এমরান আহমেদ : আমাদের শরীরের যে গাঠনিক একক রয়েছে, তার নাম সেল বা কোষ। এই কোষগুলো শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে পরিচিত। আপনার যকৃতের কোষগুলোকে বলা হয় হেপাটোসাইট৷ আবার স্নায়ুতন্ত্রের কোষকে নিউরন বলে। যখনই বিভিন্ন ধরনের বাহ্যিক এবং অভ্যন্তরীণ প্রভাবকের প্রভাবে এই দেহকোষের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি বা পরিবর্তন ঘটে, তাকেই বলা হয় ক্যান্সার।
বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষের অকাল মৃত্যু ঘটাচ্ছে, একেকটি পরিবারকে চিরতরে শেষ করে দিচ্ছে। ক্যান্সারের ব্যায়বহুল চিকিৎসা করাতে গিয়ে বহু মানুষ নিঃস্ব হয়ে সর্বশান্ত হচ্ছে, আমরা অকালে আমাদের প্রিয়জনদের হারাচ্ছি।
সম্প্রতি ক্যান্সার নির্মূলে যুগান্তকারী আবিষ্কারের খবর আসছে নিয়মিত। মার্কিন বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন এই একটি ওষুধেই নাকি ক্যান্সার পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হবে।
ইতিমধ্যে ১৮ জন মলদ্বারে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর ওপর এই ওষুধের পরীক্ষা করা হয়েছে। আর সেই ট্রায়ালের ফলাফল বিজ্ঞানীদের আশার আলো দেখিয়েছে। ছয়মাস ধরে এই রোগীদের ওপরে গবেষণা চালানো হয়। গবেষকদের দাবি, এই রোগীদের ক্যান্সার সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা এই ওষুধকে ‘মিরাক্যাল ড্রাগ’ বলে উল্লেখ করেছেন। এই ওষুধ আগামীদিনে আশার আলো দেখাবে বলেই ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ১৮ জন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর ওপরে ডস্টারলিম্যাব ( ব্যান্ড নাম জেমপেরলি) নামে একটি ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। এই ওষুধে থাকা একটি জৈব অণুই মানবশরীরে অ্যান্টিবডির বিকল্প হিসেবে কাজ করছে।
২০১৯ সালে গ্ল্যাক্সো স্মিথক্লাইন অধিগ্রহণ করার আগে, ম্যাসাচুসেটসের একটি বায়োটেক কোম্পানি টেসারো এই ডস্টারলিমাব ওষুধটি তৈরি করে।
যা কোলোরেক্টাল ক্যান্সার প্রতিরোধে অভাবনীয় সাফল্য দেখিয়েছে।
পরীক্ষায় অংশ নেওয়া রোগিদের শরীরে ছয়মাস এই ওষুধ প্রয়োগের পরেই দেখা যায়, তাদের শরীরে থাকা টিউমার (ক্যানসার) সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। ডস্টারলিম্যাব হল গবেষণাগারে উৎপাদিত একটি ড্রাগ, যা মানবদেহে বিকল্প অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সাহায্য করে।
মলদ্বারে ক্যানসার আক্রান্ত ১৮ জন রোগীদের সকলকে এই ড্রাগ দেওয়া হয়। এর পরই অভূতপূর্ব ফলাফল দেখা যায়। এরপর রোগীদের এন্ডোস্কোপি, পজিট্রন নির্গমন টমোগ্রাফি বা পিইটি স্ক্যান বা এমআরআই স্ক্যান করে শারীরিক পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় দেখা গেছে তাদের প্রত্যেকের শরীর থেকে তাদের মলদ্বারের ক্যান্সার সম্পূর্ণ নির্মূল হয়েছে।
নিউইয়র্কের মেমোরিয়াল স্লোন কেটারিং ক্যান্সার সেন্টারের গবেষক চিকিৎসক লুইস এ. ডিয়াজ জে বলেন, ক্যান্সার নির্মূলে এই ড্রাগ একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। ক্যান্সারের চিকিৎসার ইতিহাসে প্রথমবারের মত এই অভাবনীয় ফলাফল পাওয়া গেল।
ক্যান্সার নির্মূলের জন্য রোগীদের বহু শারীরিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে কেমোথেরাপি, রেডিয়েশন, অস্ত্রোপচার। পরবর্তীতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় প্রস্রাব, অন্ত্রজনিত সমস্যা, যৌনক্ষমতা হারানোর মতোও অসুবিধায় সম্মুক্ষীণ হতে হয় রোগীকে। তবে তাদের ক্ষেত্রে এই অসুধটি সেই পার্শপ্রতিক্রিয়া অনেকটাই কমিয়েছে।
ক্যানসারের এই ওষুধ চিকিৎসাজগতে একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার বলে দাবি করেছেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কোলোরেক্টাল ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ অ্যালান পি ভেনুক। এই ড্রাগের ট্রায়াল রোগিদের কোনো শারীরিক সমস্যা তৈরি করেনি। তবে আরও ট্রায়ালের প্রয়োজন রয়েছে বলে জানিয়েছেন ভেনুক।
ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের কথায়, এই চিকিৎসা আশার আলো দেখাচ্ছে ক্যান্সারের চিকিৎসায় নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে যাচ্ছে। তবে এটি সব ধরনের ক্যান্সার নির্মূল করতে পারবে কিনা তা জানার জন্য আরও বড় মাত্রায় ট্রায়ালের প্রয়োজন ।
২০২১ সালের ১৭ আগষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্র্যাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন জেমপেরলিকে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দিয়েছে।
বিজ্ঞানীরা বর্তমানে কেমোথেরাপির বিকল্প হিসেবে নানা ধরনের নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করছেন। ন্যানোটেকনোলজি ব্যবহার করে সাধারণ কোষকে ক্ষতিগ্রস্ত না করেই ক্যান্সার আক্রান্ত কোষকে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা।
ক্যান্সারের মানবদেহে বিস্তৃতি, এর আক্রমণের বৈচিত্র্য, আমাদের খাদ্যাভ্যাস, জীবনধারা, পরিবেশের দূষণের কারণেও একে জয় করা কঠিন। তবে বিজ্ঞানীরা থেমে নেই। তারা চেষ্টা করে চলেছেন কীভাবে মানুষকে এই ক্যান্সারের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করা যায়।
লেখক: প্রেষণে, ডিপ্লোমা ইন চাইল্ড হেলথ, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ
সূত্র : ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি অব মেডিসিন, যুক্তরাষ্ট্র
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।