রাষ্ট্র ও সমাজকে প্রথম শিক্ষকদের মর্যাদা দিতে হবে, তবেই শিক্ষার্থীরা দেবে!
যখন ভিডিওতে দেখলাম, রাজশাহীতে পলিটেকনিক কলেজের অধ্যক্ষকে ছাত্রলীগ নেতারা টেনেহিঁচড়ে পুকুরে ফেলে দিয়েছে, আমার শিক্ষক সত্ত্বা যেন কেঁপে উঠলো। ভাবছিলাম, কি নষ্ট সমাজে বসবাস করছি আমরা? এতটা আস্কারা কোথা হতে আসে??
আমরা যখন কলেজে পড়েছি, অধ্যক্ষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস আমাদের হতোনা, আজ অধ্যক্ষকে পানিতে ফেলে দেয় তাঁর কলেজের ছাত্ররা? কোথা হতে আসে এই দাম্ভিকতা?? এতটা নিশ্চয়তা?? এতটা অভদ্রতা? এতটা নিষ্ঠুরতা? কিভাবে সম্ভব??
এসবের উত্তর খুঁজতে একটু পেছনে যেতে হবে আমাদের| একজন এমপি যখন শিক্ষককে কান ধরে উঠ বস করান, সারাদেশ যখন এর প্রতিবাদ করছিল, তখন কি রাষ্ট্র কোন ব্যবস্থা নিয়েছিল?
ইংল্যান্ড -আমেরিকায় প্রাথমিক শিক্ষকদের সামাজিকভাবে অনেক সম্মানের দৃষ্টিতে দেখা হয়, অনেক…. এবং একইসাথে বেতন কাঠামোও ভালো, কারণ তারা বিশ্বাস করে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষকরাই মূলত মানব জীবনের মূল ভিত্তি গড়ে দেয় শিশু বয়সে।
শিক্ষার্থীরা প্রতি বছর ক্লাস শেষে শিক্ষককে একটা গিফট দেয়, সাথে একটি Thank you কার্ড যেখানে একজন শিশু ও অভিভাবক জানায়, তারা পুরো পরিবার আসলে ওই শিক্ষকের কাছে কতটা কৃতজ্ঞ গত একবছরে ওকে যা শেখানো হয়েছে তার জন্য !
আমি এখানকার সরকারি স্কুলের অভিজ্ঞতা হতে কথা বলছি, কোনো প্রাইভেট স্কুল নয়। এইরকম আরো অনেক অভিজ্ঞতা আছে… সে না হয় আরেকদিন বলা যাবে। এই যখন অন্যদেশের শিক্ষকদের মর্যাদা, তখন দেখি আমাদের হাল হকিকত!
কিছুদিন আগে একটি সংবাদ দেখেছিলাম, পোস্টও দিয়েছিলাম এই বিষয়ে… রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের শিক্ষক রাশিদুল ইসলাম দম্পতি বখাটে দ্বারা লাঞ্ছিত হয়েছেন|
একজন শিক্ষক অত্যাচারিত হবে তাঁর সহধর্মিণীর প্রতি অশালীন আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায়? জানতে চাই, অপরাধীদের কি কোনো বিচার হয়েছে? আইন শৃংখলা বাহিনী’র ভূমিকা কি ছিল? রাষ্ট্র কি ব্যবস্থা নিয়েছে অপরাধীদের বিরুদ্ধে? আমরা কি প্রতিবাদ করেছি?
এই তো কদিন আগে গণমাধ্যমে দেখলাম, গ্রেড পরিবর্তন ও বেতন বৃদ্ধির দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শিক্ষকদের পূর্বঘোষিত সমাবেশে বাধা দেয় পুলিশ এবং বাধা পেয়ে শিক্ষকরা শহীদ মিনারের সামনে থেকে সরে গিয়ে পাশেই অবস্থান নিলে সেখানেও পুলিশের লাঠিচার্জে ১০ জন আহত হন বলে শিক্ষক নেতারা দাবি করেছেন । তখনও আমরা চুপ করে থাকি!
শিক্ষক সমাজকে রাষ্ট্র আঘাত করবে, ছাত্ররা তাহলে কি শিখবে? উন্নত দেশগুলোতে যখন সমগ্র জনসমষ্টিকে শিক্ষিত করে তোলার পেছনে এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবদানকেই সবচেয়ে বেশি স্বীকৃতি দেয়া হয়, তখন অবাক হয়ে দেখি, আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষকদের দাবী জানাতে এলে পুলিশ লাঠি চার্জ করে!
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কিংবা কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের তুলনায় প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন কাঠামো সত্যিই কম, এই বিষয়ে তাদের দাবি যৌক্তিক। যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন করলে পুলিশ কেন লাঠি চার্জ করবে? আন্দোলন করা, দাবি পেশ করা কি অন্যায় না নাগরিক অধিকার?
সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে একজন শিক্ষকের যে সম্মান ও মর্যাদা দেয়া উচিত তাই কি দেয়া হয়? একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার কাছে একজন শিক্ষকের কোনো দাম আছে এই সমাজে?
একজন শিক্ষককে দেখে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা উঠে সালাম দেন অন্তত সম্মান জানানোর উদ্দেশে? শিক্ষক তিনি যে পর্যায়েরই হউক, তিনি একজন শিক্ষক, সেই শিক্ষা যেদিন হতে আমাদের কাছ থেকে সরে গেলো, সেদিন হতেই আজকের পর্যায়ে পৌঁছার পথ পরিষ্কার হতে শুরু হয়েছিল!
জানি, অনেকেই বলবেন যে দেশে শিক্ষক ধর্ষণ করে, যে দেশে শিক্ষক কোটি টাকা চাঁদা দেয়, যে দেশে শিক্ষক নুসরাতের মতো মেয়েদের পুড়িয়ে মেরে ফেলে, সেই দেশে শিক্ষকের মান-মর্যাদা এইরকমই হবে। কিন্তু লাখো লাখো শিক্ষকের ভিড়ে এই ঘটনা গুলো ঘটেছে বলে সমগ্র শিক্ষক সমাজকে আমরা নত করতে পারিনা। মনে রাখতে হবে, শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো এবং তাদের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক মর্যাদা বাড়াতে পারলেই শিক্ষার মূল উন্নয়ন ঘটবে, এটাই মূল চাবিকাঠি।আমরা প্রাথমিক শিক্ষা এবং শিক্ষকদের অবহেলা করে খুব বেশিদূর আগাতে পারবো না, এমন শিক্ষার্থীই উৎপাদন হবে যারা শিক্ষককে পুকুরে কেবল না আগুনেও ফেলে দিতে কুন্ঠা বোধ করবে না।
শেষ কথা একটাই, রাষ্ট্র ও সমাজকেই সম্মান জানাতে হবে শিক্ষকদের, তবেই শিক্ষার্থীরা সম্মান জানাবে!
ফেসবুক স্ট্যাটাস
লেখক: রাশেদা রওনক খান
শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।