অনেক অনেক আগের কথা। এক দেশে ছিল ছোট্ট একটি মেয়ে। নাম তার ছিল গোল্ডিলকস। একদিন সকালবেলা বনের পথে হাঁটতে গেল ছোট্ট মেয়েটি। কিছুদূর হাঁটার পর বনের ভেতর একটি কুঁড়েঘর দেখতে পেল গোল্ডিলকস। কুঁড়েঘরের দরজায় ঠক ঠক করল সে, কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরও কেউ দরজা খুলল না। অগত্যা দরজাটি একটু ধাক্কা দিতেই খুলে গেল সেটি। কুঁড়েঘরে পা রাখল ছোট্ট গোল্ডিলকস।
ঘরে ঢুকতেই খাবারের সুগন্ধ নাকে এসে ধাক্কা মারল গোল্ডিলকসের। রান্নাঘরে একটি টেবিল দেখা গেল। তার ওপর তিন বাটি পরিজ রাখা। একটি বড় বাটি, একটি মাঝারি আর একটি ছোট। বাটিগুলোর পাশে আবার বড়, মাঝারি আর ছোট আকৃতির তিনটি চামচ রাখা।
বনে হাঁটতে হাঁটতে বেশ ক্ষুধা পেয়েছিল গোল্ডিলকসের। চোখের সামনে সুস্বাদু পরিজ দেখে জিবে পানি এসে গেল তার। বড় চামচটি দিয়ে প্রথম বাটি থেকে কিছুটা পরিজ মুখে দিল সে। কিন্তু সেটি ছিল খুবই গরম। মুখ পুড়ে গেল তার।
তাই মাঝারি চামচটি দিয়ে মাঝারি সাইজের দ্বিতীয় বাটি থেকে পরিজ তুলে মুখে দিল সে। ‘দূরছাই, একেবারে ঠান্ডা!’ বলে সেগুলো রেখে দিল গোল্ডিলকস। এবার তৃতীয় বাটি থেকে পরিজ মুখে তুলল সে। ‘ওয়াও! পরিজটা একেবারে মনের মতো। বেশি গরমও নয়, ঠান্ডাও নয়।’ খুশি মনে সবটুকু চেটেপুটে খেল ছোট্ট মেয়েটি।
পেট পুরে খেয়ে একটু ক্লান্ত লাগছিল গোল্ডিলকসের। একটু জিরিয়ে নেওয়ার কথা ভেবে বসার ঘরের দিকে এগোল। সেখানে তিনটি চেয়ার দেখতে পেল মেয়েটি। একটি বড়, একটি মাঝারি আর আরেকটি ছোট। প্রথম চেয়ারটিতে বিশ্রাম নিতে বসল সে। কিন্তু চেয়ারটি ছিল তার তুলনায় খুবই বড়। তাই দ্বিতীয় চেয়ারের দিকে এগোল গোল্ডিলকস। এই চেয়ার আগেরটির চেয়ে ছোট হলেও গোল্ডিলকসের জন্য সেটিও বেশ বড় আকৃতির। তাই সে এগোল তৃতীয় চেয়ারটির দিকে। এটি একেবারে ঠিকঠাক। বড় নয়, ছোটও নয়। তার বসার জন্যই যেন বানানো হয়েছে চেয়ারটি। কিন্তু একটু আয়েশ করে হেলান দিয়ে বসতে গিয়ে চেয়ারটি ঠাস করে ভেঙে গেল।
গোল্ডিলকসের আসলেই খুব ক্লান্ত লাগছিল। তাই সিঁড়ি বেয়ে ওপরের তলায় গেল সে। সেখানে তিনটি বিছানা দেখা গেল। প্রথমটি বড়, দ্বিতীয়টি মাঝারি আর তৃতীয়টি একেবারে ছোট। প্রথম বিছানায় গা এলিয়ে দিল গোল্ডিলকস। কিন্তু সেটি খুবই শক্ত মনে হলো তার কাছে। তাই সেখান থেকে উঠে দ্বিতীয় বিছানায় শুয়ে পড়ল সে। কিন্তু এটি আবার বেশি নরম বলে মনে হলো। তাই তৃতীয় বিছানার দিকে এগিয়ে গেল সে। সেটি গোল্ডিলকসের মনের মতো। ছোট নয়, বড়ও নয়। একেবারে তার মাপে যেন বানানো। সেখানে শুয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল গোল্ডিলকস।
কুঁড়েঘরটি ছিল আসলে তিন ভালুকের। বাবা ভালুক, মা ভালুক আর ছানা ভালুক। বাবা ভালুক বেশ বড়, মা ভালুকটি মাঝারি আর ছানা ভালুকটি একেবারেই ছোট, ঠিক গোল্ডিলকসের মতো। ওই সকালে নাশতা করার আগে তারাও বনের ভেতর হাঁটতে বেরিয়েছিল। কিছুক্ষণ হেঁটে বাড়ি ফিরে এল তারা। ঘরে পা দিয়েই তিন ভালুক টের পেল কেউ একজন তাদের কুঁড়েঘরে ঢুকেছে। রাগে গজরাতে গজরাতে বাবা ভালুক বলল, ‘দেখো, দেখো, কে যেন আমার পরিজ খেয়েছে।’
‘আমারটাও তো কিছুটা খেয়েছে,’ মা ভালুক বলল। ‘আমারও তো সব পরিজ খেয়ে ফেলেছে,’ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল ছানা ভালুক। রান্নাঘর থেকে বসার ঘরে আসতেই ভাঙা চেয়ারটি চোখে পড়ল তাদের। তারা আগন্তুককে খুঁজতে লাগল আঁতিপাঁতি করে। দোতলায় শোবার ঘরে আসতেই দেখল, তাদের বিছানাগুলো এলোমেলো। আর ছানা ভালুকের বিছানায় শুয়ে আছে ছোট্ট একটি মেয়ে।
ঠিক তখন ঘুম ভেঙে গেল গোল্ডিলকসের। চোখ খুলতেই তিন ভালুককে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে। আতঙ্কে জমে গেল মেয়েটি। কেউ কিছু বোঝার আগেই একলাফে সে বিছানা থেকে নেমে ঝেড়ে দৌড় দিয়ে নিচে নেমে এল। তারপর কোনোমতে দরজাটি খুলে বনের ভেতর দিয়ে নিজের বাড়িতে চলে গেল। এরপর আর কখনো বনের ভেতর ভালুকের কুঁড়েঘরে যায়নি গোল্ডিলকস।
এতক্ষণ যাঁরা ভ্রু কুঁচকে এটুকু পড়ে ভাবছেন, বিজ্ঞান ম্যাগাজিনে রূপকথা কেন, তাঁদের জন্য বলি, এটি রূপকথা হলেও আধুনিক বিজ্ঞানে এর প্রভাব বেশ লক্ষণীয়। উনিশ শতকে ব্রিটেনে ছোট্ট মেয়ে গোল্ডিলকসকে নিয়ে এ রূপকথার জন্ম। পরবর্তী সময়ে একই গল্পের তিনটি সংস্করণের সন্ধান পাওয়া যায়। গল্পটি একসময় এতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে তা নিয়ে অপেরা, নাটক, সিনেমাও তৈরি হয়েছে অসংখ্য।
তারই ধারাবাহিকতায় একসময় বিজ্ঞানে বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতির্জীববিজ্ঞান, এমনকি সাইকোলজি, জীববিজ্ঞান, অর্থনীতি ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও জায়গা করে নেয় ছোট্ট মেয়েটি। বর্তমানে সৌরজগতে তথা মহাবিশ্বের পৃথিবীর সুষম অবস্থান বোঝাতে কিংবা বহিঃসৌরজাগতিক গ্রহে প্রাণের সন্ধানে ‘গোল্ডিলকস জোন’ বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। সাধারণত কোনো নক্ষত্রের চারপাশে জীবন ধারণের উপযোগী বা বসবাসের উপযোগী এলাকা বোঝাতে শব্দটি ব্যবহার করা হয়।
আর এ ক্ষেত্রে আমাদের পৃথিবী হলো গোল্ডিলকস জোনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আসলে সৌরজগতে পৃথিবীর অবস্থান থেকে শুরু করে গ্রহটির সবকিছুই যেন বাড়াবাড়ি রকমের সুষম, যথাযথ। গোল্ডিলকসের চেখে দেখা পরিজের মতোই বেশি গরমও নয়, কনকনে ঠান্ডাও নয়, একবারে আরামদায়ক তাপমাত্রা। চেয়ার বা বিছানার মতো পৃথিবীর আকৃতি বেশি বড় নয়, ছোটও নয়, একেবারে যথাযথ আকৃতির।
বিজ্ঞানীরা বলেন, সূর্য থেকে পৃথিবীর অবস্থান গোল্ডিলকস জোনে। তরল পানিকে বলা হয় সর্বজনীন দ্রাবক। পানি ছাড়া আমাদের এক মুহূর্ত চলে না। তাই পানি ছাড়া পৃথিবীতে জীবনধারণও অসম্ভব। গবেষণায় দেখা গেছে, পৃথিবীতে জীবনের রসায়ন তৈরির জন্য গ্রহটি সূর্য থেকে একদম যথাযথ দূরত্বে অবস্থিত, বেশি নয়, কমও নয়। কথাটির সত্যতা বোঝা যাবে এই দূরত্বের সামান্যতম হেরফের হলে। সূর্য থেকে পৃথিবী যদি কিছুটা দূরে থাকত, তাহলে সব পানি জমাট বেঁধে পরিণত হতো মঙ্গল গ্রহের মতো বিশাল এক মরুভূমিতে।
সূর্য থেকে বেশ দূরে থাকার কারণে মঙ্গলের তাপমাত্রা বেশ কম। নিম্ন তাপমাত্রার কারণে মঙ্গলের রুক্ষ, অনুর্বর ভূমিতে পানি, এমনকি কার্বন ডাই–অক্সাইডও প্রায় জমাট বেঁধে কঠিন হয়ে গেছে। আবার মঙ্গল গ্রহের ওপরে শুধু নয়, মাটির নিচেও খুঁজে পাওয়া গেছে জমাটবাঁধা পানির স্থায়ী স্তর। সেটির পেছনেও কারণ হলো মাতৃনক্ষত্র বা সূর্য থেকে ওই দূরত্ব। আবার পৃথিবী যদি সূর্যের খুব কাছে হতো, তাহলে সেটা হয়তো অনেকটাই শুক্র গ্রহের মতো হয়ে যেত। আকৃতির দিক থেকে শুক্র গ্রহ প্রায় পৃথিবীর মতো হলেও তা গ্রিনহাউস প্ল্যানেট নামে পরিচিত। শুক্র গ্রহ সূর্যের অনেক কাছে থাকায় এবং এর বায়ুমণ্ডলের বেশির ভাগে কার্বন ডাই–অক্সাইড থাকায় গ্রহটি সূর্য থেকে পাওয়া শক্তি ধরে রাখে। ঠিক গ্রিনহাউসের মতো।
তাতে এর তাপমাত্রা ৪৭১ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে যায়। এ কারণে সৌরজগতের সবচেয়ে উত্তপ্ত গ্রহের তকমা জুটেছে শুক্রের কপালে। সেখানে কুকুর-বিড়াল বৃষ্টি হয়; পানির নয়, তরল সালফিউরিক অ্যাসিডের। বায়ুমণ্ডলের চাপ পৃথিবীর তুলনায় শতগুণ বেশি শুক্রে। আবার প্রচণ্ড তাপমাত্রার কারণে সৌরজগতের সম্ভবত সবচেয়ে নরকতুল্য গ্রহ এটি। এর প্রধানতম কারণ, গ্রহটি সূর্যের অনেক কাছে অবস্থিত। কাজেই এ রকম কোনো গ্রহে আমাদের চোখে পরিচিত প্রাণের কোনো অস্তিত্ব সম্ভব নয়।
কাজেই বোঝাই যাচ্ছে, পৃথিবীতে প্রাণের টিকে থাকার জন্য গোল্ডিলকস জোনের বেশ বড় ভূমিকা আছে। যেসব কাকতালীয় ঘটনা এখানে প্রাণের টিকে থাকা সম্ভব করে তুলেছে, সেগুলোও একাধিক। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সৌরজগতের একটি গোল্ডিলকস জোনে থাকার পাশাপাশি আরও কিছু গোল্ডিলকস জোনে রয়েছে পৃথিবী। যেমন পৃথিবীর কক্ষপথকে স্থিতিশীল রাখার জন্য আমাদের একমাত্র চাঁদের আকার একেবারে যথার্থ। মানে বেশি বড় নয়, বেশি ছোটও নয়। চাঁদ বড় হলে কবিদের জন্য কাব্যিকতা আরও বাড়ত কি না জানি না, কিন্তু পৃথিবীতে যে কোনো কবি থাকতেন না, সেটি নিঃসন্দেহে বলা যায়।
কম্পিউটার প্রোগ্রামে দেখা গেছে, বড় আকারের একটি চাঁদ বা পৃথিবীর তিন ভাগের এক ভাগ আকৃতির কোনো চাঁদের কারণে পৃথিবীর অক্ষরেখা হয়তো কয়েক মিলিয়ন বছরে ৯০ ডিগ্রি পর্যন্ত সরে যেতে পারত। বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস, ডিএনএর সৃষ্টির জন্য কয়েক শ মিলিয়ন বছর জলবায়ুর স্থিতিশীলতা প্রয়োজন। তাই পৃথিবীর অক্ষরেখা পর্যায়ক্রমে যদি সরে যেত, তাহলে তার আবহাওয়ায় বিপর্যয় নেমে আসত। তাতে জীবনের নীলনকশা ডিএনএর গঠন সম্ভব হতো না। আবার চাঁদ যদি এখনকার তুলনায় বেশ খানিকটা ছোট হতো, তাহলে কয়েক মিলিয়ন বছরে পৃথিবীর ঘূর্ণনে সামান্য অস্থিরতা ধীরে ধীরে জমে উঠত। তা জমতে জমতে একসময় তা বড় আকার ধারণ করত। ফলে পৃথিবী ভয়ানকভাবে টলমলে হয়ে যেত। তাতে তার জলবায়ুর পরিবর্তন হতো মারাত্মক। স্বাভাবিকভাবে এখানে জীবনধারণও হয়ে উঠত অসম্ভব।
সৌভাগ্যক্রমে পৃথিবীর কক্ষপথকে স্থিতিশীল করার জন্য আমাদের চাঁদের আকৃতি একদম যথাযথ বলা চলে। ছোট নয়, বড়ও নয়। তাই এই বিপর্যয় এখনো ঘটেনি। যেমন মঙ্গল গ্রহের চাঁদগুলোর আকৃতি তার ঘূর্ণন স্থিতিশীল করার পক্ষে যথেষ্ট বড় নয়। ফলে মঙ্গল গ্রহ ধীরে ধীরে অস্থিতিশীলতার পর্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। অতীতে মঙ্গল গ্রহ সম্ভবত তার অক্ষরেখার প্রায় ৪৫ ডিগ্রিতে ঘুরত বলে বিশ্বাস করেন জ্যোতির্বিদেরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।