের অধিকারগুলো আদায় ও প্রতিপালন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: খতিব, ভবানীপুর মাইজপাড়া হক্কানি জামে মসজিদ, গাজীপুর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।