মুফতি আতাউর রহমান : আরবি ভাষাবিদ ও সাহিত্যিকরা এই বিষয়ে একমত যে কোরআনের ভাষা সর্ববিবেচনায় মানোত্তীর্ণ এবং তা আরবি ভাষা ও সাহিত্যের জন্য মানদণ্ডস্বরূপ। কোরআনের শব্দ, বাক্য ও ভাষাশৈলী চির অনুসরণীয়। পবিত্র কোরআনে মানুষকে নানাভাবে সম্বোধন ও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, যা কোরআনের ভাষাগত উত্কর্ষ ও বাকশৈলীর বৈচিত্র্যের প্রমাণ। নিম্নে কোরআনের বিশেষ ১০টি সম্বোধনপদ্ধতি বর্ণনা করা হলো—
১. সম্মুখ সম্বোধন : সামনে থেকেই মানুষ পরস্পরকে সম্বোধন করে থাকে। সম্মুখ সম্বোধন মানুষকে তাত্ক্ষণিকভাবে প্রভাবিত করে। পবিত্র কোরআনেও মানুষকে এমনভাবে আহ্বান জানানো হয়েছে যেন তাকে সামনে থেকে সম্বোধন করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তা থেকে তাঁর স্ত্রী সৃষ্টি করেন, যিনি তাদের দুজন থেকে বহু নর-নারী ছড়িয়ে দেন।’
(সুরা : নিসা, আয়াত : ১)
২. গল্প বলার ভঙ্গিতে : পবিত্র কোরআনের গল্প বা ঘটনা বর্ণনার ভঙ্গিতে বহু নির্দেশ ও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, বিশেষত পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের বর্ণনা এই ভঙ্গিতেই দেওয়া হয়েছে। গল্প বলার ভঙ্গিতে কোনো কিছু বললে মানুষ তা সহজে হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদের বৃত্তান্তে বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য আছে শিক্ষা।’
(সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ১১১)
৩. সংবাদ প্রদানের ভঙ্গিতে : মহাগ্রন্থ কোরআনে পূর্ববর্তী জাতি-গোষ্ঠীর আলোচনা প্রধানত সংবাদ প্রদানের ভঙ্গিতে করা হয়েছে। এর মাধ্যমে তাদের কৃতকর্মের ব্যাপারে মানবজাতিকে বারবার সতর্ক করা হয়েছে। একই সঙ্গে মুমিনদের ধৈর্য ও আত্মত্যাগের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘এটাও কি তাদেরকে সৎপথ দেখাল না যে আমি তাদের আগে ধ্বংস করেছি কত মানবগোষ্ঠী, যাদের বাসভূমিতে তারা বিচরণ করে থাকে? অবশ্যই তাতে বিবেক সম্পন্নদের জন্য আছে নিদর্শন।’
(সুরা : তাহা, আয়াত : ১২৮)
৪. উপমা প্রদানের ভঙ্গিতে : উপমা ও দৃষ্টান্তের মাধ্যমে পবিত্র কোরআনে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। যেন মানুষ সহজেই উদ্দিষ্ট বিষয় বুঝতে সক্ষম হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা কুফরি করে তাদের কাজ মরুভূমির মরীচিকাসদৃশ, পিপাসার্ত যাকে পানি মনে করে থাকে, কিন্তু সে তার কাছে উপস্থিত হলে দেখবে, তা কিছু নয় এবং সে পাবে সেখানে আল্লাহকে, অতঃপর তিনি তার কর্মফল পূর্ণ মাত্রায় দেবেন। আল্লাহ হিসাব গ্রহণে তৎপর।’
(সুরা : নুর, আয়াত : ৩৯)
৫. ইঙ্গিতপূর্ণ ভঙ্গিতে : কখনো কখনো কোরআনে বিষয়টি খোলামেলা আলোচনা না করে ইঙ্গিত ও রহস্যপূর্ণ পদ্ধতিতে বর্ণনা করা হয়েছে, যেন তা চিন্তাশীল মানুষের চিন্তার খোরাক হয়। ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ কোরো, ইউসুফ তাঁর পিতাকে বলেছিল, হে আমার পিতা! আমি তো দেখেছি একাদশ নক্ষত্র, সূর্য ও চন্দ্রকে, দেখেছি তাদেরকে আমার প্রতি সিজদাবনত অবস্থায়। সে বলল, হে আমার বৎস! তোমার স্বপ্ন বৃত্তান্ত তোমার ভাইদের কাছে বর্ণনা কোরো না, করলে তারা তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে। শয়তান মানুষের প্রকাশ্য শত্রু।’
(সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৪-৫)
৬. তুলনামূলক পর্যালোচনার ভঙ্গিতে : তুলনামূলক পর্যালোচনার পদ্ধতি কোরআন কখনো মানুষের সামনে বাতিলের অসারতা তুলে ধরেছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘বোলো, কে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক? বোলো, আল্লাহ। বোলো, তবে কি তোমরা অভিভাবকরূপে গ্রহণ করেছ আল্লাহর পরিবর্তে অপরকে, যারা নিজেদের লাভ বা ক্ষতি সাধনে সক্ষম নয়? বোলো, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান অথবা অন্ধকার ও আলো কি এক?’
(সুরা : রাআদ, আয়াত : ১৬)
৭. কথোপকথনের ভঙ্গিতে : পারস্পরিক আলাপচারিতার ভঙ্গিতেও কোরআনে মানুষকে সম্বোধন করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘স্মরণ কোরো, যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করেছি, তারা বলল, আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে? আমরাই তো আপনার সপ্রশংস স্তুতিগান ও পবিত্রতা ঘোষণা করি। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই আমি যা জানি, তা তোমরা জানো না।’
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ৩০)
৮. বিতর্কের পদ্ধতিতে : বিতর্কের ভঙ্গিতে মানুষের সামনে সত্য উপস্থাপন করেছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা আরো বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নেতা ও বড় লোকদের আনুগত্য করেছিলাম এবং তারা আমাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিল। হে আমাদের প্রতিপালক! তাদেরকে দ্বিগুণ শাস্তি দাও এবং তাদেরকে দাও মহা অভিশাপ।’
(সুরা : আহজাব, আয়াত : ৬৭-৬৮)
৯. প্রশ্নোত্তরের পদ্ধতিতে : কোরআনের একাধিক স্থানে প্রশ্নোত্তরের পদ্ধতিতে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। যেমন ইরশাদ হয়েছে, ‘লোকে তোমাকে এতিমদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে; বোলো, তাদের জন্য সুব্যবস্থা করা উত্তম। তোমরা যদি তাদের সঙ্গে একত্র থাকো, তবে তারা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ জানেন কে কল্যাণকামী ও কে অনিষ্টকারী।’
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২২০)
১০. অভিযোগ খণ্ডনের পদ্ধতিতে : অভিযোগ খণ্ডনের পদ্ধতিতেও কোরআন মানুষকে সতর্ক করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘অন্যায়ভাবে কোনো বস্তু গোপন করবে—এটা নবীর পক্ষে অসম্ভব। কেউ অন্যায়ভাবে কিছু গোপন করলে, যা সে অন্যায়ভাবে গোপন করবে কিয়ামতের দিন সে তা নিয়ে আসবে। অতঃপর প্রত্যেককে যা সে অর্জন করেছে তা পূর্ণ মাত্রায় দেওয়া হবে। তাদের প্রতি কোনো অবিচার করা হবে না।’
(সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৬১)
আল্লাহ সবাইকে কোরআন অনুধাবনের তাওফিক দিন। আমিন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।