গৌরাঙ্গ নন্দী : ঘূর্ণিঝড় রিমালের আঘাতে সুন্দরবন উপকূলে ৬১ কিলোমিটার নদী-বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধের কোথাও কোথাও বড় ধরনের ভাঙন-ফাটল দেখা দিয়েছে, কোথাও একেবারে ধসে গিয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) খুলনার প্রধান প্রকৌশলী বিদ্যুৎ কুমার সাহার উদ্ধৃতি দিয়ে কালের কণ্ঠ’র এক প্রতিবেদনে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জেলায় নদী-বাঁধের এই ক্ষতির কথা বর্ণিত হয়েছে; যার মধ্যে সাতটি স্থানে বেশ বড় ধরনের ভাঙন দেখা দিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো হচ্ছে খুলনার দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের বটবুনিয়ার ঢাকি নদীর ডান তীরে এবং পানখালী-খলসি এলাকার পশুর নদে।
শিবসা ও ঢাকি নদীর কামিনীবাসিয়া গ্রাম সংলগ্ন নদী-বাঁধের পাঁচটি পয়েন্ট ভেঙে পানি প্রবেশ করছে। পাইকগাছা উপজেলার দেলুটি ইউনিয়নের ভদ্রা নদীর ভাঙনে বাঁধ ভেঙেছে। সাতক্ষীরা সার্কেলের কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশীর হরিহরপুরে শাখবাড়ী নদীর ভাঙন; মহারাজপুর ইউনিয়নের দশহালিয়ায় কপোতাক্ষ নদের ভাঙন; মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের নয়ানি এলাকার বাঁধের নিচু জায়গা ছাপিয়ে পানি ঢুকেছে এবং দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নে বাঁধ ভেঙেছে। বাগেরহাট জেলার মোরেলগঞ্জ উপজেলার বলাইবুনিয়া ইউনিয়নের শ্রেণীখালী-দৈবজ্ঞহাটিতে পানগুছি নদীর তীরে এবং বাগেরহাট সদরের দড়াটানা নদীর ভাঙনে বাঁধ ভেঙেছে।
এসব ভাঙনে কমপক্ষে ৪০টির মতো গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে শতাধিক চিংড়িঘের, ভেঙে গেছে কয়েক শ কাঁচা ঘরবাড়ি ও দোকানপাট, বাজার।
প্রশ্ন হচ্ছে, উপকূলীয় এলাকা সুরক্ষা দিতে যে নদী-বাঁধ, তা দুর্বল ও নিচু হবে কেন? সাধারণভাবে বাঁধগুলোর উচ্চতা ১৫ ফুট হয়ে থাকে। জোয়ারের উচ্চতা ১২ ফুট হলেও সেই পানি বাঁধ ছাপিয়ে লোকালয়ে আসার কথা নয়।
আর বাঁধ দুর্বল, কাটা-ছেঁড়া হলেই ভেঙে যায়। আরো একটি বিষয় তা হচ্ছে, বাঁধ যখন তৈরি করা হয়েছিল বা এখনো তৈরি করা হয়, নদীর পার থেকে বেশ খানিকটা ভূমি (বাফার জোন) রেখেই তৈরি করা হয়, যাতে নদীর জোয়ারের চাপ সরাসরি বাঁধের ওপর না পড়ে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, বর্তমানে সুন্দরবন উপকূলের বাঁধগুলোর গা ঘেঁষে নদীগুলো বয়ে চলেছে, এর প্রতিক্রিয়ায় নদীভাঙনের সরাসরি আঘাত পড়ছে বাঁধের ওপর। ফলে বাঁধ ভাঙছে। বাঁধ দুর্বল, নিচু হওয়ার প্রধান কারণ, বাঁধ দীর্ঘদিন সংস্কার করা হয় না।
তবে সুন্দরবন উপকূলের বাঁধ দুর্বল হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণটি হচ্ছে মানুষের হস্তক্ষেপ। ১৯৭০-এর দশকে পাউবো সিইপির (কোস্টাল ইমব্যাংকমেন্ট প্রজেক্ট) আওতায় এসব বাঁধ তৈরি করেছিল। এই স্থায়ী মাটির বাঁধ তৈরি হওয়ার এক দশকের মধ্যেই ১৯৮০-র দশকে সেই বাঁধ কেটে ধানক্ষেতে নোনা পানি তুলে ধনী, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী মানুষ প্রশাসনের সহায়তায় বাগদা চিংড়ির চাষ শুরু করে। এতে বাঁধগুলো একেবারে ঝাঁঝরা হয়ে যায়।
২০০৭ সালের ১৪ মে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় সিডরে কয়রা উপজেলার কাঁকশিয়ালী নদীর পানি ফুঁসে ওঠায় নয়ানি গ্রামের বাঁধে ভয়াবহ ভাঙন দেখা দেয়। এতে নয়ানি, মহেশ্বরীপুর, সাতানি, গিলাবাড়ী, আমতলা ও সাতহালিয়া গ্রাম সম্পূর্ণভাবে তলিয়ে যায়। শুধু নয়ানি নয়, কয়রার আংটিহারা, শাকবাড়িয়া, জোড় শিং, গাতির ঘেরী, কাটকাটা, গড়িয়াবাড়ী, চাকলা, কুড়িকাহনিয়া, মদিনাবাদ প্রভৃতি এলাকা ভাঙছে। এসব এলাকায় চিংড়ি চাষের জন্য ব্যাপকভাবে বাঁধ কাটার ঘটনা ঘটেছে। কয়রা উপজেলায় মোট ১২০ কিলোমিটার বাঁধে শুরুতে পাউবোর স্লুইস গেট ছিল ১৭টি।
২০০৭ সালে দেখা যায়, চিংড়ি চাষের জন্য এই বাঁধ এলাকায় আরো ৫০টি গেট নতুন করে তৈরি এবং বাঁধ কেটে ৩৮৬ জায়গায় পাইপ বসিয়ে নদী থেকে নোনা পানি টেনে তোলা হচ্ছে। এ ছাড়া মোটা পাইপ দিয়ে নদী থেকে বাঁধের ওপর দিয়ে পানি টেনে তোলা হয়, যাকে সাইফেন বলা হয়, তা কয়রায় ছিল ৮৫টি। পাইপ বসানোর জন্য বাঁধের কাটা স্থানগুলো খুবই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়ায় ভাঙন তীব্রতর হয়।
পাউবো কর্মকর্তারা বলেন, বাঁধ কাটা অন্যায়। এ কারণে তাঁরা মাঝেমধ্যে মামলাও করেন। কিন্তু চিংড়ি চাষিরা প্রভাবশালী হওয়ায় মামলা বেশিদূর এগোয় না। অবশ্য ইমব্যাংকমেন্ট অ্যান্ড ড্রেনেজ অ্যাক্ট ১৯৫২ তথা ১৯৫৩ সালের ১ নম্বর আইনের ৫৭ ধারায় বাঁধ কাটার দায়ে অপরাধী সর্বোচ্চ এক মাস বা ২০০ টাকা জরিমানায় দণ্ডিত হবেন। উপরন্তু বাঁধ কাটার দায়ে ঘের মালিকের বিরুদ্ধে সাধারণ কোনো মানুষ সাক্ষ্য দেয় না। শুধু কয়রা উপজেলা নয়, নদীভাঙনের এই ভয়াল দশা সুন্দরবন উপকূলের দাকোপ, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা, আশাশুনি, শ্যামনগর, মোংলা, শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ প্রভৃতি উপজেলায়। এখানকার কাঁকশিয়ালী, কপোতাক্ষ, শিবসা, ভদ্রা, চুনকুড়ি, কাজীবাছা, ঢাকি, পশুর নদে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে, যা ঘূর্ণিঝড়ের সময় আরো তীব্রতর হয়।
মনে রাখতে হবে, বাঁধ কেটে পানি প্রবেশ করানোর ফলে বাঁধের বাইরে নদীসংলগ্ন ভূমি কেটে খাল তৈরি করতে হয়। এতে নদীভাঙনের তীব্রতা বাড়ে, যাতে বাঁধের পারেই নদী এসে হাজির হয়। রিমালের আঘাতে দাকোপের বটবুনিয়া বাজারটি যেখানে ভেঙেছে, সেখানকার ঢাকি নদীটি বাঁধ-রাস্তার পাশ ঘেঁষে প্রবাহিত হচ্ছিল। এই ঢাকি নদীর দক্ষিণ পারে, বটবুনিয়ার বিপরীত পারে জালিয়াখালীতে ২০০৯ সালের ২৫ মে আইলার আঘাতে ভাঙন দেখা দেয়, যার প্রতিক্রিয়ায় ছোট জালিয়াখালী গ্রামটি পুরোপুরি ঢাকির পেটে চলে যায়। দেড় শতাধিক পরিবার তাদের ভিটামাটি হারায়। এখনো ২২টি পরিবার রাস্তায় বসবাস করছে। ওই ভাঙনেরও উৎস ছিল চিংড়ি চাষের জন্য নোনা পানি টেনে নেওয়ার জন্য তৈরি খাল। সুন্দরবন উপকূলের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাটের বেশির ভাগ চিত্রই তাই।
সাধারণভাবে অর্ধশত বছর বয়সী বাঁধ দুর্বল ও নিচু হওয়ার কথা; এই বাঁধ তৈরির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল নোনা পানির হাত থেকে এলাকা রক্ষা করা এবং জলোচ্ছ্বাস ঠেকানো, কিন্তু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যক্তি যথেচ্ছভাবে বাঁধের যে ক্ষতি করল, তার দায়দায়িত্ব কে নেবে? আনুষ্ঠানিকভাবে বাঁধের মালিক পাউবো। রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও তার। সংস্কার না হওয়ার দায় তাদের, কিন্তু মানুষের লোভ যেখানে প্রকৃতিকে রুষ্ট করল, সেটি কি মোটেই বিবেচ্য নয়!
লেখক : সাংবাদিক
জোয়ারের পানিতে ভেসে গেছে নিঝুম দ্বীপের সেতু, যাতায়াতে ভোগান্তি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।