জুমবাংলা ডেস্ক: ডান দিকের চোখে ঘন কালোকালশিটে দাগ। টকটকে ফরসা মুখটায় গোলাপি গাল আর লাল ঠোঁটের পাশে সেই প্রায় বুজে যাওয়া কালো চোখটা দেখতে একেবারে দগদগে লাগছে। বাম দিকের চোখ খোলা। কিন্তু নেই চোখের কোনো নড়াচড়া নেই। মুখের উপর টর্চের আলোর ঘেরাফেরাতেও পলক পড়ছে না। ‘বেঁচে আছে?’শোনা গেল পাশ থেকে।
বাইরে তখন তুষারপাত। তার মধ্যেই তুরস্কের এলবিস্তানের ধ্বংসস্তূপে চলছে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় উদ্ধারকাজ। ২৪ ঘণ্টা আগে এখানে প্রায় হুমড়ি খেয়ে মাটিতে আছড়ে পড়েছিল জোড়া বহুতল। সেখানেই চলছে প্রাণের খোঁজ, মৃত শরীরের খোঁজও। কালশিটে পড়া মুখটা দেখা গেল সেই বহুতলের দুইটি কংক্রিটের স্ল্যাবের ফাঁকে।
টর্চের আলো তখনো ঘেরাফেরা করছে তার উপর। এ বার বোধহয় একটু কাঁপল চোখটা। ‘বেঁচে আছে? ’প্রশ্নটা উড়ে এল আবার। সম্ভবত সেই আওয়াজেই আরো এক বার নড়াচড়ার চেষ্টা করল শরীরটা। টর্চধারী জবাবটা বুঝে নিলেন। ঝুঁকে পড়লেন মুখটার উপরে। ধীরে ধীরে কংক্রিটের ফাটল দিয়ে গলিয়ে দিলেন হাতটাকে।
সোমবার ভোরের ভূমিকম্প ঝাঁকিয়ে দিয়ে গিয়েছে তুরস্ক দেশটার দক্ষিণ ভাগ এবং সীমান্ত সংলগ্ন সিরিয়ার কিছু অংশকে। তার পর থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় লাফ দিয়ে দিয়ে বেড়েছে মৃতের সংখ্যা। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত পাওয়া হিসাব— তুরস্ক এবং সিরিয়ায় সোমবারের ভূমিকম্পে মারা গিয়েছেন পাঁচ হাজার মানুষ। চারপাশ থেকে বেরিয়ে আসছে একের পর এক মৃতদেহ। তবু তার পাশেই ধ্বংসস্তূপে জীবনের খোঁজ চলছে সমান্তারাল ভাবে।
সেভাবেই এলবিস্তানের বহুতলের নিচে খুঁজে পাওয়া গেল ১৪ বছরের এই কিশোরকে। তার বাবা-মা বা কোনো আত্মীয়েরই খোঁজ আপাতত পাওয়া যায়নি। জানা যায়নি নাম। কারণ কংক্রিটের আঘাতে গুরুতর জখম ঐ কিশোরের নিজের নাম বলার ক্ষমতাও নেই। তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছে উদ্ধারকারী দল। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত কেউ খোঁজও করেনি ঐ কিশোরের।
রাগাড় ইসমাইলের গল্পটা আবার আলাদা। সিরিয়ার ছোট্ট ফুটফুটে মেয়ে রাগাড়। এখনও কোল ছাড়েনি। ভূমিকম্পে তার মা এবং দুই বোন মারা গেছে। বাবাকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। তবে তার অবস্থা সঙ্কটজনক। কোমড় ভেঙে গিয়েছে। বেঁচে গেলে হয়তো বাকি জীবনটা পঙ্গু হয়েই কাটবে তার।
ইসমাইলকে পাওয়া যায় সিরিয়ার আজাজ শহরে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে তার ছোট্ট হাতটি নড়তে দেখেছিলেন উদ্ধারকারীরা। তবে একটুও আঘাত লাগেনি শরীরে। পুলিশের কোলে কুঁকড়ে থাকা ইসমাইলের ছবি ইতিমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে।
আপাতত ইসমাইল রয়েছে একটি শিবিরে। সেখানে তার দেখভাল করছেন তার এক কাকা। তিনি জানিয়েছেন, ইসমাইলের মা অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। মাস চারেক পরেই সন্তান হওয়ার কথা ছিল তার।
সিরিয়া এবং তুরস্ক জুড়ে এমনই একের পর এক ছবি ধরা পড়েছে গত দেড় দিনে। কান্নায় ভেঙে পড়া শিশু। রক্তাক্ত শিশু, হাসপাতালে নিথর শুয়ে থাকা শিশুও।
শরীরে কিছু ক্ষণ আগেও প্রাণ ছিল, ধ্বংসস্তূপ থেকে তুলে এনে অ্যাম্বুল্যান্সে তোলার পর মৃত্যু— এমন ঘটনাও ঘটতে দেখেছেন উদ্ধারকারীরা। নামিয়ে রাখতে হয়েছে স্ট্রেচার। সরিয়ে ফেলতে হয়েছে শরীর। সেখানে জায়গা পেয়েছেন অন্য কেউ।
দুঃস্বপ্নময় ঝাঁকুনি খেয়ে শুরু হয়েছিল যে সোমবার, তার রাতটা খোলা আকাশের নীচেই কাটিয়েছে তুরস্ক-সিরিয়ার একটা বড় অংশ। পদে পদে কেঁপে উঠেছে মাটি। আতঙ্কের জেরে ছাদ রয়েছে এমন কিছুর নীচে আশ্রয় নিতেই ভয় পেয়েছেন সাধারণ মানুষ। ফলে তুষারপাতের রাত কেটেছে বাইরেই। আগুন জ্বেলে রাস্তার ধার ঘেঁষে বসেছেন মানুষ। জমে যাওয়া শরীর আর বিভ্রান্ত মন নিয়ে আগুনের পাশে ভিড় জমিয়েছেন।
তুরস্কের গাজিয়ান টেপের বাসিন্দা গোকজে ৪০ ছোঁয়া এক যুবতী। জানিয়েছেন, ‘আমার সারা শরীরে ব্যথা। দুর্বল বোধ করছি। ক্রমাগত বৃষ্টি আর তুষারপাতে ভিজতে হচ্ছে। অথচ ছাদের নীচে আশ্রয় নেয়ার উপায় নেই। তবে অভিযোগ করব কী করে! আমার সামনে বহু বৃদ্ধ রোগীকে দেখছি একটিও গরম পোশাক ছাড়া, জুতো ছাড়া কষ্ট পাচ্ছেন।
আদানার নিলুফার আসলান আবার নিশ্চিত ছিলেন মৃত্যু আসন্ন। নিলুফার একটি বহুতলের পাঁচতলার বাসিন্দা। ভূমিকম্পের সময়ের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন তিনি। নিলুফার বলেছেন, ‘আমি আমার এত বছরের জীবনে এই প্রথম এমন হতে দেখলাম।’
নিলুফারের কথায়, ‘দোলনায় যেভাবে শিশুকে দোলানো হয়, সে ভাবে দুলছিল আমাদের বিল্ডিংটা। আমি আমার পরিবারের সবাইকে ডেকে তুলে ডাইনিং হলে চলে এসেছিলাম। বলেছিলাম, মরতে যখন হবেই তখন একসঙ্গেই মরি।’
দুলুনি থামলে বাইরে এসে নিলুফাররা দেখেন, তাদের ইমারতটিকে ঘিরে চারটি ইমারত নেমে এসেছে মাটিতে। কোনো এক অলৌকিক কারণে তাদের আবাসনটি তখনও দাঁড়িয়ে।
ভূমিকম্প পরবর্তী তুরস্ক-সিরিয়ায় এখন এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। চারপাশ থম মেরে রয়েছে। কোথাও কান্নার ফোঁপানির শব্দ। কোথাও হাড়কাঁপানো ঠান্ডার মধ্যেও নিথর হয়ে বসে রয়েছেন সার দেওয়া মানুষ। কোথাও সন্তানহারা মা পাগলের মতো ছুটে বেড়াচ্ছেন রাস্তা দিয়ে। কান্নায় বিকৃত মুখ। দুই চোখে অঝোরে ঝরছে জল।
সোমবারের ভূমিকম্পের পর সিরিয়া এবং তুরস্কের জন্য প্রার্থনা করেছে পুরো বিশ্ব। সত্যিই এই দুই দেশের জন্য প্রার্থনা দরকার। কিন্তু তার পাশাপাশি দরকার সাহায্য। ধ্বংসস্তূপে একের পর এক চাঙড় ভেঙে দেহ খুঁজছিলেন ইসমাইল আল আবদুল্লা। সিরিয়ার মানবতাবাদী সংগঠনের সদস্য তিনি। দুর্যোগে তারাও উদ্ধারকাজে হাত লাগিয়েছেন। ইসমাইলের কথায়, ‘আমাদের জন্য প্রার্থনা জরুরি। তবে তারও আগে দরকার সাহায্য। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বলব দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন।’
সূত্র: আনন্দবাজার
চোখের ধাঁধাা: ছবিতে লুকিয়ে আছে কুকুর, পারবেন খুঁজে বের করতে?
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।