যুবায়ের আহমেদ, ডয়চে ভেলে: এই বেলায় প্রয়াত ফাহিম মুনয়েম-এর কথা মনে পড়ছে৷ তিনি মাছরাঙা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী ছিলেন৷ একসময় ছিলেন দি ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক৷ তাঁর অফিসে একটা ছোট্ট ‘ডেস্কপিস’ ছিল৷ সেখানে লেখা ছিল, ‘অ্যাটিটিউড ইজ এভরিথিং৷’ যখনই ওনার সঙ্গে কথা বলতে যেতাম, ওটা আমার চোখে পড়ত৷ তিনি মজার মানুষ ছিলেন৷ প্রায়ই ইংরেজিতে নানান ‘ইডিয়ম’ ব্যবহার করতেন, যেগুলো নিয়ে আমরাও অনেক মজা করতাম৷ যেমন, বলতেন ‘ডোন্ট পুট অ্যাস বিটউইন ইউ অ্যান্ড মি’, ‘অ্যাজ্যুম’ (Assume) কোরো না৷’’ সে যাই হোক, তিনি এই ‘অ্যাটিটিউড’ ব্যাপারটিকে অনেক গুরুত্ব দিতেন এবং আমাকে একবার বলেছিলেন, ‘‘এটা সবসময় ধরে রাখবে৷’’
অনূর্ধ্ব ১৯ দলটিকে অনেকের মতোই আমার ভালো লেগেছে৷ তাদের দক্ষতা যেমন আছে, আছে বিশ্বসেরা হবার শরীরী ভাষা৷ এটা একটা বড় উন্নতি৷ একটা সময় বড় বড় ক্রিকেটাররা পিঠ চাপড়ে দিলেই খুশি থাকতাম আমরা৷ হয়তো সুনীল গাভাস্কার বলছেন, আজ একটি চমৎকার ‘কাভার ড্রাইভ’ করেছ৷ সেটাই হয়ে উঠত বড় পাওনা৷ এরপর এল ‘সম্মানজনক পরাজয়’-এর যুগ৷ বাংলাদেশ অধিকাংশ ম্যাচ হারছে৷ কিন্তু আমরা খুশি হচ্ছি, বড় ব্যবধানে পরাজিত হইনি৷ হুটহাট এক আধটি জয়েই রং খেলা আর মিছিলের বন্যায় ভাসত রাজপথ৷ এরপর শুরু হলো নিয়মিত ব্যবধানে কিংবা ধারাবাহিক জয়ের পালা৷ বিশ্বকাপ না হোক, এশিয়া কাপ জিততে জিততেও হাতছাড়া হলো৷ বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী দল হিসেবে মোটামুটি প্রতিষ্ঠা পেল৷ সবশেষ অনূর্ধ্ব ১৯ দল বিশ্বসেরা হয়ে একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে বলে মনে করি আমি৷ কেন নতুন দিগন্ত বলছি সেটা পরিষ্কার করা প্রয়োজন৷
খুব বিখ্যাত একটা চীনা উক্তি আছে- ‘‘খুব জোরে বাতাস আসলে বেশিরভাগ মানুষ দেয়াল তৈরি করেন৷ কিন্তু কিছু মানুষ তৈরি করেন বাতাসের কল বা ‘উইন্ডমিল’৷” অর্থাৎ কোনো একটা ঘটনা, নতুন বা পুরোনো, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ‘অ্যাপ্রোচ’- মানে কেমন করে তাকে দেখা হচ্ছে৷ সেই দৃষ্টিভঙ্গি সময়ের সঙ্গে সঙ্গেও বদলায়, কারণ সময় মানুষকে আরো অভিজ্ঞ করে তোলে৷ শুধু পিঠ চাপড়ে দিয়েই যেই বাংলাদেশিদের আগে প্রবোধ দেয়া হতো, আজ তারা বিশ্বসেরা হয়ে উঠতে পারছে৷ এর কারণ, তাদের কঠোর পরিশ্রম, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ কিন্তু তারচেয়েও বড় তাদের ‘অ্যাপ্রোচ’৷ যেই ‘অ্যাটিটউড’ নিয়ে এত কথা, তা না থাকলে এরা বিশ্বজয় করতে পারতেন বলে আমি মনে করি না৷ তবে তা খেলার ভেতরেই সীমাবদ্ধ রাখলেই ভালো৷
তবে এও ঠিক যে, শুধু ভাবভঙ্গি দেখালে হবে না, পরিশ্রম ও নিষ্ঠা চাই৷ কিন্তু আমি বলছি মাঠের ভেতরে আগ্রাসী না হলে যুদ্ধ জয় করা যায় না৷ প্রতিপক্ষের মনোবল ভেঙ্গে দেয়াও যুদ্ধকৌশলের অংশ৷ শরীফুল-রাকিবুলদের মধ্যে সেই শরীরী ভাষা ছিল এবং তা তারা কাজেও লাগাতে পেরেছেন৷ তাই এই যে ‘ভাষাশিক্ষা’, এই যে ‘অ্যাটিটিউড’, এটা নিজেদের সেরা ভাবতে শেখার অংশ৷ একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, বিশ্বসেরার লড়াইয়ের ময়দান পর্যন্ত যারা পৌঁছান তাদের সবারই সেরা হবার যোগ্যতা আছে৷ সেই যোগ্যতার ওপর আস্থা কে কতটা রাখতে পারছে এবং খেলার মাঠে প্রতিপক্ষকে দেখে ভড়কে যাচ্ছে না, সেটা নিশ্চিত করতে পারলেই জয় আসে৷ আগের দিনে বড় বড় অস্ত্র নিয়ে যখন যুদ্ধের ময়দানে যেত, তখন প্রতিপক্ষের সৈন্য সামন্তরা সেই অস্ত্রের বিশালত্ব দেখে ভয় পেত৷ ক্রিকেটে সেই বড় অস্ত্রগুলোর নাম শচীন, লারা, গেইল, ডি ভিলিয়ার্স, কোহলি, স্মিথ, উইলিয়ামসন -এরা৷ কিন্তু ২২ গজের উইকেটে এদের নিয়মিত চোখ রাঙিয়ে দিতে পারাটা অভ্যাসে পরিণত করা গেলে জয়টাও অভ্যাসে পরিণত হতে পারে৷
এখন আসি, যাদের নিয়ে এত প্রশংসা, কেন আমি এই তরুণদের মূল দলে নেবার বিপক্ষে৷ আসলে বিপক্ষে নই, বরং তাদের জন্য দলে ঢোকাটা যেন সহজ না হয়, সেজন্যই এত কথা৷ কারণ, প্রায়ই একটা বিষয় নিয়ে আমরা আলাপ করি যে, আমাদের ক্রিকেটারদের ক্যারিয়ার কেন তাদের প্রতিভার মতো লম্বা হয় না৷ তার অনেক কারণ আছে৷ এর মধ্যে একটা হয়তো ‘ভিশন’৷
জাতীয় দলে সুযোগ পেয়ে কোনোমতে জায়গা পাকাপোক্ত করে রাখাটাই যদি ভিশন হয়, তাহলে আমরা সুফল পাবো না৷ কিন্তু এই ১৯ বছর বয়সীদের ভেতর ভিন্ন কিছু দেখতে পেয়েছি বলেই এত কথা৷ তারা কঠোর পরিশ্রম করেছে শিরোপার জন্য৷ তারা কঠোর পরিশ্রম করছে, বড় কিছু করার জন্য৷ বড় কিছু করেছেও৷ আমাদের সেরা তারকা সাকিব আল হাসানকেই ধরুন৷ বিশ্বকাপের আগে কী কঠোর পরিশ্রমটাই না তিনি করেছেন৷ তার ফলও পেয়েছেন৷ সাকিব এত কঠোর পরিশ্রম না করলেও, তিনি অন্য খেলোয়াড়দের চেয়ে ভালোই করতেন বলে আমি মনে করি৷ কিন্তু তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছেন৷ চেয়েছেন অন্য দলগুলোর সেরা খেলোয়াড়দের ছাড়িয়ে যেতে৷ এমন বড় কিছু করার তাগিদ সবার থাকবে, এমনটি ভাবার কারণ নেই৷ সাকিবের মতো ভাবেন আর কেউ আছেন এখন বাংলাদেশ দলে? আমি আশা করব, আছেন৷
ভয় হলো, ঊনিশ দলের খেলোয়াড়রা যদি সহজে মূল দলে জায়গা পেয়ে যান, তাহলে তাদের পরিণতি হতে পারে সৌম্য-ইমরুল-সাব্বিরদের মতো৷ নির্বাচকের দৃষ্টি দিয়ে দেখলে শরীফুল, রাকিবুল, হৃদয়, তানজিদ ও শাহাদাতের ভবিষ্যত আমি এখনই দেখতে পাচ্ছি৷ তাদের কারো কারো স্থানীয় লিগ ও অনুর্ধ ১৯ বিশ্বকাপ- দুই জায়গাতেই পারফরম্যান্স ভালো৷
তবে তাদের জন্য দলে ঢোকা আরো কঠিন করতে হবে৷ তাদের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিয়মিত পারফর্ম করতে হবে৷ একজন ‘ম্যাচ্যুরড’ ক্রিকেটার হিসেবে দলে ঢুকতে হবে৷ মিরাজ-সাইফুলদের কথাই ধরুন৷ তারা জাতীয় দলে আছেন৷ মোটামুটি পারফর্ম করে যাচ্ছেন৷ দু’জনই অনুর্ধ ১৯ দল থেকে আসা৷ প্রতিভাবান বলেই খুব বেশি কষ্ট করতে হয়নি৷ কিন্তু আমি মনে করি, তাদের কাছ থেকে সেরাটা পাচ্ছি না আমরা৷
অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট দলে এখনো ৩১ বছর বয়সে অভিষেক হয়৷ আমাদের জাতীয় দলের পুল এত বড় হয়ে গেছে যে নির্বাচকদের দল বাছাই করতে রীতিমত হিমসিম খেতে হয়৷ আজকের ক্রিকেটে লম্বা সময় ধরে একজন পারফর্ম করেই যাবেন, সেটা ভাবার কারণ নেই৷ সামনে ক্রিকেটারদের জাতীয় দলে খেলার বয়স সবমিলিয়ে ১০ থেকে ১৫ বছরের বেশি হবে না৷ এর মধ্যে ৫ বছর হয়তো তিনি ফর্মের তুঙ্গে থাকবেন৷ তাই সেই সেরা ফর্মটুকু যেন জাতীয় দল ব্যবহার করতে পারে, সেভাবে দল গোছাতে হবে৷ কিছু প্রেসক্রিপশন এরই মধ্যে খেলোয়াড়রা দিয়েছেন সাকিবের নেতৃত্বে৷ সেগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলাপ হয়েছে আগে৷ তাই এখানে তার ব্যাখ্যার প্রয়োজন নেই৷ স্থানীয় ক্রিকেটকে বিশ্বসেরা মানের নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে৷ আর এভাবেই চ্যাম্পিয়নসুলভ শরীরী ভাষার যে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে, তার সঠিক ব্যবহার করা যাবে৷
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।