আলোচনার কেন্দ্রে সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর। যার ৭৫ শতাংশই গায়েব। আছে মাত্র ২৫ শতাংশ। একসময় প্রচুর পরিমাণে সাদা পাথর দেখা যেত বলে জায়গাটার নামই হয়ে যায় ‘সাদা পাথর’। কিন্তু বর্তমানে পর্যটন কেন্দ্রটি অস্তিত্ব সংকটে।
মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) সাদা পাথর নামক ওই স্থানে সরেজমিন ঘুরে এমনই দৃশ্য দেখে প্রতিবেদন তৈরি করেছে বিবিসি বাংলা। স্বাভাবিক ভাবেই তাই প্রশ্ন উঠেছে, কোথায় গেল ভোলাগঞ্জের সাদা পাথর?
প্রতিবেদন বলছে, পর্যটন কেন্দ্র সাদা পাথরের অবস্থা ভয়াবহ। আজকে হয়তো লুটপাট নেই। কিন্তু পাথর যা নিয়ে গেছে তাতে পর্যটন কেন্দ্রটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পাথর বলতে কিছু নেই সেখানে।
স্থানীয় সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান বলছেন, আগের সঙ্গে তুলনা করলে ভোলাগঞ্জে সাদা পাথর নেই বললেই চলে। ৭৫ শতাংশ পাথর এখান থেকে তুলে নিয়ে গেছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। বাকি আছে ২৫ শতাংশ, যেটা বিজিবির ক্যাম্পের সঙ্গে লাগোয়া স্থানে।
প্রাকৃতিকভাবে পাহাড়ি ঢলের তোড়ে ধলাই নদের উৎসমুখে ভেসে আসা পাথরের বিশাল স্তুপের কারণে প্রায় পাঁচ একর জায়গা জুড়ে তৈরি ভোলাগঞ্জ পর্যটন স্পট হিসেবে গত কয়েক বছরে বেশ সাড়া ফেলেছিল।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদক পরিবেশবিদ কাসমির রেজার অভিযোগ, স্থানীয় প্রভাবশালীরা অবৈধভাবে সাদা পাথর তুলে নিয়ে যাচ্ছে। অথচ এক্ষেত্রে প্রশাসনের কার্যকর কোনো অভিযান দেখা যাচ্ছে না।
তিনি জানান, ভোলাগঞ্জ থেকে সাদা পাথর তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আদালতের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এমনকি লিজও দেওয়া হয়নি ওই স্থান। গত চার বছরে এখান থেকে পাথর উত্তোলন করা হয়নি, এখনতো প্রশাসনের কার্যকর অভিযানও দেখছি না।’
তবে সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদের দাবি, ‘প্রশাসনের পদক্ষেপ চলমান রয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই অভিযান চলছে। আইনি যত প্রক্রিয়া করা যায়, আমরা সবই করেছি। এখানে মোবাইল কোর্টসহ টাস্কফোর্সের অভিযান এবং বিভিন্ন সময় নিয়মিত মামলা পর্যন্ত করা হয়েছে।’
জেলা প্রশাসক মাহবুব মুরাদ বলেন, ‘গতকালও আমরা অভিযান চালিয়েছি। আজকেও ইনফ্যাক্ট অভিযান হয়েছে। তার পরও কেন এরকম হচ্ছে, সেটা জানার জন্য আগামীকাল (বুধবার) আমরা একটা সভা ডেকেছি। সেখানে বিষয়টা আমরা বোঝার চেষ্টা করবে। সে অনুযায়ী বিকল্প বা অন্য করণীয় আছে কি না, তা নির্ধারণ করবে।’
কেন সাদা পাথর নামে পরিচিত এবং কীভাবে তৈরি হয়?
সিলেট নগরী থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে সীমান্তবর্তী উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ। ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি ঝর্ণাগুলো থেকে যে নদীর উৎপত্তি হয়ে ভোলাগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে, সেই নদীর নাম ধলাই নদ। পাহাড় থেকে ঝর্ণার পানির স্রোতে এই নদী বেয়েই সাদা পাথর নেমে আসে। ধলাই নদের উৎসমুখের এই জায়গার নাম ভোলাগঞ্জ জিরো পয়েন্ট।
ঠিক এক বছর আগের এই স্থানের সৌন্দর্যকে ‘অনবদ্য ক্যানভাসের’ সঙ্গে তুলনা করেন কোম্পানীগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দা ও স্কুল শিক্ষক শাফকাত জামিল।
তিনি বলেন, ‘যতদূর চোখ যায় দুই দিকে কেবল সাদা পাথর আর মাঝখানে স্বচ্ছ নীল জল, আরেকদিকে পাহাড়ে মেঘের আলিঙ্গন। আপনার মনে হবে কাশ্মীরের মতো স্বর্গরাজ্য। সৌন্দর্যের এক অনবদ্য এক ক্যানভাস।
জামিল জানান, এই স্থানটি গত ১০-১২ বছরে মূলত পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে বেশি পরিচিতি পেয়েছে। কারণ হিসেবে যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতির কথা তুলে ধরেন তিনি। ২০১২ সাল থেকে মূলত এই স্থানটি পর্যটন স্পটে পরিণত হয়।
স্থানীয় সাংবাদিক রহমান এবং জামিল দুজনই জানান, সিলেট থেকে ভোলাগঞ্জের রাস্তা একসময় খুব খারাপ ছিল। পাথর পরিবহনের কারণে সিলেটের সবচেয়ে খারাপ রাস্তা ছিল সিলেট টু ভোলাগঞ্জ। কিন্তু রাস্তা ভালো হওয়ার পরে সিলেট শহর থেকে সাদা পাথর নামে পরিচিত ওই স্থানে যেতে মাত্র ৪০ মিনিট সময় লাগে।
জামিল বলেন, ‘কোনো পর্যটক যদি মনে করেন, সিলেট শহরে থেকে নানা স্থানে ঘুরবেন, তাহলে সাদা পাথরে আসতে তার মাত্র ৪০ মিনিট লাগবে। এ কারণে রাস্তা ভালো হওয়ার পর পর্যটকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে এখানে। ট্যুরিস্ট স্পট পরিচিতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভিড় হয় প্রচুর।’
সম্প্রতি গণমাধ্যমের কিছু ভিডিওতে দেখা যায়, এ সপ্তাহের শুরুর দিকে নৌকায় করে সাদা পাথর তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এমনকি গর্ত খুঁড়েও পাথর তুলতে দেখা যায় সেসব ভিডিওতে।
এরই মধ্যে সোমবার (১১ আগস্ট) সাদা পাথর লুট বন্ধ করতে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালায়। যেসব নৌকায় করে পাথর তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সেগুলো অকার্যকর করে দেওয়া হয়।
ওই অভিযানের পর মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) আর কাউকে পাথর লুট করতে দেখা যায়নি বলে জানান স্থানীয় সাংবাদিক মাহবুবুর রহমান রিপন।
তিনি বলেন, ৫ অগাস্টের পর থেকে মূলত সাদা পাথর লুট হওয়া শুরু হয়। প্রশাসনে যে স্থবিরতা বা ভীতিই- এই পাথর লুট হওয়ার কারণেই। প্রশাসন কঠোর না হওয়ার কারণেই এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে দাবি মাহবুবুর রহমান রিপনের।
পরিবেশগতভাবে ‘সাদা পাথর’ স্থান গুরুত্বপূর্ণ কেন? ক্ষতিকর প্রভাব কী?
পরিবেশবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিবের মতে, প্রাকৃতিকভাবে তৈরি এই স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা স্বচ্ছ পানির এ আধার এই এলাকার বেশ কিছু স্থানের খাবার পানির চাহিদা মেটায়।
তিনি বলেন, ‘প্রথম গুরুত্ব হচ্ছে- এই পাথরগুলো যেখান থেকে ন্যাচারালি আসে, ওইখান থেকে পানি প্রবাহের ভয়ঙ্কর রকম তোড় তৈরি হয়। মানে পানি প্রবাহের তীব্রতা বেড়ে যায়। যেখানে তোড় বেশি সেখানে পাথর জমে। পাথরের কাজ ওই তোড়ের পানিটাকে ভেঙে ভেঙে টুকরো টুকরো করে তার গতিকে নিয়ন্ত্রণ করা। এটা একটা প্রাকৃতিক ধাপ।’
ইকবাল হাবিব আরও বলেন, ‘পানির মধ্যে অক্সিজেন সংশ্লেষ করাও পাথরের কাজ, যাকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় বলে ‘সোলার অ্যাকুয়াটিক ন্যাচারাল প্রসেস অব ট্রিটমেন্ট’। প্রকৃতির এই পুরো সিস্টেমে যদি কোনো ব্যাঘাত ঘটানো হয় অর্থাৎ পাথর তুলে ফেলা হয়, তখন সিস্টেম ভেঙে পড়ে।’
তিনি বলেন, ‘এর ফলে দুই পাশে প্লাবনের পরিমাণ বাড়ে, ভাঙনের সৃষ্টি হয় এবং পানিটাকে গোড়াতেই সাংঘাতিকভাবে পলিউটেড (দূষিত) করে ফেলে। ওই অঞ্চলের অনেক জায়গায় খাবার পানির স্বল্পতা মেটায় এই পানি।’
এসব ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের কারণে প্রকৃতিগতভাবে অন্যান্য ক্ষতি তৈরির অভিঘাত সৃষ্টি হয় বলে মনে করেন পরিবেশবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।