জুমবাংলা ডেস্ক : গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় (৭৬ কেজি ওজনের বোমা মামলা হিসেবে পরিচিত) ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড, একজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও একজনের ১৪ বছরের কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। আর নিম্ন আদালতে ১৪ বছরের কারাদণ্ডপ্রাপ্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সরোয়ার হোসেন মিয়াকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. বদরুজ্জামানের হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার এ রায় দেন। এ মামলায় ফাঁসির রায় অনুমোদনের জন্য নিম্ন আদালত থেকে পাঠানো ডেথ রেফারেন্স ও কারাবন্দি আসামিদের করা আপিল আবেদনের ওপর শুনানি শেষে এ রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
আদালত বলেছেন, দুটি বোমার মধ্যে একটিও যদি বিস্ফোরিত হতো তাহলে এক কিলোমিটার এলাকাব্যাপী ধ্বংসলীলায় পরিণত হতো। রায়ে বলা হয়, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এই আসামিরা এমন একটি ভয়ংকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল যা পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়িত হলে তাদের ষড়যন্ত্র সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এদেশে আরেকটি ভয়ংকর অবস্থার সৃষ্টি হতো। সুতরাং বিচারিক আদালত তাদের দোষী সাব্যস্ত করে যে সর্বোচ্চ শাস্তি দিয়েছে তা যথার্থ ও আইনসম্মত।
আদালত বাংলায় রায় দেন। আদালত আগেই ঘোষনা দিয়েছিলেন যে, ভাষার মাসের সম্মানে বাংলায় রায় দেওয়া হবে। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ড. মো. বশির উল্লাহ। আসামিপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট এস এম শাহজাহান, মোহাম্মদ আহসান, মো. নাসির উদ্দিন ও অমূল্য কুমার সরকার (স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী)।
রায়ের পর্যবেক্ষণ
রায়ে দেওয়া পর্যবেক্ষনে বলা হয়, ১৯৭৫ সালে ১৫ আগষ্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের হত্যার মধ্য দিয়ে এদেশ যতটুকু পিছিয়ে যায়, ঠিক আবারও একটি ঘটনার অবতারণা শুরু হয়েছিল এ ঘটনার (কোটালিপাড়ায় বোমা পুতে রাখা) মধ্য দিয়ে। রায়ে বলা হয়, এই দেশটি দূর্ভাগা এই কারনে যে, যেখানে জাতির জনককে স্বপরিবারে বিনা দোষে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল ঘাতকের দল। দুনিয়ার কোন সভ্য দেশে এমনিভাবে জাতির জনককে স্বপরিবারে হত্যা বিরল। কাজেই এ মামলায় সংঘটিত ঘটনাকে কোনভাবেই হালকা করে দেখার কোন অবকাশ নেই।
রায়ে বলা হয়, আসামিরা ঢাকাস্থ মোহাম্মদপুর ও মুগদাপাড়া অফিসে মিটিং করেছিল। মিটিং এ তারা মতামত প্রকাশ করে বলেন যে, ‘‘আওয়ামী লীগ সরকার ইসলাম বিদ্বেষী এবং ভারতের দালাল হিসেবে ইসলাম ধ্বংসের কাজে লিপ্ত।’’ সুতরাং তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সরকারকে উৎখাত করতে হবে হত্যার মধ্য দিয়ে। কিন্তু কি ধরনের ইসলাম বিরোধী কার্যক্রম তৎকালীন সরকার করেছিল বা ভারতে সঙ্গে কি ধরনের আতাত করেছিল-এ রূপ কোনো বক্তব্য দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি কেউ উল্লেখ করেনি।
রায়ের পর্যবেক্ষনে বলা হয়, ষড়যন্ত্রকারিদের মধ্যে কেউ কেউ আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে যেয়েও বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়েছে। এ ধরনের জঙ্গি তৎপরতার আড়ালে যাদের বিচরণ ছিল তাদের সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার তদন্তকারি কর্মকর্তাগণকে তদন্তের আরও গভীরে যাওয়া উচিত ছিল। তাদের তদন্ত কাজে আরও অধিকতর মনোযোগী হওয়া উচিত ছিল।
আদালত বলেন, আসামিরা ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণা নিয়ে তৎকালীন সরকারকে দোষারূপ করেছিল। অথচ ইসলামের মূল্যবোধ, হযরত মুহাম্মদ (স) আদর্শিক দিকগুলো এদেশের মুসলিম বাঙ্গালীদের মধ্যে প্রতিষ্ঠার লাভের জন্য এবং আগত জেনারেশনকে উদ্বুব্ধ করার জন্য বিভিন্ন ইসলামী প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শুধু তাই নয়, অন্যান্য ধর্মাম্বলির ব্যাপারেও তিনি সজাগ ছিলেন। আসামিরা যাদেরকে ইসলাম বিদ্ধেষী বলে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল তারা বরং ইসলাম প্রতিষ্ঠার কাজে লিপ্ত। ইসলামের মূল্যবোধ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা ও কর্মে পুরো দেশ ও সমাজ অশান্তিতে বিরাজমান ছিল। আসামিদের এ ধরনের ধ্যান ধারণা ইসলাম কোনভাবেই সমর্থন করে না। কারণ ইসলাম শান্তির ধর্ম।
যাদের মৃত্যুদণ্ড বহাল
যাদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে তারা হলেন- ওয়াসিম আখতার ওরফে তারেক হোসেন ওরফে মারফত আলী, মো. রাশেদ ড্রাইভার ওরফে আবুল কালাম ওরফে শিমন খান, মো. ইউসুফ ওরফে আবু মুসা হারুন ওরফে মোসাহাব মোড়ল, শেখ ফরিদ ওরফে মাওলানা শওকত ওসমান, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বক্কর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই এবং মাওলানা আবদুর রউফ ওরফে আব্দুর রাজ্জাক ওরফে আবু ওমর। এদের প্রত্যেককেই নিম্ন আদালত মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল।
এছাড়া মেহেদি হাসান ওরফে গাজী খান ওরফে আবদুল ওয়াদুদকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং আনিসুল ওরফে আনিস ও মো. মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমানকে দেওয়া ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। তবে কারাবন্দী এই দুইজনের সাজাভোগ করা হয়ে গেলে তাদের কারাগার থেকে মুক্তি দিতে বলা হয়েছে। আর নিম্ন আদালতে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সরোয়ার হোসেন মিয়াকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
এরআগে ২০১৮ সালের ২ এপ্রিল বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চে একইবছরের শুনানি শুরু হয়। কিন্তু প্রধান বিচারপতি বেঞ্চটি পুনর্গঠন করায় মামলার শুনানি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে গতবছর ১৭ জানুয়ারি বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. রিয়াজ উদ্দিন
খানের হাইকোর্ট বেঞ্চে নতুন করে শুনানি শুরু হয়। এই আদালতে মামলাটি বিচারাধীন থাকাবস্থায় রাষ্ট্রপক্ষ কয়েকদফা সময় নেয়। পরবর্তীতে এই বেঞ্চও পুনর্গঠন করা হলে শুনানি থমকে যায়। এ অবস্থায় আবারো বেঞ্চ পুনর্গঠন করা হয়। সর্বশেষ গঠিত বেঞ্চে গতবছর ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে নতুন করে শুনানি শুরু হয়। আর গত পহেলা ফেব্রুয়ারি শুনানি সম্পন্ন হয়।
কোটালীপাড়ায় শেখ লুৎফর রহমান মহাবিদ্যালয়ের উত্তর পাশের একটি চায়ের দোকানের পেছন (তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশ স্থলের পাশে) থেকে ২০০০ সালের ২০ জুলাই ৭৬ কেজি ও পরদিন ৮০ কেজি ওজনের বোমা উদ্ধার করা হয়। এই বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল ১৬ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। পরবর্তীতে আরও নয়জনকে আসামি করে ২০০৯ সালের ২৯ জুন সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এরপর ২০১০ সালে মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে পাঠানো হয়। বিচার শেষে ২০১৭ সালের ২০ আগষ্ট রায় দেয় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২। রায়ে ১০ জনকে মৃত্যুদণ্ড, একজনকে যাবজ্জীবন ও তিনজনকে ১৪ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর ওইবছরের ২৪ আগষ্ট হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয়। নথি হাইকোর্টে পৌছার পর প্রধান বিচারপতির নির্দেশে জরুরী ভিত্তিতে পেপারবুক তৈরি করা হয় এবং তা বিচারের জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেন প্রধান বিচারপতি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।