কোরবানির ঈদকে ঘিরে আমাদের সবার আগে চিন্তার বিষয় হলো মাংস সংরক্ষণের বিষয়টি। কীভাবে টাটকা মাংস দীর্ঘদিন ভালো রাখা যাবে তাই নিয়ে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়। কারণ, সঠিক পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ না করলে মাংসের স্বাদ ও পুষ্টিগুণ নষ্ট হয়ে যায়। আর সবাইকে মাংস দেওয়ার পরও অনেক মাংস থেকে যায়। তবে আর্দ্রতা, আলো, তাপ, জীবাণু, অক্সিজেন প্রভৃতির প্রভাবে পচনে হাত থেকে সঠিক উপায়ে মাংস সংরক্ষণ করা উচিত। তা না হলে এসব মাংস তাজা, স্বাস্থ্যকর ও খাওয়ার উপযোগী থাকে না।
মাংস সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্য হলো- মাংসকে জীবাণুমুক্ত রাখা, মাংসের স্বাদ ও গুণগত মান যতটা সম্ভব অক্ষুণ্ন রাখা। এ ছাড়াও মাংসের পচন রোধ করা এবং মাংস দ্বারা খাদ্যবাহিত রোগ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করে আর্থিক ক্ষতি কমানো।
মাংস যেভাবে ফ্রিজে সংরক্ষণ করবেন-
শুধু গরু বা খাসি নয় মুরগির মাংসও আপনি রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করতে পারেন। হিমশীতল এবং খাদ্য সুরক্ষার বিষয়ে ইউএসডির নির্দেশিকা হলো, মাংস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে তা যেন, শূন্য ডিগ্রি ফারেনহাইট (-১৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) এ জমাট বাঁধে। এর ফলে ব্যাকটেরিয়া, ইস্টসহ ক্ষতিকর জীবাণুগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। পাশাপাশি খাবার নষ্ট করে যেসব এনজাইম, সেগুলোর কার্যক্রমও ধীর হয়ে যায়।
এফডিএ’র পরামর্শ অনুযায়ী, এভাবে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় মাংস সংরক্ষণ করে আপনি ৪-১২ মাস পর্যন্ত খেতে পারবেন। তবে মাংসের সাইজগুলো একটু বড় করে রাখতে হবে। অন্যদিকে কিমাজাতীয় গরু বা খাসির মাংস ৩-৪ মাসের বেশি হিমায়িত করা উচিত নয়। অন্যদিকে রান্না করা মাংস আপনি হিমায়িত করে ২-৩ মাস পর্যন্ত খেতে পারবেন। এর বেশি হলে খাবারের পুষ্টিগুণ কমতে শুরু করবে।
মাংসে যতটা কম চর্বি থাকবে, তা বেশিদিন সংরক্ষণ করা যাবে। তাই মাংস সংরক্ষণের আগে অবশ্যই চর্বি সরিয়ে রাখতে হবে। আবার মাংস কাটার ধরন যেন বেশি মোটা না হয়, স্লাইস করে রাখলে বেশি ভালো থাকবে। মাংস সংরক্ষণ করতে অবশ্যই জিপলক ব্যাগ ব্যবহার করা উচিত। অবশ্যই মাংস ছোট ছোট প্যাকেটে সংরক্ষণ করবেন। অনেকেই বড় প্যাকেট করে থাকেন, বারবার সেই প্যাকেট ভিজিয়ে পরিমাণমতো মাংস রেখে আবারও ওই প্যাকেট ফ্রিজে রেখে দেন। এমনটি করলে মাংস নষ্ট হয়ে যাবে।
তবে সেই ব্যাগ যেন খাদ্য নিরাপত্তা দিতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন প্লাস্টিক ব্যাগ বা বক্স ব্যবহার করবেন না। সবচেয়ে ভালো হয় ভ্যাকিউম-সিল্ড ব্যাগ ব্যবহার করা। মাংসের পুষ্টিমান ও স্বাদ ভালো রাখতে চাইলে গরুর মাংস ৮-১২ মাস এবং যেকোনো ধরনের মুরগির মাংস ৩-৬ মাসের বেশি ফ্রিজে সংরক্ষণ করা উচিত নয়। মাংস সংরক্ষণের আগে প্রয়োজন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে মাংস কাটা, ধোয়া এবং সঠিক পাত্র ব্যবহার করা।
মাংস যখন রাখা হবে তখন একটি প্যাকেটের মাঝে কাগজ দিয়ে আরেকটি প্যাকেট রাখতে হবে। এতে দীর্ঘদিন ফ্রিজে থাকলে একটির সঙ্গে আরেকটি প্যাকেট আটকে যাবে না। ফ্রিজ থেকে সহজেই মাংসের প্যাকেট বের করে নিতে পারবেন।
শুধু ফ্রিজে রেখে নয়, আরও যেসব উপায়ে মাংস সংরক্ষণ করতে পারবেন-
ক্যানিং পদ্ধতি: মাংস সংরক্ষণের আরও এক পদ্ধতিকে থার্মাল স্টেরিলাইজেশন বলে। এক্ষেত্রে মাংস প্রায় ২৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় ড্রাই করে ঠান্ডা করা হয়। এরপর কাচের জার বা বয়ামের মুখ আটকে তাতে এই মাংস প্রায় এক বছর রাখা যায়। এই পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মাংস কাটা, রান্নার আগে সিমিং, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, ঠান্ডা করা ইত্যাদি বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে।
স্মোকিং পদ্ধতি: এটিও একটি পুরোনো পদ্ধতি। যেখানে হট স্মোকিং অর্থাৎ ৩০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় মাংস পোড়ানো হয়। আর কোল্ড স্মোকিং পদ্ধতিতে ১২-২৪ ঘণ্টা স্মোকিং আগুনে ৮৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় পোড়াতে হয়। এর ফলে তাপের ধোঁয়ায় মাংসের মাইক্রোবসগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এই পদ্ধতি সাধারণত মাংস ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করে থাকেন।
সল্টিং বা লবণ পদ্ধতি: এই পদ্ধতিতে লবণ, কিউরিং লবণ, মসলা এবং ব্রাউন চিনি অথবা খাবার লবণ, সোডিয়াম নাইট্রেট ও সোডিয়াম ল্যাকটেট দিয়ে মাংস মেখে ২৪ ঘণ্টা রেখে ফ্রিজে ১ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। এই পদ্ধতি টিএফডিএ অনুমোদিত। সল্টিং পদ্ধতিতে মাংস সবচেয়ে বেশি টাটকা এবং পুষ্টিগুণসম্পন্ন হয়ে থাকে। মাংসের অক্সিডেটিভ ও মাইক্রোবিয়াল পচন প্রতিরোধ এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে ভালো হয়।
ড্রাইং পদ্ধতি: অতীতে যখন ফ্রিজের ব্যবহার ছিল না, তখন পুরোনো এই পদ্ধতিতে মাংস রোদে বা চুলায় জ্বাল দিয়ে ৭০-৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সম্পূর্ণ পানি শুকিয়ে নেওয়া হতো। এই পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ খুবই কম খরচে করা যায়। এক্ষেত্রে মাংসের চর্বি ফেলে দিয়ে পাতলা করে কেটে ভ্যাকিউম-সিল্ড করে ফ্রিজে ১ বছর পর্যন্ত রাখা যায়।
রান্নার টিপস
কয়েক ঘন্টা মাত্র বাকি। আগামীকাল (১০ জুলাই) মুসলিম ধর্মালম্বীদের ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। আর এই ঈদে গরুর মাংস খাবেন না, তা হবে না! ওজনাধিক্য, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও কিডনির রোগীদের রেড মিট খাওয়া নিষেধ। কিন্তু চারপাশ থেকে ভেসে আসে গরুর মাংস রান্নার নানান রকম ঘ্রাণ। মন সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে যায়। তাই চলুন দেখে নেওয়া যাক, গরুর মাংস রান্নার সহজ কিছু টিপস।
>> অল্প তেলে রান্না করুন। অনেকে মনে করেন, তেল বেশি দিলেই রান্না ভালো হয়। একদম ভুল কথা। অল্প তেলে রান্না করুন গরুর মাংস। কারণ, গরুর মাংসের নিজস্ব যে তেল আছে, তাতেই অনেকটা কাজ হয়ে যায়। সয়াবিনের বদলে ব্যবহার করতে পারেন শর্ষের তেল।
>> মাংসগুলো থেকে চর্বি আলাদা করে নিন। আর মাংসের ছোট ছোট টুকরা করে কাটুন। যত ছোট টুকরা করবেন, ততই তেলজাতীয় পদার্থ ঝরে যাবে।
গরুর মাংস রান্না করতে পারেন সবজির সঙ্গে। তাতে প্রোটিন, তেল বা ক্যালরি সবটার পরিমাণই কমে আসবে। আলু, পেঁপে, পটল, ফুলকপি বা মেটে আলু দিয়ে রান্না করতে পারেন গরুর মাংস। অনেকে আবার গরুর মাংস রান্নায় চুইঝাল আর আস্ত রসুন পছন্দ করেন। সেটিও আপনার গরুর মাংসে যোগ করবে আলাদা মাত্রা।
>> গরুর মাংস রান্নার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো, এটি সেদ্ধ হতে অনেকটা সময় লাগে। এর সহজ সমাধান আছে। পেঁপে, আনারস, নাশপাতির রস, লেবু, ভিনেগার, দই মাংস নরম করতে সাহায্য করে। পেঁপে, আনারস, নাশপাতি বেটে, সব মসলা দিয়ে মাংস ৩০ মিনিট ম্যারিনেট করুন। লেবু, ভিনেগার, দইয়েও মাখিয়ে রাখতে পারেন মাংস। তবে বেশিক্ষণ ম্যারিনেট করে রাখবেন না। তাতে মাংসের প্রোটিন স্ট্রাকচার দুর্বল হয়ে যেতে পারে।
রান্নার আগে মাংসে বেশি করে লবণ মেখে ঘণ্টাখানেক রেখে দিন। লবণ মাংসের শক্ত মাসল ফাইবার সহজেই ভেঙে ফেলে। তাই মাংস নরম হয়ে যায়, সহজে সেদ্ধ হয়ে যায়।
>> টকদই বা আম, চালতা, জলপাইয়ে বোম্বাই মরিচের আচার দিয়েও রান্না করতে পারেন গরুর মাংস।
টেস্টিং সল্ট, সয়া সস এগুলো না ব্যবহার করাই ভালো। মাংস বারবার গরম করতে নেই। এতে পুষ্টি উপাদান নষ্ট হয়ে ক্ষতিকর উপাদান ও জটিল প্রোটিন তৈরি হয়।
>> গরুর মাংসের সঙ্গে প্রচুর সালাদ খান। খাওয়া শেষে কোল্ড ড্রিংকস না খাওয়াই ভালো। কোল্ড ড্রিংকস ও ডেজার্টের পরিবর্তে মাঠা, জিরা পানি বা টকদই খান।
>> গরুর মাংস ভুনা না করে আরও ভালো হয় তেল ছাড়া বেক, গ্রিল, স্টেক করে খেতে পারলে। সেখানে চর্বি প্রায় থাকে না বললেই চলে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।