জুমবাংলা ডেস্ক : বিদেশি কর্মী নেবে না মালয়েশিয়া– শেষ মুহূর্তে এরকম খবর আসায় অনেক কর্মী টাকা খরচ করেও যেতে পারেননি সে দেশে। ভিসা ও কাগজপত্র হলেও ফ্লাইটের টিকিট না পাওয়ায় যাওয়া হয়নি তাদের।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৬ হাজার ৯৭০ জন কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেননি। কর্মীপ্রতি ৫ লাখ টাকা হিসেবে ৮৪৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা আটকে আছে জনশক্তি রফতানিকারকদের কাছে। অর্থ ফেরতের জন্য দুই দফা সময় বেঁধে দেওয়া হলেও বেশিরভাগ কর্মী কোনও টাকা বুঝে পাননি। এ নিয়ে বাংলা ট্রিবিউনের করা প্রতিবেদন থেকে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-
মালয়েশিয়া সরকার গত বছরের ৩১ মে পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করে দেয় কর্মী নেওয়ার জন্য। সিদ্ধান্ত ছিল, ২০২৩ সালের ৩১ মার্চের পর নতুন করে আর কর্মীর চাহিদাপত্র ইস্যু করবে না তারা। এর আগে ইস্যু করা চাহিদাপত্রে ৩১ মে পর্যন্ত দেশটিতে প্রবেশ করা যাবে, এরপর আর বিদেশি কোনও কর্মী সে দেশে প্রবেশ করতে পারবেন না। তবে সেই সিদ্ধান্তের পর অনেকেই কাগজপত্র ঠিক থাকলেও শেষ মুহূর্তে প্লেনের টিকিটের ব্যবস্থা করতে পারেনি রিক্রুটিং এজেন্সি। যার ফলে অনেক কর্মীর মালয়েশিয়া যাওয়ার স্বপ্ন ভেস্তে যায়।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানায়, গত ৩১ মে পর্যন্ত জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪২ জনকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। এদের মধ্যে ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৬৭২ জন মালয়েশিয়া গেছেন। সেই হিসাবে প্রায় ১৬ হাজার ৯৭০ জন যেতে পারেননি। এসব কর্মীর সম্পূর্ণ অর্থ রিক্রুটিং এজেন্টদের পরিশোধ করার কথা ছিল।
জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) মাধ্যমে সেটি নিষ্পত্তি হওয়ার কথা থাকলেও তেমনটি এখনও হয়নি।
মালয়েশিয়ার ঘটনা তদন্তে কমিটির রিপোর্ট ‘অসম্পূর্ণ’
মালয়েশিয়ার ঘটনা তদন্তে ছয় সদস্যের কমিটি করা হয়। কমিটির প্রধান করা হয়েছিল তৎকালীন প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মসংস্থান অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব নূর মো. মাহবুবুল হককে। কমিটিকে কর্মীদের মালয়েশিয়া পাঠাতে ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি বিদেশে যেতে ইচ্ছুকদের হয়রানি বন্ধ এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয় নির্ধারণে সুপারিশ করতে বলা হয়েছিল। তবে কমিটি রিক্রুটিং এজেন্সির ওপর দায় চাপিয়ে একটি দায়সারা রিপোর্ট জমা দেয় বলে মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।
কমিটির রিপোর্টে সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয়ের অতিরিক্ত অর্থ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তবে কোন এজেন্সি কতো কর্মী পাঠাতে পারেনি তার ধারনা ছিল রিপোর্টে অস্পষ্ট। তদন্ত প্রতিবেদন তখনকার সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পর্যালোচনার জন্য পাঠানো হলে তারাও প্রতিবেদন ‘পূর্ণাঙ্গ নয়’ বলে জানায়। কারণ, যেতে না পারা কর্মীদের প্রকৃত সংখ্যা তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ কো হয়নি। এছাড়া তদন্তের সময়ে কমিটির কাছে কর্মীদের প্রায় ৪ হাজার অভিযোগ জমা পড়েছিল।
তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর সেই সময় দায়িত্বরত প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী জানিয়েছিলেন, ১৫ দিনের মধ্যে অর্থ ফেরত দেবে বায়রা। তা না হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গত ১৮ জুলাই ছিল অর্থ ফেরত দেওয়ার শেষ সময়। তবে এর মধ্যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়ে গেলে এই কাজে আর কোনও অগ্রগতি হয়নি।
টাকা দিয়ে দিশেহারা যেতে না পারা কর্মীরা
নীলফামারীর সুজন গত কয়েক মাস ধরে দালালকে খুজে বেড়াচ্ছেন। মালয়েশিয়ায় পাঠানোর কথা বলে ৪ লাখ টাকা নিয়েছিল দালাল। বাকি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা মালয়েশিয়া যাওয়ার পর দেওয়ার কথা ছিল। তবে সুজন ফ্লাইটের টিকিট আর হাতে পাননি। ৩১ মে পর্যন্ত ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবস্থান করে ফেরত চলে আসেন। এরপর থেকে টাকা উদ্ধারের জন্য দালালকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
সুজন জানান, সুদের বিনিময়ে ঋণ করে টাকাগুলো জোগাড় করেছিলেন। কিন্তু এখন সুদসহ ঋণ কীভাবে শোধ করবেন তা নিয়ে আছেন শঙ্কায়।
অন্যদিকে সাভারের দিদার মালয়েশিয়া যেতে ৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন দালালকে। মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর আরও ৫০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভিসা হলেও ফ্লাইটের টিকেট ব্যবস্থা করতে পারেননি। তাই তারও মালয়েশিয়া যাওয়া হয়নি। এখন টাকা ফেরত পেতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
আবার লাভলু খান নামে একজন অভিবাসন প্রত্যাশী জানান, দালাল টাকা নিয়েছে কিন্তু ফেরত দেয়নি। তারা বলছে, আবার নিয়ে যাবে মালয়েশিয়া।
পুরো অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে ধোঁয়াশা
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মালয়েশিয়া যেতে না পারা কর্মীদের অর্থ ফেরত পেতে কিছু জটিলতা তৈরি হয়েছে। এজেন্সি অর্থ ফেরতের আশ্বাস দিলেও পুরো অর্থ না পাওয়ার শঙ্কাই বেশি।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কর্মীরা বিদেশ যেতে দালালদের মাধ্যমে অনেকেই রিক্রুটিং এজেন্সির শরণাপন্ন হন। আবার কেউ কেউ সরাসরি দালালকে পুরো টাকা দেন। এক্ষেত্রে অর্থ বিনিময়ের কোনও প্রমাণ থাকে না। অর্থাৎ টাকা যে দেওয়া হয়েছে তার কোনও ডকুমেন্ট দেওয়ার প্র্যাকটিস নেই। এখন সরকার নির্ধারিত ফি হচ্ছে ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। কিন্তু বেশিরভাগই দিয়েছেন ৫ থেকে ৬ লাখ টাকা। তাহলে যদি ৬ লাখ টাকার ডকুমেন্ট বা প্রমাণ না থাকে তাহলে ওই ৭৮ হাজার টাকার বাইরে বাকি টাকা কর্মীরা কীভাবে পাবে।
নতুন করে সময় চেয়েছেন জনশক্তি ব্যবসায়ীরা
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সরকারের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ২৮ আগস্ট জনশক্তি রফতানিকারকদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে জনশক্তি ব্যবসায়ীরা আরও সময় চান অর্থ ফেরত দেওয়ার জন্য। তাদের অর্থ ফেরত দিতে ১০ দিনের সময় দেওয়া হয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, যেই এজেন্সির কাছে পাসপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে তারাই টাকা ফেরত দেবে।
তবে রিক্রুটিং এজেন্সিদের সংগঠন বায়রা’র অধিকাংশ নেতা এখন আছেন আত্মগোপনে। গত ৩ সেপ্টেম্বর পল্টন থানায় সাবেক মন্ত্রী ইমরান আহমদ, সাবেক সিনিয়র সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীনসহ ১০৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন এক জনশক্তি ব্যবসায়ী। মামলার বাকি আসামিরা সবাই জনশক্তি ব্যবসায়ী এবং মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে পরিচিত। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অর্থপাচার, অর্থ আত্মসাৎ ও মানবপাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, মামলায় অভিযুক্তরা একটি সংঘবদ্ধ মানবপাচার চক্র। তারা বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার প্রবাসী শ্রমিকদের বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাঠানোর জন্য সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট মাফিয়া চক্র গড়ে তোলে। তারা হাজার হাজার শ্রমিকের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ দেশ ও বিদেশে গড়ে তুলেছে।
মালয়েশিয়ার সিন্ডিকেট নিয়ে তদন্ত করছে দুদক
সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের স্ত্রী কাশমেরী কামাল, মেয়ে নাফিসা কামাল, ফেনী-২ থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারী, ফেনী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাসুদউদ্দিন চৌধুরী এবং ঢাকা-২০ আসনের সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদসহ তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চক্রের অন্যতম সদস্য হিসেবে রমরমা ব্যবসার অভিযোগে এ অনুসন্ধান শুরু করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুদকের উপ-পরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আকতারুল ইসলাম।
এই কর্মকর্তা জানান, মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠাতে সরকার-নির্ধারিত জনপ্রতি ব্যয় ৭৯ হাজার টাকা। কিন্তু মালয়েশিয়া যেতে গড়ে একজন বাংলাদেশি কর্মী খরচ করেছেন ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। দেড় বছরে সাড়ে ৪ লাখের মতো লোক পাঠিয়ে ২৪ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে এ খাতে। সরকার নির্ধারিত ফি-এর চেয়ে বেশি নেওয়া হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জনপ্রতি দেড় লাখ টাকা করে ‘চক্র ফি’ নেওয়া হয়েছে সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জনশক্তি ব্যবসায়ী এবং বায়রার ইসি কমিটির সদস্য জানান, কী পরিমাণ অর্থ ফেরত দেওয়া হয়েছে কিংবা কতজন টাকা পাবে সেই তথ্য জানা নেই। তিনি এই বিষয়ে বায়রার সভাপতির সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি। তবে বায়রার সভাপতিকে ফোন দেওয়া হলে ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
তবে অপর এক জনশক্তি ব্যবসায়ী জানান, কর্মীরা যেই টাকা দিয়েছেন তার পুরো অর্থ এজেন্সি দিতে পারবে কিনা এটা নিয়ে সংশয় আছে। কারও পুরো টাকা তো এজেন্সি পায় না, কিছু ক্ষেত্রে কয়েক হাত বদল হয়।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞ ও গবেষক ড. জালাল উদ্দিন শিকদার বলেন, কত টাকার দুর্নীতি হয়েছে এবং কারা নির্দিষ্টভাবে এইটার সঙ্গে যুক্ত, আমার মনে তদন্ত কমিটি গঠন করে তাদের চিহ্নিত করা উচিত। দুর্নীতির সঙ্গে যুক্তদের বিচারের আওতায় আনতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকে। কত টাকা এবং কারা এর সঙ্গে যুক্ত, এসব তথ্য বের করতে হবে। তবে কোনও নথি না থাকায় টাকা আদায় করা সহজ হবে না বলে মনে করি।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ও ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বলেন, মালয়েশিয়া ইস্যুতে সরকারের উচিত কারা টাকা পেয়েছে, কারা পায়নি এটার খোঁজ নেওয়া। যেসব এজেন্সি কর্মীদের টাকা ফেরত দেয়নি তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবে, সেটা মন্ত্রণালয়ের জানানো উচিত। আরেকটি বিষয় হলো, সরকারিভাবে মালয়েশিয়া যেতে যে খরচ, বাস্তবে পাঁচ থেকে ছয় গুণ টাকা বেশি নেওয়া হয়। এই টাকাগুলো অনেক জায়গায় পেমেন্ট হয়। তাই আমার মনে হয় একজন মানুষ পাওয়া যাবে না যে পুরো টাকা পাবে। ফলে প্রায় সবাই ক্ষতিগ্রস্ত।
তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত যতবার মালয়েশিয়ার বাজার খুলেছে বারবার এখানে সিন্ডিকেট করা হয়েছে। যার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমাদের কর্মীরা। এই সিন্ডিকেটের হোতা কারা তা তদন্ত করে বের করা হোক।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।