ওরাল রিহাইড্রেশন স্যালাইন, সংক্ষেপে ওরস্যালাইন। ব্রিটিশ মেডিকেল সাময়িকী দি ল্যানসেট-এর মতে, চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার এটি। কলেরা ও পেটের অসুখের চিকিৎসার জন্য এ এক বিস্ময়কর আবিষ্কার। কলেরা, ডায়রিয়া বা পেটে নানা রোগ হলে দেহে পানি ও লবণের ঘাটতি দেখা দেয়। বারবার পাতলা পায়খানা হয় ডায়রিয়ার জন্য। ফলে অল্প সময়ে দেহের লবণ ও পানি কমে যায়। এই ঘাটতি পূরণের জন্যই খেতে হয় স্যালাইন। শুধু স্যালাইনের সাহায্যে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ শিশুর জীবন রক্ষা পেয়েছে ও পাচ্ছে।
বর্তমানে যে স্যালাইন বাজারে পাওয়া যায়, আগে তা এমন ছিল না। উপাদানে ভিন্নতা ছিল। তা ছাড়া সেই স্যালাইন খাওয়া যেত না। ইনজেকট করে দিতে হতো শরীরে। পাশ্চাত্যের সেই স্যালাইনে ছিল সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্লোরাইড ও গ্লুকোজের সঙ্গে সামান্য বাইকার্বোনেট। কিন্তু সেই স্যালাইন সহজে পাওয়া যেত না। ফলে সহজলভ্য স্যালাইনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল।
এই কাজ করেছেন একজন বাংলাদেশি। তখন দেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। ঢাকার তৎকালীন পাকিস্তান সিয়াটো কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে (পিএসসিআরএল) চলছে গবেষণা। পানিস্বল্পতা ও লবণ-ঘাটতি নিরসনে কাজ করেন ডা. রফিকুল ইসলাম। প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান নাম আইসিডিডিআর,বি। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের এক অধ্যাদেশ বলে পিএসসিআরএল রূপান্তরিত হয় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রে।
এটি আইসিডিডিআর,বির পূর্ণরূপ ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ডাইরিয়াল ডিজিজ রিসার্চ, বাংলাদেশ’-এর বাংলা নাম। অবশ্য লোকমুখে ১৯৮০-এর দশকে এই গবেষণা কেন্দ্রের নাম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল ‘কলেরা হাসপাতাল’। যাহোক, ডা. রফিকুল ১৯৬০ সালে এ গবেষণা কেন্দ্রে যুক্ত হন। ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন। কাজের পাশপাশি করেন গবেষণা।
১৯৭১ সালে পশ্চিমবঙ্গের শরনার্থী শিবিরে কলেরা ছড়িয়ে পড়ে। তখন একমাত্র চিকিৎসা ছিল সেই পাশ্চাত্যের ইন্ট্রাভেনাস স্যালাইন। কিন্তু সরবরাহ কম থাকায় তা সবাইকে দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ডা. রফিকুল নিজের উদ্ভাবিত ওরাল স্যালাইন সেই শিবিরেই প্রয়োগ করেন প্রথমবার। চমৎকার ফল পান। পরে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের জন্য তাঁকে স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশ সরকার। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আসে ১৯৮০ সালে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) তাঁকে এই স্যালাইনের উদ্ভাবক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। পরের কাজটা করে ব্র্যাক। এই এনজিও সারা দেশে স্যালাইনের খবর পৌঁছে দেয়। দেশের প্রায় সব মুদি দোকান বা ফার্মেসিতে পাওয়া যায় স্যালাইন। এতে থাকে সোডিয়াম ক্লোরাইড (খাওয়ার লবণ), পটাশিয়াম ক্লোরাইড, গ্লুকোজ এবং ট্রাইসোডিয়াম সাইট্রেট। ফলে শরীরের পানি ও লবণের ভারসাম্য ঠিক থাকে।
স্যালাইন প্রস্তুত করাও সহজ। প্রথমে নিজের দুই হাত, পাত্র ও চামচ ভালো করে পরিষ্কার করে নিতে হবে। তারপর একটা পাত্রে আধা লিটার (স্যালাইনের প্যাকেটে লেখা থাকে ‘২ পোয়া’) বা ৫০০ মিলিলিটার বিশুদ্ধ পানি নিতে হবে। এক প্যাকেটে থাকা পুরো স্যালাইন মেশাতে হবে পানিতে।
এবার ভালো করে পরিষ্কার চামচ দিয়ে পানি ও স্যালাইন দ্রবীভূত করতে হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী ডায়রিয়া ভালো না হওয়া পর্যন্ত খাওয়াতে হবে এ স্যালাইন। তবে হাতের কাছে কেনা স্যালাইন না থাকলে ঘরোয়া পদ্ধতিতেই স্যালাইন তৈরি করা যায়। এক মুঠো চিনি বা গুড় আর সঙ্গে তিন আঙ্গুলের এক চিমটি লবণ নিয়ে ৫০০ মিলিলিটার বিশুদ্ধ পানিতে মিশিয়ে স্যালাইন তৈরি করে নেওয়া যায় সহজেই।
খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় হলো, নিয়মে ব্যতিক্রম হলে স্যালাইন পানেও মৃত্যু হতে পারে। প্রতিটি স্যালাইনের প্যাকেটের গায়ে ওপরে আলোচিত প্রস্তুত পদ্ধতি দেওয়া থাকে। সেভাবেই প্রস্তুত করা উচিত। কারণ, লবণের নির্দিষ্ট মাত্রা আছে। রক্তে লবণের মাত্রা প্রতিলিটারে ১৩৫-১৪৫ মিলি মোল। রক্তে লবণের পরিমাণ এর চেয়ে কমে গেলে যেমন সমস্যা, তেমনি বেশি হলেও ক্ষতি।
কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের ধারণা, পাতলা পায়খানা হলে একটু ঘন করেই স্যালাইন প্রস্তুত করে খেতে হয়। এতে রোগী তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন। এ ধারণা সত্য নয়। বরং এতে হিতে বিপরীত হতে পারে। অল্প পানিতে স্যালাইন মিশিয়ে খাওয়ালে দেহে লবণের মাত্রা হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে। অতিরিক্ত লবণের প্রভাবে দেহের কোষ থেকে পানি বেরিয়ে যাবে। বিশেষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে মস্তিষ্কের কোষ। লবণ বের হয়ে গেলে কোষ অকার্যকর বা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এতে মৃত্যু ঝুঁকিও রয়েছে।
তাই নিয়ম মেনে স্যালাইন খাওয়া উচিত। স্যালাইনের সঙ্গে অন্য কিছু মেশানো যাবে না। প্রতিবার পায়খানার পর দুই বছরের কম বয়সী শিশুকে নির্দিষ্ট পরিমাণ পানিতে স্যালাইন মিশিয়ে ১০ থেকে ২০ চা-চামচ স্যালাইন খাওয়াতে হবে। স্যালাইন বানানোর ১২ ঘণ্টা পর আর তা খাওয়ানো যাবে না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।