সাগরবেষ্টিত সন্দ্বীপে নেই ভাল মানের কোনো সরকারি হাসপাতাল। নেই আইসিইউ শয্যা ও ভালোমানের কোনো ল্যাবও। করোনার নমুনা পরীক্ষা কিংবা গুরুতর অসুস্থ রোগীকে তাই উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়ে আনতে হয় চট্টগ্রামে। যার কারণে এই জনপদের চার লাখ বাসিন্দা প্রধানমন্ত্রীর কাছে চেয়েছিলেন একটি ওয়াটার অ্যাম্বুলেন্স। প্রধানমন্ত্রী একটির বদলে দেন দুটি। তবে কোটি টাকায় কেনা সেই দুটি অ্যাম্বুলেন্সের কোনোটিরই সুফল একদিনের জন্যও পায়নি দ্বীপের বাসিন্দারা।
১৩ বছর আগে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগকে দেওয়া সি অ্যাম্বুলেন্সটি কেনা হয়েছিল ৩২ লাখ টাকায়। কিন্তু একদিনের জন্যও সাগরে নামেনি এটি। পাঁচ বছর আগে উপজেলা প্রশাসনকে দেওয়া ৬৫ লাখ টাকা দামি সি অ্যাম্বুলেন্সটিরও সেবা পায়নি কোনো রোগী।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দুটি সি অ্যাম্বুলেন্সের একটিরও নেই উত্তাল সাগর পাড়ি দেওয়ার মতো ফিটনেস। হাওর অঞ্চলে চলার উপযোগী সি অ্যাম্বুলেন্স কিনে তা উত্তাল সাগর পাড়ি দিতে সন্দ্বীপ পাঠিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। দুটি সি অ্যাম্বুলেন্সের কোনোটির জন্যই নিয়োগ দেওয়া হয়নি চালক। বরাদ্দ দেওয়া হয়নি জ্বালানিও। অথচ সি অ্যাম্বুলেন্স কেনার নামে এভাবে সরকারি টাকা নয়ছয় করার খেসারত দিচ্ছে দ্বীপের চার লাখ সাধারণ মানুষ। গুরুতর অসুস্থ রোগীকে এখন চট্টগ্রামে চিকিৎসার জন্য নিতে হয় ট্রলারে কিংবা স্পিডবোটে করে। করোনার নমুনা নিতেও চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সবাইকে। প্রতিদিন উপজেলা থেকে নমুনা পাঠানোর কথা থাকলেও যাতায়াত সমস্যার কারণে এখন সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রামে নমুনা পাঠাতে হচ্ছে কয়েকদিন পর পর। এতে নমুনার গুণগত মান নষ্ট হওয়ার শঙ্কাও তৈরি হয়েছে সন্দ্বীপে। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. শেখ ফজলে রাব্বি বলেন, দ্বীপের চারপাশেই সাগর। ভৌগোলিক এ কারণে ইচ্ছা থাকলেও অনেকে ভালো চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন মতো আসতে পারে না চট্টগ্রামে। নিরাপদ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে তাই এ দ্বীপ উপজেলায় দুটি সি অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু লজিস্টিক অন্য সাপোর্ট না থাকায় এগুলো থেকে কোনো সেবা পাচ্ছে না দ্বীপের মানুষ।
সন্দ্বীপের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফজলুল করিম বলেন, চিকিৎসাসেবা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়ার ঘোষণা ছিল প্রধানমন্ত্রীর। এটিরই অংশ হিসেবে ১৩ বছর আগে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগকে একটি সি অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু একদিনের জন্যও সাগরে নামেনি এটি। কারণ অ্যাম্বুলেন্স দিলেও সেটি চালানোর জন্য চালক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। জ্বালানির জন্যও রাখা হয়নি কোনো বরাদ্দ।
চার বছর আগে উপজেলা প্রশাসনকে দেওয়া অ্যাম্বুলেন্সটিরও সেবা পায়নি কোনো রোগী। এটিরও নেই কোনো চালক। নেই জ্বালানির বরাদ্দ। উত্তাল সাগর পাড়ি দেওয়ার মতো ফিটনেসও নেই এসব সি আ্যাম্বুলেন্সের। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে কয়েক দফা পত্র দিয়েছি। কিন্তু সমস্যা সমাধান হয়নি। তাই গুরুতর অসুস্থ রোগীকে এখন চিকিৎসার জন্য ১৪ নটিক্যাল মাইল সাগর পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামে নিতে হয় ট্রলারে কিংবা স্পিডবোটে করে। আবহাওয়া খারাপ থাকলে তখন তা অসম্ভব হয়ে ওঠে।
স্থানীয় বাসিন্দা সাদমান সামি জানান, গত শনিবারও সন্দ্বীপে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত গোলাম সরোয়ার কচি নামের এক তরুণকে মধ্যরাতে চট্টগ্রাম আনতে হয়েছে লালবোটে করে। এর আগের সপ্তাহে হৃদরোগে আক্রান্ত দুই রোগীকে ট্রলারে করে চট্টগ্রামে আনতে হয়। আনতে দেরি হওয়ায় এ দু’জনের একজন মারা যান চমেক হাসপাতালে।
জানা যায়, যে দুটি সি অ্যাম্বুলেন্স দেওয়া হয়েছে সেগুলোর একটি পাঁচ বছর ধরে গুপ্তছড়া ঘাট সংলগ্ন ডাঙ্গায় পরিত্যক্ত পড়ে আছে। পাটাতনে লাল রং ও বডিতে সাদা রঙের প্রলেপ থাকা এই সি অ্যাম্বুলেন্সের এক পাশে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের’ সিল দেখা যাচ্ছে এখনও। ‘রেসকিউ ঈগল’ নামের এই সি অ্যাম্বুলেন্সটি ২০১৫ সালে সন্দ্বীপে পাঠায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। আনুমানিক ১০ থেকে ১২ ফুট দৈর্ঘ্যের এই সি আ্যাম্বুলেন্সটিতে আছে নির্মাণ ত্রুটিও। রোগীকে নেওয়া স্ট্রেচার সোজা করে রাখার ব্যবস্থাও নেই এতে। ওজনেও এটি অত্যন্ত হালকা। যে ইঞ্জিন দিয়ে এ ধরনের সি অ্যাম্বুলেন্স চলার কথা দেওয়া হয়নি সেটিও। তাই কেনার পর থেকেই জলের বদলে এটির ঠিকানা হয়েছে ডাঙ্গা।
আরেকটি সি অ্যাম্বুলেন্স পড়ে আছে হারামিয়ার ২০ শয্যা হাসপাতালের চত্বরে। এটি কেনার সময়ও নয়ছয় হয়েছে সরকারি অর্থ। এই সি অ্যাম্বুলেন্সটি ২০০৮ সালে সন্দ্বীপের জন্য পাঠায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু এটিরও কোনো চালক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বরাদ্দ রাখা হয়নি জ্বালানির জন্যও। স্থানীয়ভাবে টাকা সংগ্রহ করে এটি চালানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও ব্যর্থ হয়েছে সেটিও। নির্মাণ ত্রুটি আছে এই সি অ্যাম্বুলেন্সটিরও।
নির্মাণ ত্রুটি সম্পর্কে নৌ-বাণিজ্য অধিদপ্তরের সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন হাবিবুর রহমান বলেন, সন্দ্বীপ পরিদর্শনে গিয়ে সি অ্যাম্বুলেন্সগুলো পরিত্যক্ত থাকতে দেখেছি। আসলে সাগর অতিক্রম করতে সি অ্যাম্বুলেন্সের যে ধরনের সক্ষমতা দরকার এগুলোর সেটি নেই। এ ধরনের সি অ্যাম্বুলেন্স মূলত হাওর অঞ্চলে চলাচলের উপযোগী। যে দামে এগুলো কেনা হয়েছে সেটিও অনেক বাড়তি বলে মনে হয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।