জুমবাংলা ডেস্ক: কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। হোটেল-মোটেল কিংবা রিসোর্টে জায়গা না পেয়ে সৈকত, মসজিদ, রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছেন পর্যটকরা। খবর বিবিসি বাংলার।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পর্যটকদের এমন দুর্ভোগের খবর আর ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।
স্থানীয় হোটেল কর্তৃপক্ষ আর জেলা প্রশাসন বলছে, ১৯ শে ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে গত দুদিনে প্রায় ৪-৫ লাখের মতো মানুষ পর্যটন শহরটিতে অবকাশ যাপনে গেছেন।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় অবকাশ গন্তব্যগুলোর মধ্যে অন্যতম কক্সবাজার। এটি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকতও বটে।
গত দুই তিন বছরে এতো পর্যটক দেখি নাই
কক্সবাজারের গোল্ডেন হিল হোটেলের মহাব্যবস্থাপক জয়নুল আবেদিন বলেন, গত দুই দিন তাদের হোটেল ভর্তি অতিথি ছিলো। আজও রয়েছে। তবে আগের দু’দিনের তুলনায় কিছুটা কম।
তিনি বলেন, ১৯, ২০ পুরা হাউজফুল ছিল। আজ নরমাল।
পর্যটকদের চাপ কেমন ছিল জানতে চাইলে মি. আবেদিন যে বর্ণনা দেন সেটা অনেকটা এরকম- তিনি রাস্তায় এবং বিচের খোলা জায়গায় অনেক পর্যটককে রাত কাটাতে দেখেছেন।
পর্যটকদের সামাল দিতে স্থানীয় মসজিদগুলোও সারা রাত খোলা ছিল বলে জানান তিনি। যেখানে অনেক পর্যটক রাত কাটিয়েছেন।
এছাড়া যেসব রেস্তোরাঁ এবং বার রাত বারোটার পর বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা সেগুলোও সারারাত ধরে খোলা ছিল।
মি. আবেদিন জানান, সবশেষ এমন ভিড় তিনি দেখেছেন ২০১৮ সালের ৩১শে ডিসেম্বরে। এরপর আর এত বিশাল সংখ্যক পর্যটক দেখা যায়নি। এর আগে ২০১৬ সালেও একবার বিপুল পর্যটকের আনাগোনা হয়েছিল বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, আমাদের এখানে হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউজের সংখ্যা প্রায় ৫শ’র মতো। সেগুলোর ধারণক্ষমতা সব মিলিয়ে আড়াই থেকে তিন লাখের মতো। গত দুই দিনে এর চেয়ে অনেক বেশি পর্যটক এসেছে।
নিসর্গ হোটেল এন্ড রিসোর্টের হেড অব অপারেশনস মোহাম্মদ ফখরুল আলম শোভন বলেন, গত ১৯ ও ২০শে ফেব্রুয়ারি উপচে পড়া ভিড় ছিলো। তাদের হোটেলটি কিছুটা দূরে হলেও গত দুই দিন কোন রুম খালি ছিল না।
তিনি জানান, জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই ওই দুই দিনের জন্য তাদের হোটেলের সব রুম বুক হয়ে গিয়েছিল। যার কারণে ওই সময়ে তারা আর কোন নতুন পর্যটককে রুম দিতে পারেননি।
মি. আলম জানান, তিনি শহর এলাকাগুলো ঘুরে দেখেছেন যেখানে আজও পর্যটকরা আসছেন এবং বিপুল ভিড় রয়েছে।
তিনি জানান, ছোট ছোট হোটেল এবং কটেজগুলোয় প্রচণ্ড ভিড়। এর আগে গত দুই তিন বছরে তিনি এরকম ভিড় দেখেননি বলেও জানান।
তিনি বলেন, গত দুই-তিন বছরে আমি এধরণের পর্যটক দেখিনি- গত দুই দিনে যত আসছে।
বেশিরভাগ মানুষই আসলে আগে থেকেই হোটেলে রুম বুক না করেই চলে আসে। যার কারণে এ ধরণের একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়।
মি. আলম বলেন, আগে থেকে যদি রুম বুক করে আসতো বা যারা রুম পায়নি তারা যদি না আসতো, কিংবা পরে আসতো তাহলেই আর এ ধরণের পরিস্থিতি তৈরি হতো না।
মারমেইড হোটেল বিচ রিসোর্টের এক কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, কক্সবাজার শহরে প্রচুর মানুষের ভিড় এবং এতো বেশি পরিমাণ পর্যটকের জন্য শহর থেকে মেরিন ড্রাইভ পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট লেগেছিল।
তিনি বলেন, পর্যটকরা হোটেলে জায়গা না পেয়ে কম্বল নিয়ে রাস্তার আশপাশে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটিয়েছে।
সামাজিক মাধ্যমে দেখেছি
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ বলেন, বিভিন্ন কারণে আসলে এই সময়টাতে পর্যটক বেড়েছে। আর এক সাথে অনেক পর্যটক যাওয়ার কারণে ব্যবস্থাপনায় সমস্যা তৈরি হয়েছে বলে জানান তিনি।
মি. রশীদ বলেন, একে তো শুক্র-শনিবার সরকারি ছুটি। তার সাথে একুশে ফেব্রুয়ারির কারণে আরও একদিন ছুটি যোগ হয়েছে। যার কারণে মানুষ ঘুরতে বের হয়েছে।
কোভিড পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘ সময় ঘরে থাকার কারণেও একঘেঁয়েমি দূর করতে ঢাকার বাইরে ছুটে গেছে মানুষ।
তিনি জানান, অনেকে বিদেশে বেড়াতে গেলেও এবার কোভিডের কারণে মানুষ দেশের বাইরে যেতে পারেনি। যার কারণে ডিসেম্বরের শেষের দিকে এবং জানুয়ারির মাঝামাঝিতে পর্যটক বাড়ার প্রবণতা ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড়িয়েছে। একই কারণে প্রচুর মানুষ কক্সবাজারকে বেছে নিয়েছে।
জেলা প্রশাসক মি. রশীদ জানান, পর্যটকদের খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানোর কথা তারা শোনেননি। তবে সামাজিক মাধ্যমে এবং স্থানীয় সংবাদ মাধ্যমে এই খবর শোনার কথা জানিয়েছেন তিনি।
তিনি জানান, কক্সবাজারে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে চার শতাধিক হোটেল রয়েছে। এর আগে এ ধরণের পরিস্থিতির মুখে পড়েননি তারা। এতো বিপুল সংখ্যক পর্যটক এর আগে আসেনি। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে এ ধরণের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
পর্যটকদের আসা-যাওয়ার বিষয়ে জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নেই বলেও জানান তিনি। যার কারণে কত সংখ্যক মানুষ আসলো সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য পাওয়া যায় না।
তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যাতে এ ধরণের পরিস্থিতি তৈরি না হয় এবং পর্যটন ব্যবস্থাপনা যাতে আরও ভাল হয় তার জন্য সব পক্ষের সাথে আলোচনা ছাড়াও নানা পরিকল্পনা হাতে নেয়ার বিষয়গুলো বিবেচনা করা হচ্ছে।
পরিকল্পনা জরুরী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামশাদ নওরীণ বলেন, কোভিড কমে যাওয়া, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা, ভ্যাকসিন নেয়া শুরু হওয়া, এক সাথে বেশ কয়েক দিন ছুটি এবং আবহাওয়া ভাল থাকার কারণে মানুষ কক্সবাজারকে তাদের বিনোদনের কেন্দ্র ধরে নিয়ে সেখানে ভিড় করেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের ট্যুরিজম মূলত কক্সবাজার ভিত্তিক। প্রাথমিকভাবে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রতিদিন জেলাটিতে অন্তত ৫০ হাজার পর্যটক যাওয়া-আসা করে বলে জানান তিনি।
সামশাদ নওরীণ জানান, যে সংখ্যাটির কথা বলা হয়েছে সেটি মূলত পর্যটন পুলিশ এবং ট্রাভেল এজেন্টদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বলা হচ্ছে। তবে কক্সবাজারে প্রতিদিন আসলেই কত সংখ্যক পর্যটক যাওয়া আসা করছে তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। কারণ বাংলাদেশে এটি জানার কোন ব্যবস্থাই নেই।
সঠিক তথ্য পাওয়া না যাওয়ার কারণে এক সময়ে ওই জায়গাটিতে কত সংখ্যক পর্যটককে আপ্যায়ন করা সম্ভব বা ধারণ ক্ষমতা কত সেটি বোঝা যায় না। এ কারণে মাত্রাতিরিক্ত পর্যটকের ভিড় হয় বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, এই পরিস্থিতি এড়াতে হলে, পর্যটকদের সংখ্যা জেনে, পর্যটক ধারণ বা আপ্যায়নের সক্ষমতা জেনে, বাজার পরিস্থিতি মাথায় রেখে পর্যাপ্ত সংখ্যক পর্যটকদের যাওয়ার অনুমতি দিতে হবে।
“একটা পারমিটের ব্যবস্থা করতে হবে যে…এত সংখ্যক পর্যটকের বেশি এক সাথে যেতে পারবে না। তারা ফিরে আসলে আবার অন্যরা যাবে।”
অতিরিক্ত পর্যটক যাতে যেতে না পারে তার জন্য পর্যটক সংখ্যা নির্ধারণ করাটা জরুরী বলে মনে করেন তিনি।
এছাড়া কক্সবাজারে পর্যটক কমাতে হলে সেখানে পর্যটকের চাপ কমাতে হবে। এর জন্য দেশের অন্য পর্যটন এলাকাগুলোকে আকর্ষণীয় করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। এর জন্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করে ব্যবস্থাপনা ভাল করতে হবে।
সামশাদ নওরীণ বলেন, বাংলাদেশের অন্য পর্যটন এলাকার তুলনায় কক্সবাজারে যাওয়ার ব্যবস্থা, হোটেল-ফ্যাসিলিটির দিক থেকে এই ডেসটিনেশনটা বেশি সুরক্ষিত এবং রিলায়েবল।
এ কারণেই অভ্যন্তরীণ পর্যটকরা কক্সবাজারেই বেশি ভিড় করে। তবে দেশের অন্য এলাকাগুলোতে যে পরিমাণ পর্যটক যায় সেগুলোর পরিমাণও ঠিক আছে বলে মনে করেন ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি বিভাগের এই শিক্ষক।
তিনি বলেন, এর চেয়ে বেশি পর্যটক যদি চট্টগ্রাম, রাঙামাটি কিংবা বান্দরবানে যায় তাহলে সেখানকারও স্থানীয় বাসিন্দা এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর চাপ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
তিনি আরও বলেন, কক্সবাজার যেহেতু সবচেয়ে বড় সমুদ্র সৈকত এবং এর একাধিক সৈকত রয়েছে যেখানে পর্যটকরা যেতে পারেন, তাই এই জায়গাটিকেই যথাযথ ব্যবস্থাপনার আওতায় আনতে হবে। যাতে এ ধরণের পরিস্থিতি তৈরি না হয়।
তিনি মনে করেন, কক্সবাজারকে কয়েকটি আলাদা জোনে ভাগ করে সেখানে কিভাবে পর্যটনের পরিস্থিতি তৈরি করা যায় তার জন্য পরিকল্পনা করতে হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।