জুমবাংলা ডেস্ক : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশে ইতিবাচক পটপরিবর্তনের পরও থেমে নেই ওষুধের বাজারে নৈরাজ্য। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন অজুহাতে বাড়ানো হচ্ছে কোনো না কোনো ওষুধের দাম। নিত্যপণ্যের দামের মতোই ওষুধের দাম বাড়ানো একরকম নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোনো কারণ ছাড়াই দফায় দফায় জীবনরক্ষাকারী বিভিন্ন ওষুধের দাম ইচ্ছামতো বাড়াচ্ছে অনেক কোম্পানি।
গত কয়েক দিনে অ্যান্টিবায়োটিক, ব্যথানাশক ট্যাবলেট, ভিটামিন, গ্যাস্ট্রিক ও ডায়াবেটিসের ওষুধসহ বিভিন্ন ধরনের ইনজেকশনের দাম সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ১১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ফার্মেসিতে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। আর ওষুধ প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত কয়েক মাসে ১০ থেকে ১৫টি কোম্পানির অন্তত ৪৫টি ওষুধের দাম বেড়েছে।
দেশে প্রায় দেড় হাজারের বেশি অ্যাসেনসিয়াল ড্রাগসের (জীবনরক্ষাকারী ওষুধ) জন্য ২৭ হাজারেরও বেশি ব্র্যান্ডের ওষুধ উৎপাদন করা হয়। এর মধ্যে উৎপাদিত মোট ওষুধের মাত্র ৩ শতাংশের দাম নির্ধারণ করতে পারে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। বাকি ৯৭ ভাগের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো।
আর এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইচ্ছামতো ওষুধ কোম্পানিগুলো মুনাফা করছে বলে অভিযোগ করেন পাইকারি ও খুচরা ওষুধ বিক্রেতারা। তারা বলেন, এক শ্রেণির অতি মুনাফালোভী ওষুধ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করে বছরের পর বছর ওষুধের দাম বাড়াচ্ছে। আর যেহেতু ওষুধের মূল্য নির্ধারণে সরকারের তেমন কোনো ভূমিকা নেই। ফলে সেই সুযোগে যে যার মতো দাম বাড়াচ্ছে।
অথচ ওষুধের দাম বৃদ্ধি রোধে গত ২৯ এপ্রিল উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে অব্যাহতভাবে ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি রোধে কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করা হয়। কিন্তু উচ্চ আদালতের সেই নির্দেশ মানা হচ্ছে না বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করেন ভুক্তভোগীরা।
রোগী ও তাদের আত্মীয়স্বজনরা জানান, লাগামহীনভাবে ওষুধের দাম বাড়ানোর ফলে তারা ক্রমেই জিম্মি হয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে যাদের নিয়মিত ওষুধ খেতে হয় তাদের অবস্থা বেশি শোচনীয় হয়ে পড়ছে। আর উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত একেকজন রোগীর প্রতি মাসে ওষুধ খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে। ফলে অনেক সময় কাটছাঁট করে ওষুধ কিনতে হচ্ছে। তবে ওষুধের দাম পেছনে ডলারের সংকট, উৎপাদন ব্যয়, প্যাকেজিং মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহন, ওষুধ কোম্পানিগুলোর শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা। আর ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে নজর দেওয়ার পাশাপাশি কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
শুক্রবার রাজধানীর ফার্মগেট, শাহবাগ বিপণিবিতান ও আজিজ কো-অপারেটিভ মেডিসিন মার্কেট, মিটফোর্ড ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকার কয়েকটি ফার্মেসিতে ঘুরে ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে বেশ কিছু ওষুধের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার তথ্য গেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-এসিআই লিমিটেড কোম্পানির গ্যাস্ট্রিক ও আলসার এবং অস্টিওআর্থারাইটিস রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত অ্যানাফ্লেক্স ম্যাক্স-৫০০ প্লাস ২০ মিলিগ্রাম প্রতি পিসের দাম ১০ থেকে বেড়ে ২১ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে শতকরা ১১০ শতাংশ। একই কোম্পানির ব্যথানাশক ও জ্বর উপশমকারী ওষুধ অ্যানাফ্লেক্স-৫০০ এমজি এস আর ট্যাবলেট প্রতি পিস ৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৬ টাকা। দাম বেড়েছে ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এই কোম্পানির পেরিফেরাল ভাস্কুলার ডিজিজ, যা রক্তনালি সরু বা ব্লকজনিত সমস্যায় ব্যবহৃত আরেক ওষুধ ফলুভার এক বক্স (১০ পাতা) ৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ৭০০ টাকা হয়েছে। শতকরা হিসাবে বেড়েছে ৪০ শতাংশ।
স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস পিএলসি কোম্পানির গ্যাস্ট্রিক ও আলসারজনিত সমস্যায় ফ্যামোট্যাক ২০ মিলি গ্রামের ১২টির এক পাতা ২৫ টাকা থেকে বেড়ে ৪৫ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৮০ শতাংশ।
একই কোম্পানির ডায়াবেটিস টাইপ-২ রোগীদের জন্য ব্যবহৃত এমজার্ড এম ৫/৫০০ ১০টির এক পাতার দাম ১৬৬ থেকে বেড়ে ১৮০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ।
অ্যারিস্টো ফার্মা লিমিটেডের দাঁত ব্যথা কিং বা দাঁতে প্রদাহজনিত সমস্যায় মারভ্যান-১০০ মিলিগ্রামের এক বক্সের (১০ পাতা) ট্যাবলেটের দাম ৪০০ থেকে বেড়ে ৭০০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৭৫ শতাংশ।
সার্ভিয়ার বাংলাদেশ অপারেশন নামের এক কোম্পানির ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমানোর ডাইমাইক্রন এমআর ৩০ মিলিগ্রামের এক বক্স (৩০টি) ট্যাবলেটের দাম ৩৮০ থেকে বেড়ে ৪২০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
অ্যাজমা ও ফুসফুসজনিত সমস্যায় ব্যবহৃত ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের ডক্সোমা ট্যাবলেট এক বক্সের (৫০টি) দাম ২৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৪০০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশ। টিস্যু জাতীয় সমস্যার জন্য নুভিসতা ফার্মা লিমিটেডের ট্যাবলেট ডাইনোজেস্ট ২ মিলিগ্রামের ১০টির এক পাতার দাম ৪০০ টাকা থেকে বেড়ে ৫০০ টাকা হয়েছে। অর্থাৎ বেড়েছে ২৫ শতাংশ।
ডিসমেনোরিয়া রোগের চিকিৎসায় একই কোম্পানির ডাইড্রোন-১০ মি. গ্রামের ট্যাবলেট এক বক্সের (৩০টি) দাম ৯০০ থেকে ১২০০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ৩৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ।
মিটফোর্ড এলাকার আলিফ-লাম-মিম ফার্মায় ওষুধ কিনতে এসেছিলেন সাইদুর রহমান নামে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এক রোগী। তিনি বলেন, আমি ও আমার স্ত্রী দীর্ঘদিন ধরেই ডায়াবেটিস ও হাঁপানিতে ভুগছি। তাই প্রতি মাসেই ইনসুলিন, স্ট্রিপস কৌটা, হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টের ওষুধ মন্ট্রিল কিনতে হয়। অ্যান্টিবায়োটিকসহ সব ওষুধের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। কিন্তু আমাদের ইনকাম তো বাড়েনি। আর এভাবে বাড়তে থাকলে তো ওষুধ না খেয়েই মরতে হবে।
ওষুধের দাম বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে আলিফ-লাম-মিম ফার্মার এক কর্মচারী বলেন, আমাদের তো কিছু করার নেই। কোম্পানি দাম বাড়লে তো আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হয়। কিন্তু কাস্টমার সঙ্গে ঝামেলা পোহাতে হয় আমাদের।
শাহবাগের পপুলার মেডিসিন সেন্টারের দোকানি সঞ্জয় কুমার বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেও কম-বেশি কিছু ওষুধের দাম বেড়েছে। ফার্মেসির হতদরিদ্র মানুষের কথা বাদ দিলেও এখন নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেকে ওষুধ কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। দাম বাড়ার কারণে ওষুধ বিক্রি করতে গিয়ে আমরাও অনেক সময় ঝামেলায় পড়ি।
ফার্মগেট এলাকার সুনান ফার্মা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক সৈয়দ সাদিকুল ইসলাম বলেন, ওষুধের দাম প্রতিনিয়তই বাড়ছে। কিন্তু দাম নিয়ন্ত্রণে কোনো পদক্ষেপ নেই। অথচ নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে সারা দেশে হইচই পড়ে। পত্রিকায় লেখালেখি হয়। কিন্তু ওষুধের দাম দ্বিগুণ বাড়লেও তা নিয়ে টু শব্দ হয় না।
ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিদেশ থেকে আমদানি করা কাঁচামালের খরচ যেমন বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে ডলারের দাম। একইভাবে ওষুধ উৎপাদন ব্যয়, প্যাকেজিং মূল্যবৃদ্ধি, পরিবহন, কর্মচারী খরচ, গ্যাস-বিদ্যুৎ বা জ্বালানি খরচ দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। সেই তুলনায় ওষুধের দাম খুব বেশি বাড়েনি।
এ বিষয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, ওষুধের দাম বাড়লে সাধারণভাবেই মানুষের ওপর এক ধরনের প্রভাব পড়ে। বাজারে কোম্পানিগুলোর মধ্যে দাম বাড়াতে এক ধরনের অনৈতিক প্রতিযোগিতা চলছে। যদিও ডলার সংকটসহ নানা ধরনের খরচ বাড়ছে। কিন্তু তারপরও ওষুধের দাম যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তা কতটুকু যৌক্তিক সেই প্রশ্ন রয়েছে। আর দাম বাড়ার কারণ হচ্ছে সরকারের যে ওষুধনীতি রয়েছে তা কার্যকর হয়নি। তাই দাম নির্ধারণে সবাইকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। এজন্য আইনও লাগবে, প্রয়োগও লাগবে। মানুষকেও সচেতন হতে হবে। সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশল গ্রহণ করা ছাড়া কখনোই ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে না।
৩ মাসে জ্বালানি খাতে ৩৭০ কোটি টাকা সাশ্রয়: জ্বালানি উপদেষ্টা
এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের পরিচালক মো. আসরাফ হোসেন বলেন, বিগত কয়েক মাসে বেশ কিছু ওষুধের দাম বেড়েছে। সেটি হয়তো ৫ থেকে ৭ শতাংশ। দাম বাড়ানো বললে ভুল হবে, আসলে তা দামটা সমন্বয় করা হয়েছে। কারণ একসময় ডলার ছিল ৮০ টাকা, সেটি এখন বেড়ে ১২০ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া কাঁচামাল, বিদ্যুৎ উৎপাদন ওষুধ উৎপাদন ব্যয়, প্যাকেজিং মূল্যবৃদ্ধি এবং পরিবহনসহ অনেক খরচই বেড়েছে। সূত্র : সময়ের আলো
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।