বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : বিগত কয়েক বছর ধরেই মানুষের মাথা প্রতিস্থাপনের জোর গবেষণা চলছে। বছর দুই আগে ইতালীয় এক নিউরোসার্জন দাবিও করছিলেন তার নেতৃত্বে চিকিৎসক দল প্রথমবার সফলভাবে মানুষের মাথা প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য নিঃসন্দেহে তা চাঞ্চল্যকর। কিন্তু, জীবিত মানুষের মাথা প্রতিস্থাপন করেননি ইতালীয় নিউরোসার্জন সের্গিও কানাভেরো। চীনের গবেষণাগারে দুটি মৃত মানুষের মাথা প্রতিস্থাপন করেছিল ওই চিকিৎসক দলটি। আদৌ জীবিত মানুষের মাথা প্রতিস্থাপন সম্ভব কি না, তা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের একটা বড় অংশই মনে করেন, এটা বাস্তবে সম্ভব নয়। কিন্তু, আর এক নিউরোসার্জন ব্রুস ম্যাথুও দাবি করলেন, মাথা প্রতিস্থাপন অসম্ভব নয়।
ম্যাথু এনএইচএস ট্রাস্ট চালিত ‘হাল ইউনিভার্সিটি টিচিং হাসপাতাল’-এর প্রাক্তন নিউরোসার্জন। ব্রুস ম্যাথু আশাবাদী, সামনের ১০ বছরের মধ্যেই দুই ভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে মাথা প্রতিস্থাপন সম্ভব হতে পারে। তবে, এখন যেভাবে স্পাইনাল কর্ড থেকে মাথা বিচ্ছিন্ন করে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা চলছে, তা সম্ভবপর নয় বলেই মনে করেন এনএইচএসের এই চিকিৎসক। তার মতে, স্পাইনাল কর্ডসহ মাথা প্রতিস্থাপন করতে হবে। তিনি আশাবাদী, অত্যাধুনিক স্টেমসেল প্রতিস্থাপন, রোবোটিক ও স্নায়ু সার্জারির সৌজন্যেই এই সাফল্য মিলবে।
ইতালীয় শল্যচিকিৎসক সের্গিও কানাভেরো দীর্ঘ দিন ধরেই দাবি করছিলেন, এক মানুষের শরীরে অন্য মানুষের মাথা প্রতিস্থাপন করা সম্ভব। কিন্তু ইউরোপ বা আমেরিকার কোনও দেশের সরকারই তাকে এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ দিতে চায়নি। নৈতিক কারণেই এমন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে দেওয়া সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেওয়া হয় কানাভেরোকে। ফলে, গবেষণার প্রয়োজনে চীনে গিয়েছিলেন ইতালীয় ওই নিউরোসার্জন। দু-বছর আগে, ২০১৭-য় সাংবাদিক বৈঠক করে গবেষণায় ‘সাফল্য’-র কথাও জানান কানাভেরো। তার দাবি ছিল, চীনের গবেষণাগারে সফলভাবে মানুষের মাথা প্রতিস্থাপিত হয়েছে। এই প্রতিস্থাপনে ১৮ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। সঙ্গী ছিলেন চীনা চিকিৎসক রেন শিওয়াপিং।
অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় ওই সাংবাদিক বৈঠকে কানাভেরো জানিয়েছিলেন, এক মানুষের শরীরে অন্য মানুষের মাথা সফল ভাবে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। একজনের ধড়ে অন্য জনের মুণ্ড বসিয়ে মেরুদণ্ড, স্নায়ু এবং ব্লাড ভেসেলগুলো সফলভাবে জুড়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। তবে এই পরীক্ষামূলক প্রতিস্থাপন জীবিতদের শরীর ব্যবহার করে হয়নি। এর পরে সেই দিকেই তিনি ধাপে ধাপে এগোতে চান বলে কানাভেরো জানিয়েছিলেন।
কোনও ব্রেন ডেথ হওয়া ব্যক্তির শরীরে অন্য ব্যক্তির মাথা বসিয়ে নিজের সাফল্যের প্রমাণ দিতে মরিয়া ইতালীয় এই নিউরোসার্জন। কানাভেরোর দাবি নিয়ে তখনই সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন বিশেষজ্ঞেরা। কেন তারা এটি অসম্ভব বলে মনে করছেন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই প্রক্রিয়ায় এক শরীর থেকে মাথা আলাদা করে অন্য শরীরে প্রতিস্থাপন করা পর্যন্ত সেটিকে জীবিত রাখতে হবে। জীবিত মানুষের শরীরে তা সম্ভব নয় বলেই তারা মনে করেন।
আমেরিকার নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োএথিকসের শিক্ষক আর্থার ক্যাপলান জানান, ক্যানাভারোর এই কাজ ভণ্ডামি ছাড়া কিছুই নয়। সফলভাবে মানুষের মাথা প্রতিস্থাপন সম্ভব নয় বলেই তিনি মনে করেন। একজন মানুষের থেকে আর একজন মানুষের শুধুমাত্র চেহারাটুকু প্রতিস্থাপন করাটাও প্রচণ্ড কঠিন বলে তিনি মনে করেন। কারণ, অনেক বড় বড় ডোজে ইমিউনোসাপ্রেসেন্ট ব্যবহার করতে হয়, যাতে মানুষের শরীর এই ট্রান্সপ্লান্টকে নষ্ট না করে দেয়। মাথা প্রতিস্থাপন করতে গেলে আরও বড় ডোজ দরকার হবে। যদি তাই করা হয়, তারপরেও কয়েক বছরের মধ্যে রিজেকশন বা ইনফেকশনের মাধ্যমে মারা যাবেন ওই ব্যক্তি।
এটাও হতে পারে যে, মাথা এবং শরীর আলাদা মানুষের হওয়ায়, প্রতিস্থাপনের পর সেই মানুষটি কখনোই আর পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে পাবেন না। ক্যাপলেন কথায়, ‘নতুন সকেটে একটা লাইট বাল্ব ঢুকিয়ে দেওয়ার মতো সহজ কাজ নয় এটি।’ ‘আপনি যদি মাথা ও মস্তিষ্ক সরিয়ে ফেলেন, সে থাকবে নতুন একটা রাসায়নিক পরিবেশে আর নিউরোলজিক্যাল ইনপুটগুলোও নতুন হবে। মৃত্যুর আগে পাগল হয়ে যাবে সেই মানুষটি।’
শুধু তাই নয়, প্রতিস্থাপন সফল করতে হলে, প্রচুর স্নায়ু এবং রক্তনালী জুড়তে হবে। মেরুদণ্ড এবং সুষুম্নাকাণ্ডও জোড়া দিতে হবে। ক্যানাভারোর অবশ্য দাবি, তারা মেরুদণ্ড, স্নায়ু এবং রক্তনালী জোড়া দেওয়ার উপায় বের করেছেন। জীবিত মানুষের ক্ষেত্রে না হোক, বনারের মাথা প্রতিস্থাপনের চেষ্টা দু-দুবার হয়েছে। ২০১৬ সালে ক্যাপলান একটি জীবিত বানরের মাথা প্রতিস্থাপনে অস্ত্রোপচার করেন। তখন বলা হয়েছিল, বানরটির স্নায়ুতন্ত্রের কোনও ক্ষতি হয়নি। কিন্তু, অস্ত্রোপচারের ২০ ঘণ্টা পরেই বানরটি মারা যায়।
ক্যাপলানের আগে হেড ট্রান্সপ্লান্টের অগ্রদূত রবার্ট হোয়াইটও একটি বানরের মাথা প্রতিস্থাপন করেছিলেন। সেটা ১৯৭০ সালে। বানরটি মোটে ন-দিন বেঁচে ছিল। শরীরটি প্রতিস্থাপন করা মাথাকে রিজেক্ট করার কারণেই সে মারা যায়।
সূত্র : টাইমস অফ ইন্ডিয়া, এই সময়
Get the latest News first— Follow us on Zoombangla Google News, Zoombangla X(Twitter) , Zoombangla Facebook, Zoombangla Telegram and subscribe to our Zoombangla Youtube Channel.