জয়পুরহাট প্রতিনিধি: প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় যখন রাজধানী ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য জেলা হিমশিম খাচ্ছে তখন ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে উত্তরবঙ্গের ছোট্ট জেলা জয়পুরহাট।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যানুযায়ী, জেলার পাঁচ উপজেলায় ১৩ মে পর্যন্ত ৩ হাজার ৬৮৫ জন সন্দেহভাজন ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করে দেশের বিভিন্ন পিসিআর ল্যাবে ৩ হাজার ১৪৬ টি নমুনা পরীক্ষা করে ৮৬ জনের দেহে করোনাভাইরাস (কোভিট-১৯) শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২৯ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘টেষ্ট, টেষ্ট এন্ড টেষ্ট’ নীতিমালা বাস্তবায়নের ফলে এই জেলায় করোনা রোগী দ্রুত শনাক্ত হয়েছে এবং মানসম্মত সেবার কারণে সুস্থতার হারও অন্যান্য জেলার তুলনায় বেশি।
এখানে জেলা আধুনিক হাসপাতাল ও চারটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে করোনা চিকিৎসার বাইরে রেখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক নবনির্মিত ইন্সটিটিউট অব হেলথ টেকনোলজি ক্যাম্পাসে একটি আইসোলেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেখানেই দেওয়া হচ্ছে করোনা রোগীদের চিকিৎসা।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ, জনপ্রশাসন ও সমাজসেবীদের যৌথ উদ্যোগে এই আইসোলেশন সেন্টারটি পরিচালিত হচ্ছে।সেন্টারটি জেলা শহর থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরে আক্কেলপুর উপজেলার গোপীনাথপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। পালাক্রমে আটজন চিকিৎসক রোগীদের সার্বক্ষণিক চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন।
ভেন্টিলেশন, আইসিইউ বা আধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি ছাড়াই কেবলমাত্র আটজন চিকিৎসক, কয়েকজন নার্স, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা কর্মী, কিছু অক্সিমিটার, অক্সিজেন সিলিন্ডার ও একান্ত প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে চলা এই আইসোলেশনে সেন্টারে ৮৪ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন এবং তাদের মধ্যে ২৯ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। আরও কয়েকজন ৩য় স্যাম্পলের টেস্টের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছেন। সুস্থ হওয়ার দিক থেকেও এই ছোট উদ্যোগ শতকরা হারে দেশে সর্বোচ্চ।
করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় এই জেলার সফলতার পেছনের কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল সিভিল সার্জন ডা. মো. সেলিম মিয়ার কাছে।
তিনি জুমবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্যান্য জেলা থেকে এই জেলার করোনা মোকাবিলা পদ্ধতি শুরু থেকে ছিল একেবারেই ভিন্ন। দেশের বাইরে এবং অন্য এলাকা থেকে এই জেলায় যারা ঢুকেছেন তাদের তালিকা করে কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা হয়েছিল। যাদের করোনা উপসর্গ দেখা গিয়েছিল তাদের নমুনা প্রদানের জন্য কোথাও গিয়ে লাইন ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়নি। বরং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে প্রতি ইউনিয়নে ৪-৫টি করে ‘কালেকশন বুথ’ স্থাপন করে নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে।’
ডা. সেলিম মিয়া আরও বলেন, ‘দ্রুত টেস্ট করার কারণে যাদের সামান্য উপসর্গ থাকা অবস্থায় করোনা পজেটিভ এসেছে তাদের আইসোলেশন সেন্টারে এনে মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা হয়েছে এবং হচ্ছে।’
তিনি জানান, আইসোলেশন সেন্টারে প্রথাগত চিকিৎসার পাশাপাশি গরম পানির ভাপ নেওয়া, আদা-লবঙ্গ দিয়ে গরম পানি পান করানো, ওয়াইফাই সংযোগ দিয়ে বহিরাঙ্গণের সঙ্গে যোগাযোগ ও বিনোদনসহ নানাভাবে করোনা রোগীদের মানসিক শক্তি যোগানো হচ্ছে। ফলে করোনা রোগীরা দ্রুত সুস্থ হচ্ছেন।’
ডা. সেলিম বলেন, ‘করোনার সংক্রমণ রোধে জাতীয় সংসদের মাননীয় হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের নেতৃত্বে এলাকা ভিত্তিক নমুনা সংগ্রহ বুথ স্থাপন এবং জেলা ও উপজেলার চিকিৎসা কেন্দগুলিকে করোনা ঝুঁকির বাইরে রেখে সম্পূর্ণ আলাদা স্থানে স্বতন্ত্র আইসোলেশন সেন্টারে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে আমরা একটা মডেল দাঁড় করেছি।’
এই মডেল অন্যান্য জেলাতেও অনুসরণ করা যেতে পারে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এই মডেল চালু করতে পারলে স্বাস্থ্য কর্মীদের ঝুঁকির মাত্রা ৮০ ভাগ কমে আসবে এবং ক্রাইসিসে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য জনবল সঙ্কট হবে না।’

হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন সার্বক্ষণিকভাবে আইসোলেশন সেন্টারটির সবকিছু পর্যবেক্ষণ করার পাশাপাশি সেন্টারটির সিংহভাগ ব্যয়ভার তিনি নিজস্ব তহবিল থেকে যোগান দিচ্ছেন বলেও জানান এই সিভিল সার্জন।
হুইপ স্বপন জুমবাংলাকে জানান, দেশের অপরাপর হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসা প্রদানের ক্ষেত্রে যেসব অসুবিধা বা ঘাটতি মিডিয়ায় প্রচারিত হচ্ছে, তাৎক্ষণিক সেসব সমস্যা এই কেন্দ্রে হচ্ছে কি না সে সম্পর্কে ডাক্তার ও রোগীদের নিকট থেকে একাধিক সোর্সে খবর নিয়ে তা সমাধান করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, করোনার সংক্রমণ মোকাবিলায় জেলা শহরের সন্নিকটে টিটিসিতে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারান্টাইন সেন্টার পরিচালিত হচ্ছে এবং কালাই সরকারী মহিলা কলেজ ও পাঁচবিবি মহিলা কলেজকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারান্টাইনের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
জেলায় হোম কোয়ারান্টাইন না মানা সন্দেহজনক শতাধিক ব্যক্তিকে ইতোমধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারান্টাইনে রেখে তাদের টেস্ট করানো হয়েছে বলে জানান তিনি।।
হুইপ স্বপন বলেন, ‘এই জেলায় কর্মরত ৯৪ জন ডাক্তারের মধ্যে মাত্র আটজন ডাক্তার আইসোলেশন সেন্টারে সরাসরি করোনা পজিটিভ রোগীর স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করছেন এবং সর্বোচ্চ ১০ জন ডাক্তার স্যাম্পল কালেকশনে ঝুঁকি বহন করছেন। জেলার ১৯ শতাংশ ডাক্তার ব্যতিত বাকি ৮১ শতাংশ ডাক্তারকে করোনা রোগী হ্যান্ডেল করতে হচ্ছে না। ফলে তাদের ঝুঁকির মাত্রাও কম। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে শুধুমাত্র সমস্যার গভীরে প্রবেশ, সমন্বয় ও টিমওয়ার্ক। এখানে রাজনীতিবিদ, সিভিল প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ ও স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বিত টিম ওয়ার্ক হচ্ছে।’
এদিকে, করোনা চিকিৎসার পাশাপাশি জেলার সকল সরকারি হাসপাতালে স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। ইতোমধ্যে জেলার ৩২টি ইউনিয়নের মধ্যে ২৪ টি ইউনিয়নে সরকারি ডাক্তারগণের উপস্থিতিতে হেলথ ক্যাম্প করে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে জেলার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক সহ প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনবহুল স্থানগুলোতে ব্লিচিং পাউডার মিশ্রিত পানি ছিটানো হয়েছে। স্বতন্ত্র আইসোলেশন সেন্টার স্থাপন করায় জেলার সকল হাসপাতাল এবং ডাক্তার ও স্বাস্থ্য কর্মীর ঝুঁকির মাত্রা অনেক কমে এসেছে।
পার্শ্ববর্তী জেলা বগুড়ায় মোহম্মদ আলী হাসপাতাল একটি প্রতিষ্ঠিত হাসপাতাল হওয়ায় সেখানে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কোনও চ্যালেঞ্জ পোহাতে হয়নি। কিন্তু জয়পুরহাট জেলায় সেরকম হাসপাতাল না থাকায় করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বলে জানান চিকিৎসকরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।