মাসুম মুরাদাবাদি : মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমীনের প্রধান ব্যারিস্টার আসাদুদ্দীন ওয়াইসি গত ৩ ফেব্র“য়ারি বৃহস্পতিবার এক আত্মঘাতী হামলায় কোনো রকমে বেঁচে গেছেন। তিনি মিরাঠের কিঠোর এলাকার নির্বাচনী সভা থেকে ফিরছিলেন। পথে ডাসনার কাছাকাছি টোল প্লাজায় তার ওপর উপর্যুপরি গুলি করা হয়। গুলি তার গাড়ির দরোজায় বিদ্ধ হয় এবং একটি টায়ার পাঙ্কচার হয়ে যায়। একজন হামলাকারীকে ওয়াইসির সঙ্গীরা ঘটনাস্থলেই ধরে ফেলেন। আরেকজনকে পুলিশ পরে গ্রেফতার করে। হামলাকারীদের নাম বলা হচ্ছে শচিন ও শুভম।
পুলিশ ওই দু’জনের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার মামলা দায়ের করে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওয়াইসি এই হামলাকে একটি ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করে এর সর্বোচ্চ পর্যায়ের তদন্তের দাবি করেছেন। তিনি ইলেকশন কমিশন ও লোকসভা স্পিকারের কাছেও এটার অভিযোগ করেছেন। তিনি সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া জেড প্লাস নিরাপত্তা নিতে অস্বীকার করেছেন এবং হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ (সন্ত্রাসবিরোধী আইন)-এর আওতায় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। তিনি পার্লামেন্টে বলেন, ‘ওয়াইসির প্রাণ আখলাক ও পাহলু খানের চেয়ে বেশি মূল্যবান নয়। আমি নিরাপত্তা চাই না। আপনি সব মানুষের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুন। যারা ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়ায়, তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। তাহলে আমি এমনিতেই নিরাপদ হয়ে যাব।’
ওয়াইসিকে টার্গেট বানানো উগ্রপন্থীদের এটাই প্রথম নয়। এর আগে দিল্লিতে অশোকা রোডে অবস্থিত তার বিশ্রামাগারে কয়েকবার হামলা করা হয়েছে। হিন্দু উগ্রপন্থী সংগঠনগুলোর কর্মীরা সেখানে ভাঙচুর চালায়। সব কিছু তছনছ করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত পুলিশ ওই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনো শক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। পুলিশের সেই ঢিলেমিপনাকে কাজে লাগিয়ে এখন উগ্রপন্থীরা ওআইসিকে সরাসরি টার্গেট বানিয়েছে। আপনাদের জানিয়ে রাখি, যে কুঠিতে আসাদুদ্দীন ওয়াইসি বসবাস করেন, সেখানে তার পিতা মরহুম সুলতান সালাহুদ্দীন ওয়াইসিও বসবাস করতেন। ওই কুঠির ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বাবরি মসজিদ উদ্ধারের পুরো আন্দোলন এখান থেকেই পরিচালিত হয়েছে। এ কুঠি সর্বভারতীয় বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটির কেন্দ্রীয় দফতর ছিল এবং এর সকল মিটিং এখানেই হতো।
আসাদুদ্দীন ওয়াইসির ওপর হামলার পর উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা হয়েছে। ওয়াইসি প্রশ্ন তুলেছেন, ‘উত্তরপ্রদেশে কি আইনের শাসন চলছে, নাকি অপশাসনের উন্নতি ঘটছে? সরকার যদি বন্দুকের সংস্কৃতিকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাহলে দেশে আইনের রাজত্ব শেষ হয়ে যাবে।’ গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে, ওয়াইসি এই হামলায় মোটেও ভীত নন। তিনি এই হামলার কারণে ইউপিতে নির্বাচনী প্রচারণা থেকেও হাত গুটিয়ে নেননি। তিনি বলেন, তিনি ইউপিতে তার নির্বাচনী প্রচারাভিযান অব্যাহত রাখবেন। যতক্ষণ বেঁচে থাকবেন, সত্যের আওয়াজ উঁচু করেই যাবেন।
উল্লেখ্য, ওয়াইসির ওপর আত্মঘাতী হামলা সেই উত্তর প্রদেশেই হয়েছে, যেখানকার রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বেশ প্রভাব রয়েছে। তারা নিজেরাই নিজেদের বুক থাপড়ে বলেন, ‘উত্তরপ্রদেশ এখন গুণ্ডা ও বদমাশ মুক্ত হয়েছে।’ অথচ পেশাদার অপরাধী গোষ্ঠীকে প্রতিদিনই অমিত শাহ ও যোগীর এই বক্তব্যকে ব্যঙ্গ করতে দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এর চেয়ে বড় ত্র“টি আর কী হতে পারে যে, ইউপি ও দিল্লির সীমান্তে একজন পার্লামেন্ট সদস্য ও দলপ্রধানকে এলোপাতাড়ি গুলির টার্গেট বানানো হয়। আর সেটিও এমন একসময়, যখন বিধানসভা নির্বাচনের কারণে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো সর্বোচ্চ সতর্কতায় রয়েছে।
এ কথা সবাই জানেন যে, আসাদুদ্দীন ওয়াইসি উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে আশিটির বেশি আসনে তার প্রার্থী দাঁড় করিয়েছেন। তিনি তাদের জয় নিশ্চিত করার জন্য ভোটারদের সাথে গণসংযোগ করছেন। মুসলিম পরিমণ্ডলে তার বিশেষ গ্রহণযোগ্যতাও বেড়ে চলেছে। তিনি পার্লামেন্টের ভেতরে বাইরে যে ভঙ্গিতে মুসলিম সমস্যাবলি উত্থাপন করেন, তার দ্বারা মুসলিম যুবকদের মাঝে তার কদর ও মর্যাদা সবচেয়ে বেশি। তার নির্বাচনী জনসভাগুলোতে উপচে পড়া ভিড় দেখে এটার অনুমান করা যায়। সম্ভবত এ কারণেই ওয়াইসিকে নিয়ে ওই লোকরা উৎকণ্ঠিত, যারা নিজেদের এখন পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশে মুসলমানদের ভোটের একমাত্র ঠিকাদার মনে করে। এ কারণে ওয়াইসির ওপর একের পর এক অপবাদও আরোপ করা হচ্ছে।
তার ওপর আরোপিত বড় অপবাদ হচ্ছে, তিনি বিজেপির ‘বিটিম’। অথচ তিনি তার বক্তৃতা ও কথাবার্তায় সবচেয়ে বেশি বিজেপিকেই লক্ষ্যবস্তু বানান। আসাদুদ্দীন ওয়াইসি সম্পর্কে এটা বলা জরুরি যে, তিনি নিরাপত্তার জন্য কোনো ধরনের বাহিনী সাথে রাখেন না এবং বুলেট প্র“ফ গাড়িও ব্যবহার করেন না। তিনি আল্লাহকেই জীবন-মৃত্যুর মালিক মনে করেন। একটি টিভি চ্যানেল যখন তার কাছে জানতে চাইল যে, হামলার সময় তিনি ভয় পেয়েছিলেন কি না? তখন তিনি বলেন, ‘না, আমি কালেমা পাঠ করে নিয়েছিলাম। কেননা আমার মনে হয়েছিল, আল্লাহ তায়ালার সাথে সাক্ষাতের সময় চলে এসেছে।’
আপাতদৃষ্টিতে তার ওপর যে হামলা হয়েছে, সেটা বিদ্বেষমূলক রাজনীতিরই ফল মনে হচ্ছে। এমনিতেই উত্তরপ্রদেশ কয়েক বছর ধরে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কিন্তু যখন থেকে সেখানে বিধানসভার নির্বাচনের উৎসব শুরু হয়েছে, তখন থেকেই যেন সেখানে সাম্প্রদায়িকতার বসন্ত এসেছে। ব্যারিস্টার ওয়াইসির ওপর হামলার একটি চিন্তনীয় দিক হচ্ছে, এটা সেই ডাসনা এলাকায় করা হয়েছে, যেখানে ডাসনা দেবীর মন্দির রয়েছে। এর পূজারী এ সময়ের সমালোচিত কলুষিত ব্যক্তি যতি নরসিংহানন্দ। যতি এই এলাকাকে মুসলিম বিদ্বেষের আখড়া বানিয়ে রেখেছেন। গত বছর এই মন্দিরে পানি পান করতে আসা মুসলিম যুবকের সাথে যে বর্বরোচিত আচরণ করা হয়েছিল, তার পর থেকেই যতি নরসিংহানন্দ সংবাদ শিরোনামে আসেন।
পরবর্তী সময়ে তিনি রীতিমতো মুসলিম বিদ্বেষের অপতৎপরতা শুরু করেন। যতি নরসিংহানন্দ হরিদ্বার ধর্ম সংসদে মুসলমানদের গণহত্যার ঘোষণার পর কারাগারে বন্দী হন। যারা যদি নরসিংহানন্দের বিরুদ্ধে হরিদ্বার মামলায় এফআইআর লিপিবদ্ধ করান, তাদের মধ্যে মজলিসে ইত্তেহাদুল মুসলিমীনেরও একজন সদস্য রয়েছেন। গ্রেফতার হওয়া হামলাকারীদের অন্যতম যুবক শচিন শর্মার বাড়ি গৌতম বুদ্ধনগরের বাউলপুর গ্রামে। তাকে ওয়াইসির সঙ্গীরাই ধরে পুলিশে দিয়েছে। হামলায় ব্যবহৃত লাইসেন্সবিহীন পিস্তল ও একটি সাদা অটোকার জব্দ করা হয়েছে।
অপর হামলাকারী শুভমকে সাহারানপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শচিন শর্মার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে বিজেপি নেতৃবৃন্দের সাথে তার অনেক ছবি পাওয়া গেছে। সে যতি নরসিংহানন্দের একটি বিদ্বেষমূলক ভিডিও বক্তব্যও শেয়ার করেছে। শর্মা তার ফেসবুক পেজে জামিয়া মিল্লিয়াতে সিএএ বিরোধী বিক্ষোভে গুলিবর্ষণকারী রামভক্ত গোপালের সাথেও একাত্মতা ঘোষণা করেছে। এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, তার পেছনে কলকাঠি কোথায় থেকে নাড়া হচ্ছে। যদি পুলিশ নিরপেক্ষতার সাথে এবং কোনোরকম চাপ ছাড়াই তদন্ত করে, তাহলে তারা মূল অপরাধী পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে। কিন্তু পুলিশ তদন্ত শুরু করার আগেই যা কিছু বলেছে, তা এ মামলার তদন্তের গন্তব্য চূড়ান্ত করে দিয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা হামলাকারী শচিন শর্মাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে বলেছেন, সে মূলত ওয়াইসির বক্তব্যের প্রতি নাখোশ ছিল। এ ব্যাপারে স্বয়ং আসাদুদ্দীন ওয়াইসির বক্তব্য হচ্ছে, যদি তিনি বেআইনি বক্তব্য দিয়ে থাকেন, তাহলে পুলিশ এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি কেন? তিনি এ অভিযোগকে প্রত্যাখ্যান করে বলেন, তিনি মজলুমের পক্ষে কণ্ঠ উচ্চ করেন এবং এ কাজ শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত করে যাবেন। যদি মজলুমের পক্ষে কণ্ঠ উচ্চ করা কোনো অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে সেই অপরাধ তিনি বারবার করবেন। মোটকথা আসাদুদ্দীন ওয়াইসির ওপর এই কাপুরুষোচিত হামলা এতটুকু তো প্রমাণ করে দিয়েছে যে, উত্তরপ্রদেশে শান্তি ও আইন রক্ষাকারী সংস্থাগুলো পুরোপুরি পঙ্গু হয়ে গেছে। নির্বাচনের সময়ও তারা শুধু শাসকদলের স্বার্থ পূর্ণ করতে ব্যস্ত হয়ে আছে।
মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ, ০৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ থকে উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
লেখক : ভারতের সাংবাদিক ও কলামিস্ট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।