বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক: পৃথিবীর গভীরে হাজার হাজার কিলোমিটার নিচে, যেখানে এখনো মানুষের পা পড়েনি বা সূর্যের আলো পৌঁছায়নি সেখানে আছে এমন পর্বতমালা- যার কিছু শৃঙ্গ এভারেস্টের চাইতে চারগুণ উঁচু। কিন্তু কেউ জানে না কিভাবে এবং কেন এগুলো তৈরি হয়েছিল। বিবিসি বাংলার প্রতিবেদক জারিয়া গোরভেট-এর প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
অ্যান্টার্কটিকায় গ্রীষ্মকালের একটি উজ্জ্বল দিন।
তাপমাত্রা মাইনাস ৬২ সেলসিয়াস, অর্থাৎ শূন্যের ৬২ ডিগ্রি নিচে। সামান্থা হ্যানসেনের চোখের পাতায় বরফ জমে গেছে। তার সামনে বরফের সাদা দেয়াল। কোথাও তা ওপরের দিকে উঠে গেছে, কোথাও ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে, আবার কোথাও দিগন্তরেখা আকাশের সাথে মিলেছে, তা বোঝা যায় না।
সামনে তাকালে তাই একটা যেন মানসিক বিভ্রম তৈরি হয়।
এর মধ্যেই তুষারের ওপর একটা সুবিধামত জায়গা বের করলেন সামান্থা। তারপর হাতে তুলে নিলেন একটা কোদাল।
অ্যান্টার্কটিকার উষর অভ্যন্তরভাগ
সামান্থা হ্যানসেন যেখানে আছেন, তা হচ্ছে এই অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের একেবারে ভেতরের একটি ঊষর অঞ্চল। যেসব বিলাসবহুল জাহাজ অ্যান্টার্কটিকায় পর্যটকদের বেড়াতে নিয়ে যায়, তারা এখানে যায় না।
সেখানের পরিবেশ একেবারেই নির্মম। এমনকি অ্যান্টার্কটিকায় যেসব স্থানীয় বন্যপ্রাণি বাস করে, তারাও ওদিকে খুব কমই যায়।
তো সামান্থা গিয়েছেন কিসের সন্ধানে?
আমেরিকার দুটি বিশ্ববিদ্যালয় আলাবামা ও আরিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির অনুসন্ধানী দলের একজন সামান্থা হ্যানসেন সেখানে গিয়েছেন গোপন কিছু পর্বতমালার সন্ধানে।
আজ পর্যন্ত ওই সব পর্বতমালার চূড়ায় কোনো অভিযাত্রীর পা পড়েনি। এমনকি কোনোদিন সূর্যের আলো পড়ে ঝলমল করে ওঠেনি ওই সব শৃঙ্গ। কারণ, সেগুলো লুকিয়ে আছে পৃথিবীর মাটির নিচে অনেক গভীরে।
পৃথিবীর অভ্যন্তরে কী আছে?
ওই গবেষণা শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালে। অ্যান্টার্কটিকায় গিয়ে এক গবেষক দল একটি সিসমোলজি স্টেশন বসিয়ে ছিল।
সেগুলো এমন কিছু যন্ত্র, যার অর্ধেকটা বরফের মধ্যে পোঁতা এবং বাকি অর্ধেকটা বাইরে। আমাদের পৃথিবীর ভেতরে কী আছে তা বের করাটাই ছিল এর লক্ষ্য।
অ্যান্টার্কটিকার বিভিন্ন স্থানে এমন ১৫টি স্টেশন বসিয়েছিল গবেষকদের দলটি।
সিসমোলজি স্টেশনের যন্ত্র দিয়ে যে পর্বতের মতো কাঠামোগুলোর কথা জানা গেল, তা ছিল বেশ রহস্যময়।
সেগুলোর নাম দেয়া হয়েছে ‘আল্ট্রা লো ভেলোসিটি জোন’ বা ইউএলভিজেড।
কিন্তু হ্যানসেনের দলটি জানতে পারে যে ওই ইউএলভিজেডগুলো সম্ভবত পৃথিবীর সবখানেই আছে। আপনি পৃথিবীর যেখানেই থাকুন না কেন আপনার পায়ের নিচেই হয়ত আছে এগুলো।
হ্যানসেন বলেন, ‘আমরা প্রায় যেখানেই গেছি, সেখানেই ইউএলভিজেড থাকার প্রমাণ পেয়েছি।’
প্রশ্ন হলো ইউএলভিজেড জিনিসটা আসলে কী? আর পৃথিবীর গভীর অভ্যন্তরে এরা কী করছে?
রহস্যময় ইতিহাস
পৃথিবীর ভেতরে যে পর্বতগুলো আছে তাদের অবস্থান একটা গুরুত্বপূর্ণ স্তরে।
আমাদের গ্রহের অভ্যন্তরে একেবারে কেন্দ্রস্থল বা কোর হচ্ছে একটি অতি উত্তপ্ত ধাতব স্তর। তার চারপাশে আছে নরম ও শক্ত পাথুরে স্তর বা ম্যান্টল।
এ দুটি স্তরের পার্থক্য এত বেশি যে তাকে হ্যানসেনের দল বর্ণনা করছেন ‘কঠিন শিলা ও বাতাসের মধ্যে বাহ্যিক বা ভৌত পরিবর্তনের চেয়েও বেশি।’
পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক গঠনের এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা কয়েক দশক ধরেই বিজ্ঞানীদের বিস্ময়ের কারণ হয়ে আছে।
পৃথিবীর উপরিভাগ থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার ভেতরে ‘কোর-ম্যান্টল সীমারেখার’ অবস্থান। কিন্তু যে উপরিভাগে মানুষ বাস করে, তার সাথে তার অভ্যন্তরভাগের অনেক পার্থক্য। অনেক জায়গা এমন যে মনে করা হয় ওগুলো বহু আগে সমুদ্রের তলদেশ ছিল, হয়ত তারই কিছু টুকরো সেখানে চাপা পড়ে আছে।
পৃথিবীর অনেক জায়গায় যে আকস্মিকভাবে আগ্নেয়গিরি তৈরি হয়েছে, তার পেছনে কারণ হয়ত এগুলোই।
‘ডীপ-আর্থ’ পর্বতের কথা কিভাবে জানা গেল?
এগুলো নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয় ১৯৯৬ সাল থেকে। ওই সময় বিজ্ঞানীরা মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরের অনেক নিচে থাকা কোর-ম্যান্টল বাউন্ডারি নিয়ে গবেষণা করছিলেন।
ওই গবেষণা করা হচ্ছিল সিসমিক ওয়েভ বা ভূমিকম্পের মতো ঘটনার সময় পৃথিবীর ভেতরের স্তরগুলোর ভেতর দিয়ে যে কম্পনের তরঙ্গ বয়ে যায় এবং এতে যে ঝাঁকুনি লাগে তারই বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে।
এগুলো সমন্বয় করে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর ভেতরে কী আছে তার এক্সরে ছবির মতো একটা চিত্র তৈরি করতে পারলেন।
বিজ্ঞানীরা যখন এমন ২৫টি ভূমিকম্পের চিত্র পরীক্ষা করলেন, তারা দেখলেন যে কোর-ম্যান্টল বাউন্ডারিতে একটি উঁচুনিচু অংশে এসে ওই কম্পনটির গতি কমে যাচ্ছে। যা কেন হচ্ছে তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না।
এটা একটি পর্বতমালার মতো যার শৃঙ্গগুলো ম্যান্টলের ভেতরে ঢুকে আছে।
এমন কিছু শৃঙ্গের উচ্চতা ৪০ কিলোমিটার পর্যন্ত, তার মানে এগুলোর উচ্চতা এভারেস্টের চাইতেও সাড়ে চারগুণ বেশি। অন্য আরো কিছু শৃঙ্গের উচ্চতা তিন কিলোমিটারের মতো।
এরপর পৃথিবীর কোর জুড়ে এমন আরো অনেকগুলো পর্বত চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি পাওয়া গেছে যা অত্যন্ত বিশাল। এটি যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঞ্চলের নিচে এবং তা ছড়িয়ে রয়েছে ৯১০ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে।
এগুলো কিভাবে হলো বা এগুলো কী দিয়ে তৈরি তা এখনো কেউ জানে না।
তাছাড়া ওই পর্বতগুলোর কাছাকাছি আরো কিছু গোলাকার পিন্ডের উপস্থিতি দেখা গেছে। সেগুলো যে ঠিক কী এবং কোথা থেকে এলো তা রহস্যময়।
কিন্তু পর্বত ও পিন্ড একই জায়গায় উপস্থিত থাকায় তাদের মধ্যে কিছু একটা সম্পর্ক আছে বলেই অনুমান করা হয়।
কেন এসব পর্বতমালা তৈরি হয়েছে?
সাধারণত পৃথিবীর ম্যান্টলের তাপমাত্রা তিন হাজার ৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু কোরের তাপমাত্রা আরো বেশি, প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ডিগ্রি সেললিসিয়াস।
এ তাপমাত্রা প্রায় সূর্যের উপরিভাগের কাছাকাছি।
একটা তত্ত্ব হচ্ছে এসব পর্বতগুলো ম্যান্টলের নিচের দিকের অংশ, যা জ্বলন্ত কোরের কাছাকাছি থাকার কারণে অতি উত্তপ্ত হয়ে আংশিকভাবে গলে গেছে এবং সেটাকেই ইউএলভিজেড বলা হচ্ছে।
দ্বিতীয় আরেকটি তত্ত্ব হলো এই ডীপ-আর্থ মাউন্টেনগুলো তৈরি হয়েছে কিছুটা ভিন্ন আরেক ধরনের শিলা দিয়ে। যা ম্যান্টলকে ঘিরে আছে।
অনেকে বলেছে, হয়ত এটি কোনো প্রাচীন মহাসাগরের নিচের ভূস্তর বা ক্রাস্টের টুকরো। যা কোনো কারণে ম্যান্টলের ভেতরে ডুবে গেছে এবং কোটি কোটি বছর পর এখন তা কোরের ঠিক ওপরে এসে অবস্থান নিয়েছে।
হ্যানসেন বলছেন, কিন্তু অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের নিচে ডীপ-আর্থ পর্বতমালা পাওয়ার সাথে এ তত্ত্ব মিলছে না।
তার কথায়, ‘আমরা আমাদের গবেষণা চালিয়েছি দক্ষিণ গোলার্ধে, যা ওই সব বড় কাঠামো থেকে অনেক দূরে।’
অতীতে মনে করা হতো যে ডীপ-আর্থ পর্বতগুলো সবখানে নেই। বরং কিছু কিছু জায়গায় ছড়িয়ে আছে মাত্র।
কিন্তু হ্যানসেনের দল অ্যান্টার্কটিকায় যেখানেই নমুনা নিয়েছেন, সেখানেই ইউএলভিজেড কাঠামো পেয়েছেন। এমন হতে পারে যে এ ইউএলভিজেড হয়তো পুরো কোরের চারদিকেই একটি কম্বলের মতো জড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু এমন কোনো অনুমান নিশ্চিত করতে হলে আরো অনেক বেশি অনুসন্ধান ও গবেষণা দরকার।
সূত্র : বিবিসি
একদিনের জন্য ‘ইমিগ্রেশন অফিসার’ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, গ্রেপ্তার ১০৫
Own the headlines. Follow now- Zoom Bangla Google News, Twitter(X), Facebook, Telegram and Subscribe to Our Youtube Channel