খোরশেদ আলম: বর্তমান পৃথিবী করোনা (COVID-19)নামক এক ভাইরাসের কাছে বিপর্যস্থ । রীতিমত আতঙ্কে পরিনত হয়েছে ভাইরাসটি। চীনের উহানের পর করোনাভাইরাস এখন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে। আমাদের প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশও প্রাণঘাতী এই ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। ইতোমধ্যে আমাদের দেশের পাঁচজনসহ কেড়ে নিয়েছে প্রায় ২০ হাজার মানুষের প্রাণ। আক্রান্ত হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ। বিশ্বের ২৫০ কোটি লোককে গৃহবন্ধী থাকতে বাধ্য করেছে ভাইরাসটি।
প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত ও অভিজ্ঞতার আলোকে এটি বলা যায়, করোনাভাইরাস নামক আরএএন ভাইরাস, যা কোল্ড ভাইরাস নামে পরিচিত, তা অত্যন্ত ছোঁয়াচে; এটি যেমন হাঁচি-কাশির মাধ্যমে মাইক্রোড্রপলেট আকারে ছড়ায়, তেমনি রোগীর ব্যবহার্য, পরিবেশে বিদ্যমান কাপড়, প্লাস্টিক, ধাতব ও অন্যান্য ফোমাইটের মাধ্যমেও ছড়িয়ে থাকে।
মাইক্রোড্রপলেট আকারে বাতাসে ভাসমান ভাইরাস প্রায় ৩-৪ ঘণ্টা জীবিত থাকলেও ধাতব ও প্লাস্টিকসহ অন্যান্য ফোমাইটে আঠার মতো লেগে তা তিনদিন পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে। এ কারণে এটি প্রতিরোধে আমাদের দেশে বহুমুখী ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে আমরা চীনকে অনুসরণ করতে পারি।
চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম ভাইরাসটি সনাক্ত হয়। ধারণা করা হয় স্হানীয় সী ফুড শপ থেকে এটা ছড়ায়। প্রথমদিকে চীন সরকার বিষয়টিকে তেমন পাত্তা দেয়নি। মনে করেছিল নরমাল ফ্লু, হয়তো কিছুদিনের মধ্যে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছিল প্রকোপ বাড়তে থাকল এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে থাকল। ইতোমধ্যে ভাইরাসটি বেশ ছড়িয়ে পড়ল। স্হানীয় প্রশাসন কিন্তু আর দেরি করেনি। প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণ এবং তার প্রতিরোধ ও প্রতিকারের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নেয়।
উহান প্রশাসন প্রথম দিকে চেয়েছিল এই পরিস্থিতিকে নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণ করার। কিন্তু পরবর্তীতে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করার বিষয়টি তাদের আওতার বাইরে চলে যায়। তখন কেন্দ্রীয় সরকার হস্তক্ষেপ করে।। চীন সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে দেশটির মধ্যে করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়। চীন সরকার অর্থাৎ কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে উহান প্রশাসনের উপর বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা চীনের এ পদক্ষেপগুলোর ভুয়সী প্রশংসা করেছে। কারণ প্রথমদিকে কাজটি খুব চ্যালেন্জিং ছিল।
আজ মূলতঃ আমরা চীনের নেয়া পদক্ষেপগুলো নিয়ে এখানে আলোচনা করব এবং সেগুলো আমাদের দেশে প্রয়োগ করা যায় কিনা ভেবে দেখবো।
১. কান্ট্রি লকডাউন: করোনাভাইরাসটি যেহেতু মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ছিল তাই চীন সরকার সর্বপ্রথম যে কাজটি করল সেটা হলো কান্ট্রি লকডাউন করল। চায়নার জনসংখ্যা প্রায় ১৫০ কোটি। এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা না যায় করোনা মোকাবিলা করা কঠিন হবে । দ্রুত প্রত্যন্ত এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল।জরুরি কোনও প্রয়োজন ছাড়া লোকজন বাড়ির বাইরে যেতে পারত না। গণজমায়েত, চলাচল, গণপরিবহন, ট্রেন, মেট্রো, আন্ত:শহর পরিবহন চলাচল সীমিত করল। সে সময় এ কাজটি করা খুব কঠিন ছিল। কারণ সেসময় দেশটিতে ছিল নববর্ষের ছুটির সময়। আর নববর্ষের এই উত্সবটা হলো চায়নাদের সবচেয়ে বড় উৎসব। প্রচুর লোকজন বাড়িতে ফেরার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। সরকারের এই সিদ্ধান্তের কারণে মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ হলো। এক কথায় জনগনকে হোম কোয়ারেন্টাইন করতে বাধ্য করল। বিদেশ ফেরত জনগনকে ১৪ দিনের আইশোলেশন এ রাখল।
২.ভাইরাস সনাক্তকরণ: দ্বিতীয় যে কাজটি চায়নীজরা করল সেটা হলো দ্রুত ভাইরাসটির স্বরুপ নির্ণয় করা। চায়নীজ বিজ্ঞানীরা একাজে বেশ দক্ষতার ছাপ রাখে। তারা ভাইরাসটির জেনেটিক গঠনসহ কোন গ্রুপের ভাইরাস সেটা নির্ণয় করল। এতে করোনা ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করা অনেকদূর এগিয়ে গেল।
৩. বিশেষায়িত চিকিৎসার ব্যবস্থা: ভাইরাসটি সনাক্তের আগেই প্রায় ৭০ হাজার লোক আক্রান্ত হলো। আমরা জানি চায়নার চিকিত্সা ব্যবস্হা অত্যাধুনিক এবং প্রত্যেক নাগরিকের চিকিত্সা বীমা রয়েছে। কিন্তু এ অবস্হায় সকলকে চিকিত্সা সেবা দেওয় যাচ্ছিল না। তাই দ্রুত ১০ দিনের মধ্যে ১০০০ শয্যার ২ টি বিশেষায়িত হাসপাতাল তৈরি করল। ইতোমধ্যে ১০ টি স্টেডিয়ামকে অস্হায়ী হাসপাতাল হিসেবে তৈরি করল। ফলে সবাইকে চিকিত্সা সেবার আওতায় আনা সহজ হলো।এমন কি তারা চিকিৎসার কাজে রোবটকে ও কাজে লাগিয়েছে।
৪. স্পেশাল মেডিকেল টিম গঠন: চায়না সরকার উহানের করোনা ভাইরাস মোকাবেলার জন্য অন্যান্য প্রদেশ থেকে দক্ষ চিকিৎসক ও নার্সদের নিয়ে বিশেষ মেডিকেল টিম। গঠন করল এবং তাদেরকে উহানে পাঠাল। ফলে রোগীর সংখ্যা বেশি হলে ও চিকিৎসার কাজটি সহজ হয়ে গেল।
৫. রোগী বাছাই: যেহেতু প্রচুর আক্রান্ত রোগী ছিল এবং সকলকে সমানভাবে চিকিত্সা দেওয়া যাচ্ছিল না। তাই সেসব রোগীদের চিকিত্সা দেওয়া হয় যাদের জন্য একান্ত জরুরি ছিল তাদের হসপিটালাইজ করল আর বাকীদের বাসায় চিকিত্সা সেবার ব্যবস্থা করা হলো। আর যাদের করোনা আক্রান্ত মনে হচ্ছিল তাদের দ্রুত টেস্ট করার ব্যবস্থা করা হলো। ফলে আক্রান্তদের বাছাই করা সহজ হয়ে গেল।
৬. ডিজিটাল মনিটরিং ও টেলিমেডিসিন: এদিকে যাদেরকে কোয়ারেন্টাইন করা হলো তাদের প্রত্যেকেই স্বাস্থ্য তথ্য নিয়মিত কর্তৃপক্ষকে জানাতে হতো। এক্ষেত্রে তারা মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে তথ্য সরবরাহ করত। প্রয়োজনীয় পরামর্শ মোবাইলের মাধ্যমে সকলকে জানিয়ে দেয়া হতো। এমনকি আমরা যারা ঐ সময় চায়নাতে ছিলাম না আমাদেরকে ও নিয়মিত স্বাস্হ্য তথ্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানাতে হতো।
৭. ফুড সাপ্লাই: যেহেতু মার্কেট , শপিংমলসমুহ বন্ধ ছিল তাই নির্দিষ্ট কিছু আউটলেট থেকে খাদ্য সংগ্রহ করতে হতো। স্থানীয় প্রশাসন ও স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছানোর ব্যবস্থা ছিল।
আতঙ্ক ও অজ্ঞতা পরিহার করে এ মহাদুর্যোগের নানামুখী আঘাত, জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি এবং আর্থিক দুর্যোগ বিবেচনায় এনে তা মোকাবিলায় সব শক্তি ও মেধা প্রয়োগ করতে হবে। আসুন চীনের উহানে নেয়া পদক্ষেপগুলো আমরা অনুসরণ করি।
লেখক একজন সিনিয়র এক্সামিনার (ফুড এন্ড ব্যাক্ট:) বিএসটিআই ও পিএইচডি গবেষক। তিনি চীনের শেনডং ইউনিভার্সিটির ডিএনএ রিকম্বিনারিং এন্ড জিনোম ইন্জিয়ারিং রিসার্চ টিমের সদস্য।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।