জুমবাংলা ডেস্ক: বীর মুক্তিযোদ্ধা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় ঔষধ নীতির রূপকার ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কর্মময় জীবনের অবসান ঘটেছে। মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) রাতে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের লাইফ সাপোর্টে থাকা অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
দীর্ঘদিন কিডনিরোগসহ বিবিধ স্বাস্থ্যগত জটিলতায় ভুগছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মুত্যুকালে তিনি রেখে গেছেন তার সহধর্মিনী নারীনেত্রী শিরীন হক এবং দুই পুত্রকন্যাকে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের এক দিশারী মানুষ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। জনস্বার্থ কেন্দ্রে রেখে জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে তার উদ্যোগ, সমাজভিত্তিক জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির রূপরেখা হাজির করা তার দেশপ্রেমিক অবদানের একেকটি মাইলফলক।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর আবির্ভাব ছিল নাটকীয় ও বীরত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালে বিলেতের অভিজাত প্রতিষ্ঠান থেকে সার্জন হওয়ার সুযোগ ছিঁড়ে ফেলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। পাকিস্তানি পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সেই ঘটনা দেশে-বিদেশে স্মরণীয় হয়ে আছে। সেই তিনিই আবার রণাঙ্গনের একটু পেছনে ত্রিপুরা সীমান্তে প্রতিষ্ঠা করেন মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল। সেটাই প্রথম কোনো হাসপাতালের নামে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটা যুক্ত হলো। সেই যুদ্ধ হাসপাতালই স্বাধীন বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল নামে এখনও সেবা দিয়ে যাচ্ছে। শুধু নিজেকেই দেশের সেবায় নিয়োজিত করেননি, উদ্বুদ্ধ করেছেন আরও এক গুচ্ছ মানুষকে। আজকের বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের উজ্জ্বল অনেক মানুষই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রেরণা, তাগাদা এবং দিশা ধরে দেশকে এগিয়ে দিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধের ক্রান্তিকালে জাফরুল্লাহ চৌধুরী নিজেকে আবিষ্কার করেছিলেন দেশের একনিষ্ঠ সেবক হিসেবে। সেই তিনিই আবার স্বাধীন দেশে হয়ে উঠলেন স্বাস্থ্যসেবা, নারীপ্রগতি, গ্রামমুখী পেশাদারি বিকাশের নায়ক।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী আশির দশকে নামলেন ঔষধ শিল্পে নয়ছয় ঠেকাতে জাতীয় ঔষধনীতি প্রণয়ন করতে। অনেক হামলা ও বাধা ডিঙিয়ে তা পাস করালেন। জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিও সরকারকে নিয়ে করিয়ে নিয়েছিলেন, কিন্তু সেটা আর বাস্তবায়িত হয়নি। তবে ঔষধনীতির কল্যাণে ওষুধের দাম গরিবের নাগালে এসেছিল। ঔষধ শিল্প দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধকালে তাঁর প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও প্যারামেডিকের ধারণা পরে বিশ্বায়িত হয়। ঔষধ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি শুধু লড়াই-ই করেননি; অসাধারণ একটা বই লিখেছেন: দি পলিটিকস অব এসেনসিয়াল ড্রাগস। জনস্বাস্থ্য যে গণরাজনীতির কেন্দ্রে থাকা উচিত- সেই প্রশ্নটা তিনি শেখালেন। জীবনের সায়াহ্নকালে এসে, বাংলাদেশসহ বিশ্বই যখন কভিড-১৯ অতিমারির ভয়াল থাবার নিচে, সে সময় তিনি আবার দাঁড়ালেন করোনাভাইরাস পরীক্ষা, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের গবেষণা কাজে। তার এই দায়িত্বশীল উত্থান বহু মানুষকে আশা দিয়েছে, অভয় দিয়েছে। যেমন দেশের কিডনি রোগীদের এক বড় ভরসাস্থল হয়ে আছে তার প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম ডায়ালাইসিস সেন্টার। তার প্রতিষ্ঠিত গণবিশ্ববিদ্যালয় অনেক নিপীড়িত, অভাবী ও প্রান্তিক শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষার ভরসা হয়ে আছে।
ডা. জাফরুল্লাহ বৈশ্বিক স্তরে স্বাস্থ্যসেবার ধারণায় পরিবর্তন এনেছেন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ধারণা তিনিই প্রথম সামনে আনেন। ডাক্তারিশাস্ত্রে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও সাধারণের পক্ষে প্যারামেডিক হওয়ার পথ দেখিয়ে তিনি স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়েছেন। তার এই দুটি ধারণা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘসহ অনেক উন্নত ও উন্নতশীল দেশ নিয়েছে। এই দিক থেকে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অবদান শুধু সর্বজনীনই নয়, বিশ্বজনীনও বটে।
জাফরুল্লাহ চৌধুরী সারাজীবন দেশ ও মানুষের জন্যই নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন। তার নিজের এক শতক জমি ও এক তোলা সম্পত্তিও নেই বলে জানান লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেন, যতদূর জানি, তার কোনো ব্যক্তিগত সম্পদ নেই। আমাদের কাছে তিনি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।
জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জন্ম ২৭ ডিসেম্বর ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায়। তার বাবার শিক্ষক ছিলেন বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেন। পিতামাতার ১০ সন্তানের মধ্যে তিনি সবার বড়। ঢাকার বকশীবাজারের নবকুমার স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন এবং ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট উত্তীর্ণের পর তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস এবং ১৯৬৭ সালে বিলেতের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে এফআরসিএস প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।