পারস্পরিক সাক্ষাৎ এবং বিশেষ দিনে শুভেচ্ছা বিনিময় একটি সুপ্রাচীন রীতি। প্রতিবেশ ও সামাজিক বন্ধনের ফলে মুসলিম সমাজের অভ্যন্তরে; এমনকি বাইরে অমুসলিমদের সঙ্গেও শুভেচ্ছা বিনিময় করতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে এসব বিষয়ে ইসলামের সুন্নাহ বা সংস্কৃতি কী?
ইসলামে শুভ-অশুভের ধারণা
বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতিতে শুভ-অশুভের ধারণা আছে। ইসলামে অশুভ কুলক্ষণের কোনো চর্চা নেই; বরং আছে শুভের ধারণা।
ইসলামে শুভ মানে পারস্পরিক কল্যাণ কামনা। আনাস (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, ইসলামে সংক্রামক ব্যাধি আর কুলক্ষণ বলতে কিছুই নেই। তবে ফাল তথা শুভ লক্ষণ আমাকে আনন্দিত করে। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, ফাল কী? তিনি বললেন, উত্তম বাক্য।
(সহিহ বুখারি, হাদিস ৫৭৭৬) অর্থাৎ সুন্দর শব্দ ও উত্তম বাক্য শুনে মনে মনে কল্যাণের আশা পোষণ করা।
ইসলামে শুভেচ্ছারীতি
ইসলামে মুসলমানদের পরস্পরকে শুভেচ্ছা জানানোর রীতি আছে। ইসলামের শুভেচ্ছা রীতির মধ্যে রয়েছে—
১. তাহিয়্যা বা সালাম : পবিত্র কোরআনের ভাষায় সালাম পদ্ধতিকে তাহিয়্যা বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের একাধিক আয়াতে উদ্ধৃত ‘সালামুন আলাইকুম’ অংশ থেকে নবী (সা.)-এর যুগ থেকে মুসলিমদের পারস্পরিক সাক্ষাতে ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’ বলা এবং উত্তরে সমবাক্য কিংবা একটু বাড়িয়ে বলা সুন্নত।
সালামের পুরো সুন্নতটি ইসলামী সংস্কৃতি এবং মুসলিমদের নিজস্ব সুন্নাহ, যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা মুসলিমদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
নবীজি (সা.) ও সাহাবিরা কারো অভিবাদনের উত্তরে একটু বাড়িয়ে শুভকামনা জানাতেন। মূলত এটা পবিত্র কোরআনের শিক্ষা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যখন তোমাদেরকে অভিবাদন করা হয়, তখন তোমরাও তা অপেক্ষা উত্তম অভিবাদন করো অথবা অনুরূপ করো।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৮৬)
২. মুসাফাহা বা হাত মেলানো : পরস্পরের হাতের তালু মিলিয়ে হাত মেলানোকে ‘মুসাফাহা’ বলে।
সর্বপ্রথম ইয়েমেনের লোকেরা এই পদ্ধতি চালু করে।
(সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৫২১৩)
ইসলাম সৌহার্দ্য প্রকাশের এই রীতি অনুমোদন দিয়েছে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখনই কোনো দুই মুমিন ব্যক্তি সাক্ষাৎ করে পরস্পর মুসাফাহা করে, তখনই তাদের পৃথক হয়ে প্রস্থান করার পূর্বেই উভয়কেই ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৭২৭)
৩. মুআনাকা বা কোলাকুলি : উনক মানে ঘাড় বা স্কন্ধ। সাহাবিরা যখন সফর থেকে ফিরে আসতেন এবং পরস্পর সাক্ষাৎ করতেন, তখন মুআনাকা করতেন এবং দুই চোখের মাঝখানে কপালে একে অন্যকে চুমু খেতেন। জাফর ইবনে আবি তালিব (রা.) হাবশা থেকে ফিরে মদিনায় এলে রাসুল (সা.) তাঁর সঙ্গে মুআনাকা করলেন এবং তাঁর কপালে চুমু দিলেন। (আবু দাউদ)
৪. তাকবিল বা চুমু খাওয়া : উল্লিখিত হাদিসে মুসলিমদের পরস্পর চুমু খাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ও ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.) ফিতনার আশঙ্কায় কোলাকুলি ও চুমু খাওয়া জায়েজ মনে করেন না। রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমরা পরস্পর মিলিত হলে কি একে অন্যকে চুমু দেব? রাসুল (সা.) বললেন, না। আবার প্রশ্ন করা হলো, তবে কি মুআনাকা করব? তিনি বললেন, না। আবার প্রশ্ন করা হলো, পরস্পর মুসাফাহা করব? তিনি বললেন, হ্যাঁ। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২৭২৮)।
এ ধরনের নিষেধ ফিতনার আশঙ্কা করা হয়েছে। তবে দুই চোখের মাঝখানে কপালে চুমু দিতে কোনো অসুবিধা নেই।
৫. তারহিব ও তাহলিল : আরবি ভাষায় কোনো আগুন্তুক ব্যক্তিকে মারহাবা বলে অভিবাদন জানানোকে আত তারহিব বলে। অনুরূপভাবে কাউকে আহলান সাহলান বলে অভ্যর্থনা জানানকে আত তাহলিল বলে। এভাবে সবাহার খাইর বা সুপ্রভাত এবং মাসায়াল খাইর বা শুভ সন্ধ্যা বলেও অভ্যর্থনা জানানো হয়।
৬. তাবাসসুম বা মুচকি হাসি : কোনো মুসলিম ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে মুচকি হেসেও শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। রাসুল (সা.) বলেন, ‘প্রত্যেক কল্যাণমূলক কর্মই সদকাহ। আর তোমার ভাইয়ের সঙ্গে তোমার হাসিমুখে সাক্ষাৎ করা এবং তোমার বালতির সাহায্যে তোমার ভাইয়ের পাত্র ভরে দেওয়াও কল্যাণমূলক কর্মের পর্যায়ভুক্ত।’
(সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৯৬২)
৭. তাহনিয়া বা শুভকামনা : তাহনিয়া মানে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানানো। কাউকে কোনো বিশেষ অর্জনের আশীর্বাদ বা শুভকামনা করা এ পর্যায়ে পড়ে। কারো জন্য শুভকামনা জানিয়ে দোয়া করাও তাহনিয়া। রাসুল (সা.) নব দম্পতির জন্য তাহনিয়া করেছেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা বরকতময় করুন এবং তোমার ওপরও বরকত বর্ষণ করুন। আর তোমাদের উভয়কে কল্যাণে একত্রিত করুণ।’
(সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ২৯০৫)
অমুসলিমদের সঙ্গে শুভেচ্ছা
অমুসলিমদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় ইসলামে মৌলিকভাবে বৈধ। তবে ইসলামের শুভেচ্ছা বিনিময়ের সব পদ্ধতি তাদের ক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য নয়।
১. সালাম ইসলামের বিশেষ আকিদাসংশ্লিষ্ট ইবাদত। ফলে তা শুধু মুসলিমদের অভ্যন্তরে অনুশীলিত হবে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপর তা প্রয়োগযোগ্য নয়। অমুসলিমদের সঙ্গে সাক্ষাতে মুসলিমদের প্রথমে তাদের সালাম দেওয়া নিষিদ্ধ। তবে কোনো অমুসলিম সালাম দিলে ‘ওয়ালাইকুম’ বলা অনুমোদিত।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ এবং আবু উমামা (রা.) মাকরূহ মনে করা সত্ত্বেও প্রতিবেশী হওয়ার দরুন অমুসলিমকে নিজ থেকে অগ্রগামী হয়ে সালাম দিয়েছেন।
(তাফসিরে কুরতুবি : ১১/১১১-১১২)
ইমাম আওজায়ি (রহ.) বলেছেন, ‘আমি যদি সালাম দিই, পূর্ববর্তী সৎকর্মশীলরা তো সালাম দিয়েছিল। আর আমি যদি পরিহার করি, পূর্ববর্তী সৎকর্মশীলরা তো পরিহারও করেছিল। (জাদুল মাআদ : ২/৩৮৮)
২. মালিকি মাজহাবে একজন মুসলিমের জন্য নিজ থেকে অগ্রগামী হয়ে অমুসলিমদের সঙ্গে প্রয়োজন কিংবা অপ্রয়োজন সর্বাবস্থায় মুসাফাহা করা হারাম। (হাশিয়াতুল আদবি : ২/৬১৯)
৩. হানাফি, শাফেয়ি ও হাম্বলি মাজহাবে অপ্রয়োজনে এমন কাজ মাকরুহ বা নিন্দিত কর্ম। (মাজমু : ১৯/৪১৫)
৪. অন্যদিকে অমুসলিম কেউ অগ্রগামী হয়ে মুসাফাহার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলে তাতে সাড়া দিয়ে মুসাফাহা করা শরিয়তে অনুমোদিত। নবী (সা.) বলেন, ‘তুমি যেখানেই থাকো, আল্লাহ তাআলাকে ভয় করো, মন্দ কাজের পরপরই ভালো কাজ করো, তাতে মন্দ দূরীভূত হয়ে যাবে এবং মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণ করো।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৯৮৭)
আল্লাহ তাআলা সব বিষয়ে ভালো জানেন। (সংক্ষেপিত)
লেখক : প্রক্টর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।