ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
সর্বশক্তিমান আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আজ আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এই সংবাদ কেবল একটি রাজনৈতিক দলের জন্য নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশের জন্য এক গভীর শোক, এক ঐতিহাসিক স্তব্ধতা। একটি যুগ আজ নিঃশব্দে অবসান নিল। যিনি ছিলেন সংগ্রামের প্রতীক, আপোষহীনতার নামান্তর, গণতন্ত্রের এক জীবন্ত ভাষ্য-তাঁর বিদায়ে দেশের রাজনীতি, সমাজ ও ইতিহাস আজ শূন্যতায় কাঁপছে।

খালেদা জিয়া—এই নামটি কারও কাছে দেশনেত্রী, কারও কাছে আপসহীন নেত্রী, কারও কাছে গণতন্ত্রের মা, আবার কারও কাছে বাংলাদেশের মা। মতাদর্শগত বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে এই সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় তিনি ছিলেন এক অনিবার্য অধ্যায়। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় জড়িয়ে আছে রাষ্ট্রের টানাপোড়েন, স্বৈরতন্ত্রবিরোধী সংগ্রাম, ক্ষমতা ও কারাবরণের দ্বন্দ্ব, এবং শেষ পর্যন্ত এক অবিচল মানবিক দৃঢ়তার গল্পে।
বাংলাদেশের মানুষের কাছে গণতন্ত্রের মা এবং তার পরিবারের কাছে-খালেদা জিয়া প্রথমত একজন মমতাময়ী মা। একজন এমন নারী, যিনি নিজের ব্যক্তিগত সুখ, নিরাপত্তা ও স্বস্তিকে বিসর্জন দিয়ে সারাজীবন উৎসর্গ করেছেন দেশ ও মানুষের কল্যাণে। তাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ের আড়ালে যে এক অদম্য মাতৃত্ব, এক নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ, এক নীরব সহমর্মিতা লুকিয়ে ছিল-তা কেবল তার পরিবারই নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতিও উপলব্ধি করেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে খালেদা জিয়ার আবির্ভাব কোনো পূর্বপরিকল্পিত ক্ষমতার উত্তরাধিকার ছিল না; ছিল এক কঠিন বাস্তবতার প্রতিক্রিয়া। স্বামী শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যার পর তিনি যে পথ বেছে নিয়েছিলেন, তা ছিল কণ্টকাকীর্ণ, অনিশ্চিত এবং বিপজ্জনক। তবুও তিনি পিছু হটেননি। এক পুরুষতান্ত্রিক, সামরিকীকৃত রাজনৈতিক কাঠামোর ভেতর দাঁড়িয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন গণতান্ত্রিক প্রতিরোধের মুখ।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান, সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, বহুবার নির্বাচনী লড়াই-সবখানেই খালেদা জিয়া ছিলেন দৃশ্যমান ও প্রভাবশালী। তিনি ক্ষমতায় ছিলেন, আবার ক্ষমতার বাইরে থেকেও রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। ক্ষমতা তার পরিচয় নয়; বরং সংগ্রামই ছিল তার প্রকৃত পরিচয়।
কিন্তু এই সংগ্রামের মূল্য তাকে দিতে হয়েছে নির্মমভাবে। তিনি বারবার গ্রেফতার হয়েছেন, বছরের পর বছর কারাবন্দি থেকেছেন। গুরুতর অসুস্থতার মাঝেও তাকে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। নিঃসঙ্গতা, অনিশ্চয়তা ও অবমাননার ভার তিনি বহন করেছেন নীরবে, দৃঢ়তায়। প্রতিহিংসার রাজনীতির শিকার হয়ে তিনি রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতার সর্বোচ্চ রূপ প্রত্যক্ষ করেছেন। তবুও তিনি ভেঙে পড়েননি। কোনো প্রতিশোধের ভাষা উচ্চারণ না করে তিনি বিশ্বাস রেখেছিলেন গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মানুষের বিবেকের ওপর।
খালেদা জিয়া শুধু একজন রাজনীতিক নন; তিনি ছিলেন একজন পরিবারের অভিভাবক। একজন মা, যিনি সন্তানদের বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা ভয়, ক্ষত ও শূন্যতাকে আগলে রেখেছেন। দেশের জন্য তিনি হারিয়েছেন স্বামী, হারিয়েছেন সন্তান। এই ক্ষতি কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষণে পরিমাপ করা যায় না। এই ত্যাগ কেবল ইতিহাস জানে, আর জানে একজন মায়ের নিঃশব্দ কান্না।
এই দেশই হয়ে উঠেছিল তার পরিবার। এই দেশের মানুষই ছিল তার সন্তান। তাই যখন তাকে অপমানিত করা হয়েছে, নিপীড়িত করা হয়েছে-তখন তিনি ব্যক্তিগত নয়, রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রশ্ন তুলেছেন। তার নীরবতা ছিল প্রতিবাদের ভাষা, তার সহনশীলতা ছিল শক্তির প্রকাশ।
আজ তার মৃত্যু আমাদের সামনে এক কঠিন প্রশ্ন রেখে যায়-আমরা কি তার সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিতে পেরেছি? আমরা কি ভিন্নমতকে সহ্য করতে শিখেছি? আমরা কি বুঝেছি, গণতন্ত্র মানে কেবল নির্বাচন নয়, বরং মানবিকতা, সহনশীলতা ও ন্যায়বিচার?
খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের মূল্যায়নে মতভেদ থাকতেই পারে। ইতিহাস নিরপেক্ষভাবে সেই হিসাব করবে। কিন্তু তার ত্যাগ, সাহস ও দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তিনি এমন এক সময় রাজনীতি করেছেন, যখন রাজনীতি ছিল জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন। সেই সময় তিনি আপোষ করেননি-না স্বৈরাচারের সঙ্গে, না অন্যায়ের সঙ্গে।
আজ রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতির সব বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে এই সত্য স্বীকার করার সময়-আমরা একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বকে হারালাম। একজন নারী নেত্রী, যিনি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে সাহসের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। একজন মা, যিনি কষ্টকে শক্তিতে রূপান্তর করেছিলেন। একজন নেত্রী, যিনি শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত গণতন্ত্রে বিশ্বাস রেখেছিলেন।
খালেদা জিয়াকে শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকায় আসছেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি
আপনারা সবাই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের মায়ের জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করেন। দেশবাসীর আবেগ, ভালোবাসা ও বৈশ্বিক শ্রদ্ধায় তার পরিবাবর চিরকাল চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। ইতিহাস একদিন শান্তভাবে বিচার করবে; কিন্তু আজ এই মুহূর্তে কেবল এটুকুই বলা যায়-খালেদা জিয়া ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আত্মার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে।
একটি যুগের অবসান হলো। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের-আলো নিভে যায় না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।


