প্রাকৃতিক চারটি বল হলো বিদ্যুৎচুম্বকীয় বল, শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল, দুর্বল নিউক্লিয়ার বল এবং মহাকর্ষ। প্রথম তিনটিকে ব্যাখ্যা করা হয় কণাপদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেল দিয়ে। এ ত্রয়ী বলকে বলা হয় নন-গ্র্যাভিটেশনাল ফোর্স বা অমহাকর্ষীয় বল। আর শেষেরটি—মহাকর্ষ বা গ্র্যাভিটিকে ব্যাখ্যা করে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব।
আরও সঠিকভাবে বললে, সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব। বিদ্যুৎ-চুম্বকীয়, শক্তিশালী ও দুর্বল নিউক্লিয়ার বল ব্যাখ্যা করে পরমাণুর মতো অতিক্ষুদ্র জগৎ। অন্যদিকে মহাবিশ্বের বড় পরিসরের কাঠামো (যেমন গ্রহ, নক্ষত্র, কৃষ্ণগহ্বর ইত্যাদি) ব্যাখ্যা করে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব।
স্ট্যান্ডার্ড মডেলে তিনটি বলের ব্যাখ্যায় বলা হয়, এসব বলে বলবাহী অতিপারমাণবিক কণা বিনিময় হয়। বস্তুকণাদের একত্রিত রাখার পেছনে কাজ করে প্রকৃতির তিনটি মৌলিক বল। এরকম ব্যাখ্যায় স্ট্যান্ডার্ড মডেল এখন পর্যন্ত দারুণ সফল একটি তত্ত্ব। যেমন বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের কথা ধরা যাক। এই বলটি পরমাণুকে একত্রে ধরে রাখে। অর্থাৎ নিউক্লিয়াস ও ইলেকট্রনকে। এর বাহক বা বলবাহী কণার নাম ফোটন। অর্থাৎ আলোর কণা।
অন্যদিকে সবল বা শক্তিশালী পারমাণবিক বল নিউক্লিয়াসে দুটি কণার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া করে গ্লুয়ন কণার মাধ্যমে। এভাবে কোয়ার্ক কণাদের একসঙ্গে জুড়ে রাখে, একত্রে বেঁধে রাখে পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে। সেইসঙ্গে নিউক্লিয়ার ফিশন বা পারমাণবিক বিভাজন এবং পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণে বেরিয়ে আসা বিপুল শক্তির জন্য দায়ী এ বল।
দুর্বল পারমাণবিক বল দুটি কণার মধ্যে মিথস্ক্রিয়া করে ডব্লিউ প্লাস, ডব্লিউ মাইনাস এবং জেড জিরো (W+, W–, Z0) বলাবাহী কণার মিথস্ক্রিয়ায়। শক্তিশালী বলের মতো এটাও কাজ করে শুধু অতিপারমাণবিক (আসলে উপপারমাণবিক) পরিসরে। দুর্বল বলই একমাত্র বল, যা সব কণার ওপর কাজ করে। এমনকি চার্জ নিরপেক্ষ নিউট্রনও এ বল অনুভব করে। তবে বলটি কণাদের একত্রে বেঁধে রাখার বদলে অন্য কাজ করে। সেটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এটি কোয়ার্কের পরিচয় পাল্টে দেয়। যেমন রেডিওঅ্যাকটিভ বা তেজস্ক্রিয় বিটা ক্ষয় প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াসের ভেতর নিউট্রন চেহারা পাল্টে পরিণত হয় প্রোটন কণায়।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে, চতুর্থ বল মহাকর্ষকেও কি এভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব? দুটি বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষ ছড়ায় কীভাবে? এরও কি কোনো বলবাহী কণা আছে?
সে উত্তর দেওয়ার আগে বলে নিই, চরিত্রগত দিক দিয়ে মহাকর্ষ আসলে অন্য তিনটি বলের চেয়ে আলাদা। প্রথমত অন্য তিনটির তুলনায় মহাকর্ষ বহু গুণ দুর্বল। বিজ্ঞানীদের হিসেবে, বলটি শক্তিশালী পারমাণবিক বলের চেয়ে ১০৩৮ ভাগ দুর্বল। বিদ্যুৎ-চুম্বকীয় বলের তুলনায় ১০৩৬ ভাগ এবং দুর্বল পারমাণবিক বলের তুলনায় ১০২৯ ভাগ দুর্বল। তবু প্রকৃতির চারটি মৌলিক বলের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বল এই মহাকর্ষ।
কারণ এই বল না থাকলে আজকের পরিচিত মহাবিশ্বের একান্নবর্তী সংসার গড়ে উঠতে পারত না কোনোদিন। মহাকর্ষ না থাকলে গোটা মহাবিশ্বে কোনো গ্রহ, নক্ষত্র বা ছায়াপথ থাকত না। স্রেফ কালিমাখা গাঢ় কালো এক অন্ধকার মহাবিশ্ব গড়ে উঠত। মহাবিশ্বে তখন রাজত্ব করত ধুলিকণা আর গ্যাস। আর কিছু নয়।
পদার্থবিজ্ঞানীদের ধারণা, অন্য বলগুলোর মতো মহাকর্ষের জন্যও একই ধরনের ব্যাখ্যা আছে। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের তালিকায় মহাকর্ষকে জায়গা দিতে নানারকম জল্পনা-কল্পনা করেছেন বিজ্ঞানীরা। সেটি করতে হলে মহাকর্ষের বলবাহী কণার (সহজভাবে বলা যায়, মহাকর্ষ কণা) চরিত্র কেমন হবে, তাও বোঝার চেষ্টা করেছেন।
গ্র্যাভিটনের স্পিন কেমন হবে, সেটাও হিসেব কষে বের করা সম্ভব। কোয়ান্টাম জগতে স্পিন স্থানের ঘূর্ণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এটি মৌলিক কণাদের একটা সহজাত ধর্ম। বস্তু বা পদার্থের গাঠনিক একক কোয়ার্ক ও লেপটনের স্পিন থাকে। এদের স্পিন ১/২। এর মানে হলো, এই কণাদের ৩৬০ ডিগ্রি ঘুরানোর পর তাদের আচরণ আর আগের মতো একই থাকে না। তবে ৭২০ ডিগ্রি ঘোরানোর পর আবারও একই আচরণ করে কণাগুলো।
অন্যদিকে স্ট্যান্ডার্ড মডেলের তিনটি বলের জন্য বলবাহী কণাদের স্পিন ১। মানে, এসব কণা ৩৬০ ডিগ্রি ঘোরালে তা একইরকম আচরণ করে। সেই হিসেবে গ্র্যাভিটনের স্পিন ২ হওয়া উচিত বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। কারণ যে কণার স্পিন ২, তারাই কেবল সব বস্তু বা পদার্থের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে। স্পিন ২-ধারী কণাদের ১৮০ ডিগ্রি ঘোরালেও তারা একই আচরণ করে।
অবশ্য কণাপদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পদার্থবিজ্ঞানীরা গ্র্যাভিটন বা মহাকর্ষ কণা বিনিময়ের প্রেক্ষিতে মহাকর্ষ বলের বর্ণনা করলেও, বাস্তবে এমন কিছু নাও থাকতে পারে। তবে বেশির ভাগ পদার্থবিদ মনে করেন, মহাকর্ষ কোয়ান্টাইজডও হতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো, অন্য বলগুলোকে যে গাণিতিক কৌশল ব্যবহার করে কোয়ান্টাইজড হিসেবে প্রমাণ করা হয়েছে, মহাকর্ষের ক্ষেত্রে তা ব্যর্থ হয়েছে।
সে কারণে মহাকর্ষের ক্ষেত্রে এখন একমাত্র আশা স্ট্রিং তত্ত্ব। এ তত্ত্বে মৌলিক কণাকে বিন্দুসম নয়, বরং ভর-শক্তির স্ট্রিং বা তারের ভিন্ন ভিন্ন কম্পন হিসেবে ব্যাখ্যা বা বর্ণনা করা হয়।গ্র্যাভিটন বলে যদি সত্যিই কিছু থেকে থাকে, তাহলে সেদিন তা ধরা পড়বে আমাদের হাতে। ব্যস! তাতেই হয়তো পদার্থবিজ্ঞানীদের বহুদিনের কাঙ্খিত কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি থিওরি বা থিওরি অব এভরিথিং একদিন এসে যাবে হাতের মুঠোয়
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।